২৮ মার্চ ২০২০, শনিবার, ১২:৪৯

করোনায় বেশি ঝুঁকিতে গ্রামের মানুষ

নিয়মনীতি মানছে না শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়া লোকজন; প্রবাসীদের অনেকেই উধাও; ঝুঁকি এড়াতে হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা জরুরি

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে গ্রামের মানুষ। প্রথমত, বিদেশ ফেরত প্রবাসীরা গ্রামে গিয়ে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছেন না। তাদের অনেকেই প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে আত্মীয়স্বজনের বাসাবাড়িতে গিয়ে অবস্থান করছেন। প্রশাসন তাদের অনেককেই খুঁজে পাচ্ছে না। এতে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি। দ্বিতীয়ত, সাধারণ ছুটি কাটাতে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর থেকে লাখ লাখ মানুষ গ্রামের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। তাদেরও বেশির ভাগ কোনো নিয়মনীতি মানতে চাইছে না। এলাকার লোকজনের সাথে অবাধে মেলামেশা করছে। প্রশাসনের চোখের আড়ালে তারা সুযোগ পেলেই চায়ের দোকানে গিয়ে খোশগল্পে মেতে উঠছে। প্রয়োজন ছাড়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। প্রবাসীদের সাথে শহর ছেড়ে গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়া লোকজন যুক্ত হওয়ায় করোনাভাইরাস আতঙ্কে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। প্রবাসী ও শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়া লোকজনকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এলাকায় বসবাসকারী ওই মানুষগুলোর মধ্যে করোনাভাইরাস দ্রুত আঘাত হানতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নড়াইল, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, রাজবাড়ী ও কুষ্টিয়া জেলার একাধিক ব্যক্তির সাথে আলাপকালে জানা গেছে, সরকারিভাবে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পরপরই গাদাগাদি করে, গায়ের সাথে গা লাগিয়ে বাসে, লঞ্চে, ফেরিসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে শহর ছেড়ে গ্রামে ছুটে গেছে লাখ লাখ মানুষ। পথিমধ্যে অনেকেই যত্রতত্র হাঁচি-কাশি দিলেও সচেতনতার অভাবে মাস্ক পরারও প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। যে যার মতো করে ঠাসাঠাসি করে বাড়ি ফিরেছে। হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা থাকলেও তারা যত্রতত্র ঘোরাফেরা করছে। সেখানে যার ফলে গ্রামে যাওয়া ওই লোকজনের মাধ্যমে করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। দেশে ফেরত প্রবাসী ও গ্রামমুখী মানুষের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা জরুরি।

এ প্রসঙ্গে বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানার মাধবকাঠী গ্রামের বাসিন্দা ও বিশিষ্ট ব্যাংকার মো: ফারুক হোসাইন নয়া দিগন্তকে জানান, আমাদের এখানে বিদেশ ফেরত কেউ নেই। তবে কয়েক দিন আগে ঢাকা থেকে এসেছে এ সংখ্যাটা অনেক। তারা তো নিয়মনীতি মানছেই না। তাদের তো হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা, কিন্তু সেটা না মেনে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আড্ডা দিচ্ছে। তাদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তারা কায়দা মতো করোনাভাইরাস ছড়াবে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, শহর থেকে যারা গ্রামে আসছে যদি তাদের অবাধে চলাফেরার ওপর কঠোরতা আরোপ করা না যায় তাহলে গ্রামের মানুষ বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। কারণ সাধারণ ছুটির মধ্যে যারা গ্রামে এসেছে তারা তো বাসে, লঞ্চে, ফেরিতে গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে এসেছে। কে ভাইরাস বহন করছে এটা তো কেউ জানে না। ফলে এই বিষয়টার দিকে প্রশাসনের বেশি নজরদারি থাকা উচিত।

কুষ্টিয়া জেলার খোকসার বাসিন্দা ও সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো: আরিফুজ্জামান আরিফ জানান, এই এলাকায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এমন খবর পাওয়া যায়নি। তবে বিদেশ থেকে যারা এসেছে প্রথমেই তারা ধুমচে চলাফেরা করছে। ওই সময় যদি তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যেত তাহলে আমরা অনেকটা নিরাপদ থাকতে পারতাম। যদিও এখন প্রশাসন তাদের বাড়িতে লাল পতাকা টানিয়ে দিয়েছে। তাদের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করেছে। তিনি আরো বলেন, ঢাকা থেকে যারা এসেছে সুযোগ পেলেই তো তারা আড্ডা দিচ্ছে। অবাধে মেলামেশা করছে। কেউ মুখে মাস্ক পরছে, কেউ পরছে না, ফলে কার কাছে ভাইরাস আছে, কি নেই সেটা তো বোঝা যাচ্ছে না। এগুলো নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে এলাকার মানুষ ভয়াবহ বিপদে পড়ে যাবে।

সাতক্ষীরার কলারোয়ার ব্যবসায়ী মো: বিল্লাল হোসেন জানান, এলাকার লোকজন তেমন একটা সচেতন নয়। মাস্ক পরা, হ্যান্ডশেক ও কোলাকুলি না করা এসব বিষয় এখানকার অনেকেই আমলে নিতে চায় না। তবে সেনাবাহিনী এসে সচেতন করেছে, দেখে ভাল লাগছে। তিনি বলেন, যারা ঢাকা থেকে এসেছে তাদের অনেকের সাথে কথা হয়েছে, তারা হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা, কিন্তু সেটা মানছে না। রাস্তা দিয়ে অবাধে ঘুরাফেরা করছে, সবার সাথে মেলামেশা করছে। তাদের জিজ্ঞাসা করলে, তারা বলে ধুর! এতে কিছুই হবে না। ঢাকা থেকে যারা গ্রামে এসেছে এভাবে অবাধে মেলামেশা করলে তো গ্রামের মানুষের করোনা ঝুঁকি আরো বেশি। অথচ গ্রামের মানুষ তো আর করোনাভাইরাস বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে না।

চুয়াডাঙ্গা সদরের মো: সাইফুল ইসলাম জানান, কেউ কি নিয়মনীতি মানতে চায়? চায় না। যে যার মতো করে অবাধে মেলামেশা করছে। আমাদের এখানে বিদেশ থেকে যারা এসেছে তারা কয়েক মাস আগে এসেছে। তারা তো যখন যেখানে মন চায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে অনেকেই এলাকায় এসেছে। দেখা যাচ্ছে, তারা তো সুস্থ। তাই তাদের কিছু বলা যাচ্ছে না। যেমন আমাদের বাড়ির পাশে দুইজন গার্মেন্টে চাকরি করে, তারাও ছুটিতে এসেছে। সবার সাথে স্বাভাবিকভাবেই জীবন যাপন করছে। আমরা কি বুঝতে পারব তারা ভাইরাস বহন করছে? তারা যদি নিয়ম মেনে না চলে আমরা কী করতে পারি। তবে তারা যদি ভাইরাস বহন করে তাহলে আমরা সবাই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবো। সাইফুল আরো জানান, এলাকার মানুষ রাস্তাঘাটে বের হচ্ছে তারা তো না খেয়ে থাকতে পারে না। তাদের আয় না করলে সংসার চলে না। সরকার কি তাদের জন্য ব্যবস্থা করেছে? তাহলে ওই সব মানুষের তো সবখানে যেতে হয়। তারপরও সবার উচিত এই দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য সহযোগিতা করা।

খুলনার গল্লামারিতে থাকেন ব্যাংকার মো: আলম। সেখানকার অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি তো এখানে নতুন কাউকে তেমন চিনি না। তবে এখানে আগে প্রচুর যানজট হতো, সেটা আর নেই। রাস্তাঘাট ফাঁকা, সুনসান নীরবতা। অলিগলিতে যাদের দেখছি তাদের কেউ কেউ প্রশাসনের ভয়ে নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করছে। আবার অনেকেই সুযোগ পেলে চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে।

যশোর শহরে থাকেন মো: শামীম রেজা। তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। তিনি জানান, বেসরকারি কোম্পানিগুলো এখনো কাউকে ছুটি দেয়নি। মার্কেটিংয়ের কাজ করি। বিভিন্ন জায়গায় যেতে হচ্ছে। তবে আগের থেকে একটু রিলাক্স আছে। ওই এলাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, মানুষ আসলে নিয়মনীতির মধ্যে থাকতে চায় না। যা মানছে প্রশাসনের ভয়ে। প্রশাসন যতক্ষণ কড়া নজরদারি রাখছে ততক্ষণ সব কিছু ঠাণ্ডা। প্রশাসনের লোকজন সরে গেলে আবার যা, তাই।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/491587/