৩১ মার্চ ২০২০, মঙ্গলবার, ১২:০৩

সবখানেই গলদ

বিশ্বজুড়ে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের মহামারি চলছে। প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর নতুন রেকর্ড হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোও পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় এ সময়ে 'লকডাউন', 'আইসোলেশন' এবং 'কোয়ারেন্টাইন'- এই তিনটি শব্দ বিভিন্ন দেশে মানুষের মুখে মুখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই তিনটি শব্দকে সর্বত্র সমধিক পরিচিত করে তুলেছে। বাংলাদেশে এই তিনটি ক্ষেত্রেই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে রয়েছে গলদ। এই তিনটি শব্দের কোনোটিই দেশে যথাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্য বিশ্নেষণ করলে দেখা যায়, লকডাউন মানে কোনো পুরো দেশ কিংবা দেশের মধ্যে কোনো একটি এলাকায় বসবাসকারী মানুষকে অন্যান্য স্থানের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। অবরুদ্ধ অবস্থা তৈরি করা। আর আইসোলেশন মানে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার পর তাকে পৃথক করে ফেলা। মৃদু সংক্রমণ হলে বাড়িতে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। অপরদিকে সংক্রমণের মাত্রা মারাত্মক হলে হাসপাতালে পৃথক রেখে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। তৃতীয় শব্দ কোয়ারেন্টাইন মানে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে ছিলেন কিন্তু আক্রান্ত নন- এমন ব্যক্তিদের পৃথক স্থানে রাখার ব্যবস্থা করা। গত ২৬ মার্চ সরকারি-বেসরকারি অফিস ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে বাসাবাড়িতে রাখা। কিন্তু সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। টানা ১০ দিনের ছুটি পেয়ে মানুষ স্রোতের মতো বিভিন্ন পরিবহনে গাদাগাদি করে গ্রামে ফিরে গেছেন। যাত্রী পরিবহনগুলোর চলাচল বন্ধ থাকায় বিকল্প ব্যবস্থায় অর্থাৎ পণ্যবাহী ট্রাক, কুরিয়ার সার্ভিসের পরিবহনে করে মানুষ গ্রামে ফেরে। এর আগে থেকেই বিদেশফেরত ব্যক্তিরা গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করছেন। তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হলেও বেশিরভাগ ব্যক্তি তা মানেননি। হোম কোয়ারেন্টাইনে না থেকে তারা সর্বত্র ঘোরাঘুরি করেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সরকার সংক্রামক ব্যাধি আইন অনুযায়ী এ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়। দেশের অনেক জায়গায় গত কয়েকদিনে হোম কোয়ারেন্টাইন শর্ত না মানার দায়ে কয়েকশ' ব্যক্তিকে জরিমানা করা হয়েছে। এরপর সরকার বিদেশফেরতদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বিদেশফেরতরা যেসব স্থানের ঠিকানা পাসপোর্টে উল্লেখ করেছেন, সেখানে গিয়ে তাদের অনেককেই পাওয়া যায়নি।

এর মধ্যেই রাজধানী ঢাকা ছেড়ে লাখ লাখ মানুষ গ্রামে ফিরেছেন। এ পরিস্থিতি ঢাকার পাশাপাশি গ্রামকেও অনিরাপদ করে তুলেছে।

এদিকে গত শনি ও রোববার পরপর দু'দিন করোনা আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি শনাক্ত হয়নি বলে জানায় আইইডিসিআর। এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেনি। বরং সুস্থ হয়ে আরও কয়েকজন বাড়ি ফিরে গেছেন। একই সময়ে অনলাইন ব্রিফিংয়ে উপস্থিত হয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, 'আমরা ভালো আছি। বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় এখনও অনেক ভালো আছে। আমরা অনেক আগে প্রস্তুতি নিয়েছি বলেই ভালো আছি। ইউরোপ-আমেরিকার অবস্থা কেমন, সেটা আপনারা জানেন'। নতুন আক্রান্ত ও মৃত্যু না পাওয়া নিয়ে আইইডিসিআরের ব্রিফিং এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এমন উৎসাহব্যঞ্জক বক্তব্যে করোনা আতঙ্কে উদ্বিগ্ন ঘরবন্দি মানুষ রাস্তাঘাটে বের হতে শুরু করেছে বলে মনে করেন অনেকে।

রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে গতকাল সোমবার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, মোড়ে মোড়ে তরুণদের জটলা। এমনকি কিছু কিছু জায়গায় অঘোষিত বাজারও বসেছে। বাধ্য হয়ে পুলিশকে কিছু জায়গায় মাইকিং করতে হয়েছে। এ চিত্রই বলে দেয়, মানুষের মধ্যে ঘরে থাকা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে শিথিলতা চলে এসেছে।

যদিও ২৬ মার্চ সরকারি ছুটি ঘোষণার পর রাজধানীর রাস্তাঘাট পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে পড়েছিল। জনশূন্য এমন ঢাকা শেষ কবে মানুষ দেখতে পেয়েছে তা জানা নেই। তবে গত দু'দিন ধরে রাস্তাঘাটে আবার রিকশা-গাড়ি, প্রাইভেটকার চলাচল সীমিত পর্যায়ে হলেও শুরু হয়েছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কিছুটা কমেছে।

এসব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, এখন পিকটাইম চলছে। তাই নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অবশ্যই বাসাবাড়িতে থাকতে হবে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। অন্যথায় ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন এবং লকডাউন- এই তিনটি শব্দের কোনোটিই বাংলাদেশে যথাযথভাবে হচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আইসোলেশন হলো আক্রান্ত ব্যক্তিকে পৃথক করা। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির মধ্যে করোনা পজিটিভ হলে তাকে আইসোলেশন করতে হবে। আর কোয়ারেন্টাইন হলো আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে ছিলেন কিন্তু আক্রান্ত নন- এমন সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের পৃথকভাবে রাখাকে কোয়ারেন্টাইন বলে। অন্যদিকে, লকডাউন হলো কোনো নির্দিষ্ট এলাকাকে পুরোপুরি অবরুদ্ধ অবস্থায় রাখা। ওই এলাকা থেকে কোনো মানুষ বাইরে বের হতে কিংবা কেউ ওই এলাকার ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না। যেমনটি চীনের উহান শহরে করা হয়েছিল। সেখানে বাসাবাড়ি থেকে কাউকে বের হতে দেওয়া হয়নি। ড্রনের মাধ্যমে খাবার পাঠানো হয়েছিল।

ডা. নজরুল ইসলাম আরও বলেন, আইইডিসিআর সংবাদ সম্মেলনে বলা হচ্ছে, ৬২ জন আইসোলেশনে আছেন। আর ৩২ জন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আছেন। তাহলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্য অনুযায়ী ওই ৬২ জনকে আক্রান্ত বলতে হবে। কিন্তু আইইডিসিআর কি তা স্বীকার করেছে? তাহলে আইসোলেশন কথাটি কেন আসছে। আইসোলেশন মানে ওইসব ব্যক্তি আক্রান্ত- এটি স্বীকার করতে হবে। আবার কোয়ারেন্টাইন নিয়ে তারা যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, সেটিও তো হচ্ছে না। অন্যদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না দিলেও সবকিছু বন্ধ করে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে দেশ কার্যত 'লকডাউন' করা হয়েছে; কিন্তু সেটিও তো কার্যকর হচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) উপদেষ্টা রোগতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে অস্বীকৃতি জানান। তবে তিনি সমকালকে বলেন, করোনা আক্রান্ত হলেই তাকে আইসোলেশন করা হয়। অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করে অথবা বাসায় পৃথকভাবে রেখে চিকিৎসা দিতে হবে। আর কোয়ারেন্টাইন হলো আক্রান্ত নন। কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে থাকার ইতিহাস আছে। এমন ব্যক্তিদের পৃথকভাবে কোয়ারেন্টাইন করতে হবে।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব সমকালকে বলেন, আইইডিসিআর পুরো বিষয়টি নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। সংক্রমিত না হলে আইসোলেশনের প্রশ্ন কেন আসবে? তাকে তো কোয়ারেন্টাইনে রাখার কথা ছিল। আবার কোয়ারেন্টাইন তাহলে কাদের করা হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া জরুরি। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে করোনা সন্দেহে মৃত্যুর খবর আসছে। সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন। ওইসব ব্যক্তিরা করোনা পজিটিভ হলে তাদের সংস্পর্শে যারা ছিলেন তাদেরকেও জরুরি ভিত্তিতে কোয়ারেন্টাইন করতে হবে। আইইডিসিআর বলছে, প্রতিদিন তাদের এক হাজার নমুনা পরীক্ষা করার সামর্থ্য রয়েছে। তাহলে এসব ব্যক্তিদের কেন পরীক্ষা হচ্ছে না? তিনি বলেন, মানুষ করোনা ভয় কাটিয়ে রাস্তাঘাটে নেমে পড়েছে। এটি ভয়ংকর। বর্তমানে পিকটাইম চলছে। সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই সবার প্রতি আহ্বান থাকবে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত সবাই ঘরে থাকুন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। তাহলেই আমরা কিছুটা নিরাপদ থাকতে পারব।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর সমকালকে বলেন, করোনার লক্ষণ-উপসর্গ আছে সন্দেহভাজন- এমন ব্যক্তিদের হাসপাতালে ভর্তি করে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। কিন্তু তারা এখনও করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়নি। তাদের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাদের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে। আর আক্রান্ত দেশ থেকে ফেরত আসা কিংবা তাদের সংস্পর্শে ছিলেন এমন ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টইনে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ তাদের ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। এজন্য তাদের কোয়ারেন্টাইন করা হয়েছে।

ডা. এএসএম আলমগীর আরও বলেন, দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে আইসোলেশনে থাকা ব্যক্তিরা ভর্তি আছেন। সবার নমুনা এখনও এসে পৌঁছায়নি। একসঙ্গে ৯০ জনের পরীক্ষা করলে একটি রি-এজেন্টে সম্ভব হয়। বিশ্বব্যাপী রি-এজেন্টের স্বল্পতা রয়েছে। এ অবস্থায় পৃথকভাবে প্রত্যেকের পরীক্ষা করে রি-এজেন্ট ব্যয় করে ফেললে পরে প্রয়োজনের সময় ঘাটতি তৈরি হতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনা করে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। এমন অধিকসংখ্যক ব্যক্তিকে একসঙ্গে করে পরীক্ষা করা হবে। যাদের নেগেটিভ আসবে তাদের ছাড়পত্র দেওয়া হবে। আর যাদের পজিটিভ আসবে তাদের আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হবে। আর আক্রান্ত দেশ থেকে ফেরত আসা কিংবা ওই ব্যক্তিদের সংস্পর্শে ছিলেন তাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। সুতরাং এটি নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই বলে মনে করেন তিনি।

https://samakal.com/bangladesh/article/200317179