৩০ মার্চ ২০২০, সোমবার, ১:০২

করোনা ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা: পরীক্ষা ও চিকিৎসায় ঢিলেঢালা ভাব

দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্তের পর তিন সপ্তাহ অতিবাহিত হয়েছে। এরই মধ্যে দেশে শুরু হয়েছে ভাইরাসটির সামাজিক সংক্রমণ (কমিউনিটি ট্রান্সমিশন)। এ অবস্থাকে সরকার স্বল্পপরিসরে সামাজিক সংক্রমণ বলে উল্লেখ করেছে। এখন পর্যন্ত সংক্রমিত রোগীদের সংস্পর্শে আসা সবাইকে চিহ্নিত করে পরীক্ষার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।

এ ছাড়া বিদেশ থেকে আসা সবার পরীক্ষাও হয়নি। এই অচিহ্নিত লোকগুলোই ভাইরাসটি সমাজে জ্যামিতিক হারে ছড়িয়ে দেয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে। বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা- এদের হাত ধরে দেশ করোনাভাইরাস সংক্রমণের চতুর্থ ধাপে প্রবেশ করতে পারে। এছাড়া করোনাভাইসে আক্রান্তদের চিকিৎসা এবং সন্দেহভাজনদের পরীক্ষায় ঢিলেঢালাভাব দেখা যাচ্ছে। এসব কারণে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তাদের ধারণা, চলতি সপ্তাহে ভাইরাসটি ‘ইনকিউবেশন পিরিয়ড’ পার করবে।

জানা গেছে, জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন পথে ৬ লাখ ৬৫ হাজার ১৩ জন দেশে প্রবেশ করেছেন। শেষ দুই সপ্তাহে এসেছেন পৌনে দুই লাখ মানুষ। এ ছাড়া এ পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদফতর ও আইইডিসিআরের হট নম্বরগুলোয় সহায়তা চেয়ে ফোনকল এসেছে ৮ লাখ ২ হাজার ৫৮০ জনের। এ পর্যন্ত পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র এক হাজার ৭৬ জনের। বাকি লোকদের ভেতর কতজন আক্রান্ত তা কেউ বলতে পারছে না। শনাক্তের বাইরে থাকা লোকগুলো সমাজে মেলামেশা করছেন। নিজের অজান্তেই ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। বিশেষজ্ঞদের মতে, সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা এবং জনগণের জীবনযাপন প্রক্রিয়ায় কয়েকদিনের মধ্যেই এটি চতুর্থ স্তর বা মহামারীতে পরিণত হতে পারে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যত দ্রুত সম্ভব শনাক্ত রোগীদের সংস্পর্শে আসা (কন্ট্রাক ট্রেসিং) সবাইকে পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি পালিয়ে না থেকে জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান যুগান্তরকে বলেন, শেষ দুই সপ্তাহে এক লাখ ৮০ হাজার মানুষ দেশে ফিরেছেন। তাদের পরীক্ষার আওতায় আনা হয়নি। এত সামান্য পরিমাণ মানুষকে পরীক্ষার আওতায় আনা হয়েছে যে, তা থেকে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। দেশের প্রকৃত পরিস্থিতি জানতে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আরও বেশি পরীক্ষা করতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সংক্রমণের ভিত্তিতে কোভিড-১৯ রোগীদের ৪টি স্তরে ভাগ করা যায়। প্রথম স্তর: ইম্পোর্টেড কেস বা অন্য দেশ থেকে আসা কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী। দ্বিতীয় স্তর: লোকাল ট্রান্সমিশন বা স্থানীয় সংক্রমণ যাতে অন্য দেশ থেকে আসা রোগীর সংস্পর্শে এসে যারা আক্রান্ত হয়। তৃতীয় স্তর: কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা সামাজিক সংক্রমণ যখন বিদেশ থেকে আসা বা কোনো নিশ্চিত কোভিড-১৯ রোগীর সংস্পর্শে না এসেই এই রোগে কেউ আক্রান্ত হয়। অর্থাৎ অজানা উৎসে সংক্রমণ। চতুর্থ স্তর: এপিডেমিক বা মহামারী, যখন সামাজিক সংক্রমণ ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ে।

এ প্রসঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশে সংস্পর্শে আসা সবাইকে পরীক্ষার আওতায় আনা হয়নি। আইইডিসিআর এ কাজটি করতে পারেনি। পরীক্ষা তো পরের কথা, তারা কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের কাজটাই একেবারে দায়সারা গোছের করেছেন। এমনকি লক্ষণ প্রকাশের পরও তারা সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের পরীক্ষা করতে গড়িমসি করেছেন। তারা রোগীর গোপনীয়তা নিশ্চিতের নামে সব তথ্যই চেপে যাচ্ছেন। অথচ অন্য দেশগুলো কতটা দক্ষতার সঙ্গে রোগীর পরিচয় গোপন রেখেই প্রতিদিন প্রতিটি কেসের কন্টাক্ট ট্রেসিং উন্মুক্ত করে দিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ বর্তমানে করোনাভাইরাস সংক্রমণের তৃতীয় স্তরে অবস্থান করছে। এখন পর্যন্ত কোনো দেশই প্রথম এবং দ্বিতীয় স্তরে এই প্রাণঘাতী ভাইরাসকে আটকে রাখতে পারেনি। তবে যেসব দেশ সফল হয়ছে, তারা মূলত তৃতীয় স্তর থেকে চতুর্থ স্তরে যাওয়ার পথ বন্ধ রাখতে পেরেছে। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান সফল হয়েছে শুধু ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে পরীক্ষার আওতায় এনে। তারা দ্রুত আক্রান্ত ব্যক্তিকে পরীক্ষার মাধ্যমে চিহ্নিত করেছে, তাদের আইসোলেট করেছে, লক্ষণ প্রকাশের পর থেকে ল্যাবরেটরি টেস্টে পজিটিভ রেজাল্ট আসার আগ পর্যন্ত ওই রোগীর সংস্পর্শে যতজন এসেছে, তাদের সবাইকে খুঁজে বের করে তালিকা করেছে। কমপক্ষে ১৪ দিন কঠোরভাবে মনিটরিং করেছে। যে প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় কন্টাক্ট ট্রেসিং।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দেরিতে হলেও সরকার প্রস্তুতি নিয়েছে। সরকারেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এ ক্ষেত্রে জনগণের উচিত পালিয়ে না বেড়িয়ে সরকারকে সহযোগিতা করা। তারা যদি নিজ উদ্যোগে এসে পরীক্ষা করায়, ঠিকমতো কোয়ারেন্টিন পালন করে তাহলে দেশকে সহযোগিতা করা হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনে স্পষ্ট করে বলা আছে, হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় যদি কোনো রোগীর কোভিড-১৯ পজিটিভ রেজাল্ট আসে তাহলে ওই হাসপাতালের যতজন স্বাস্থ্যকর্মী (ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়, টেকনিশিয়ান ইত্যাদি) রোগীর সংস্পর্শে এসেছে তাদের সবাইকে লক্ষণ প্রকাশ পাক বা না পাক, কোভিড-১৯-এর ল্যাবরেটরি টেস্ট করতে হবে। তাদের মধ্যে কারও পজিটিভ হলে আইসোলেশনে নিতে হবে এবং নেগেটিভ এলে কোয়ারেন্টিন করে মনিটরিং করতে হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতাল, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ এ পর্যন্ত যেসব হাসপাতালে কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগী পাওয়া গিয়েছে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে ওই হাসপাতালগুলোর ডাক্তার, নার্সসহ অন্য স্টাফরা কোয়ারেন্টিনে গেছেন, তাদের সবাইকেই পরীক্ষার আওতায় আনা হয়নি। এ ছাড়া এসব রোগীর সংস্পর্শে আসা অপরিচিত বক্তি এবং পরিবারের সদস্যরাও পরীক্ষার বাইরে। আক্রান্ত ৪৮ রোগীর প্রত্যেকের সংস্পর্শে গড়ে ৫০ জন এলেও প্রায় আড়াই হাজার মানুষকে পরীক্ষার আওতায় আনতে হতো। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ গবেষণা ইন্সটিটিউট আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুসতাক আহমদ যুগান্তকে বলেন, আমার তৃতীয় স্তরে আছি। আমাদের পরীক্ষার আওতা বাড়ানো হয়েছে। ডাক্তার, নার্সদের পরীক্ষার আওতায় আনা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমার মনে হয় দেশে উপচে পড়া রোগী পাওয়া যাবে না। কোথাও বেশি রোগী সংক্রমণের খবর পাওয়া গেলে সেখানে ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে সেখান থেকে ছড়িয়ে না পড়ে। এভাবেই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, এটি একটি জীবন্ত শরীরের মতো, কোনো অংশকেই অবহেলা করা যাবে না।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/293876/