১৪ মার্চ ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:৪১

মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার যেন এক মারণফাঁদ

 

রাজধানীর মগবাজার-মৌচাক এলাকায় নির্মাণাধীন ফ্লাইওভার প্রকল্পটি যেন একটি মারণফাঁদ। একের পর এক প্রাণঘাতী ঘটনায় নগরবাসীর মধ্যে এই উপলব্ধি জন্মেছে যে, এটি কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নয়, ভোগান্তির প্রকল্প। নির্মাণকাজ চলাকালে দুর্ঘটনা এড়াতে সাধারণ জনগণ ও নির্মাণশ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হাইকোর্ট নির্দেশ দেয়ার পরও ঘটেই চলেছে একের পর এক দুর্ঘটনা। নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা করছে না নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ গত রোববারও ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগেও কয়েক দফায় নির্মাণশ্রমিক নিহত ও পথচারী আহতের ঘটনা ঘটে। এ দিকে দফায় দফায় সময় ও বাজেট বাড়ানোর পর শেষ হচ্ছে না ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ। এতে নাগরিক দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে।
২০১৫ সালের ৪ এপ্রিলে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নির্মাণশ্রমিক দুই সহোদর মাজেদুল (১৮) ও আসাদুল (২০) বাসচাপায় নিহত হন। একই ঘটনায় মনির ওরফে মঞ্জু (২৩) নামে আরো একজন গুরুতর আহত হন। গুলিস্তান থেকে মহাখালীগামী বেপরোয়া গতির প্রভাতী-বনশ্রী পরিবহনের একটি বাস তাদের চাপা দেয়।
এরপর গত ২০১৬ সালের ১৬ মার্চ ইস্কাটনে ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ চলাকালে লোহার তৈরি ভারী খণ্ডাংশ পড়ে ঘটনাস্থলেই ইমন নামে এক শ্রমিক মারা যান। এ ঘটনায় ২৭ মার্চ একজন আইনজীবী জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট করলে আদালত ফ্লাইওভার নির্মাণকাজ চলাকালে দুর্ঘটনা এড়াতে সাধারণ জনগণ ও নির্মাণশ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন। এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী, ডেপুটি কমিশনার ঢাকা এবং ফ্লাইওভার নির্মাণকারী তমা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে এ আদেশ দেয়া হয়।
কিন্তু এর পরও কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়নি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। ফলে এর কিছু দিন পরই একই বছরের ১৬ জুন নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের ওপর থেকে নিচে পড়ে গিয়ে সুমন (২২) নামে আরেক শ্রমিক মারা যান। এরপর সর্বশেষ গত রোববার মালিবাগ রেলগেটে গার্ডার চাপাপড়ে স্বপন নামে আরেক শ্রমিক নিহত ও দু’জন আহত হয়েছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, দীর্ঘ দিন ধরে ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ চললেও তেমন কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। প্রায় সময়ই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে বলেও দাবি তাদের।
এ দিকে দফায় দফায় সময় ও নির্মাণব্যয় বাড়ানোর পরও ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ শেষ হচ্ছে না। এতে করে নগরবাসীকে পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ। ধীরগতিতে কাজ চলার কারণে রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী, স্থানীয় এলাকাবাসী ও ফ্লাইওভারের আশপাশের ব্যবসায়ীরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন।
যানজট নিরসনে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার প্রকল্পটি ২০১১ সালের ৮ মার্চ একনেকে অনুমোদন লাভ করে। চার লেন-বিশিষ্ট ৮ দশমিক ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভারের নির্মাণব্যয় ধরা হয় ৭৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এ নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। চুক্তি অনুযায়ী দুই বছরের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্পের নকশা সংশোধন এবং নির্মাণকাজের সময়সীমা ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। কাজ শেষ না হওয়ায় আবারো জুন ২০১৭ পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। প্রথমে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১১ থেকে ডিসেম্বর ২০১৩ পর্যন্ত। পরে প্রকল্পের মেয়াদ ডিসেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। প্রথম ধাপে প্রকল্পের নির্মাণব্যয় ছিল ৩৪৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। দ্বিতীয় ধাপে তা ৭৭২ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। সর্বশেষ প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২১৮ দশমিক ৮৯ কোটি টাকা। ফ্লাইওভারের দু’টি অংশ খুলে দেয়া হয়েছে আগেই। রমনা থেকে তেজগাঁও সাত রাস্তা পর্যন্ত দুই কিলোমিটার অংশ এবং ইস্কাটন থেকে ওয়্যারলেস (মৌচাক ক্রসিং) পর্যন্ত ফ্লাইওভারে এক কিলোমিটার অংশে যানবাহন চলছে আগে থেকেই। তার পরও প্রায় সাড়ে ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভারটির কাজ এখনো বাকি ৬ কিলোমিটার।
সরেজমিন রাজারবাগ, মালিবাগ মোড়, শান্তিনগর, মৌচাক, মালিবাগ রেলগেট ও এফডিসি মোড় ঘুরে দেখা গেছে, তুলনামূলক কম শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। এক দিকে চলছে ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ, অন্য দিকে চলছে সিটি করপোরেশনের ড্রেন নির্মাণের কাজ। ফলে রাস্তা দিয়ে চলাচলের উপায় নেই। কোথাও চলছে ফ্লাইওভারের স্লোবের কাজ, আবার কোথাও আই গ্রাডার ও ভিম ঢালাইয়ের কাজ। ফ্লাইওভারের নির্মাণশ্রমিক মো: বকুল মিয়া জানান, যেভাবে কাজ চলছে তাতে আরো সময় লাগতে পারে।
এ দিকে ফ্লাইওভারের নির্মাণসামগ্রী সড়ক ও পার্শ্ববর্তী ফুটপাথে রাখার কারণে সরু হয়ে গেছে রাস্তা। রড, ভিম, ঢালাই বোর্ড, লোহার অ্যাঙ্গেল ও খুঁটি রাখার কারণে রাস্তার একপাশ থেকে আরেক পাশে পথচারীরা চলাফেরা করতে পারেন না। সরু রাস্তার কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে থাকে যানজট। খোঁড়াখুঁড়ির কারণে কিছু রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নির্মাণকাজের জন্য রাস্তায় সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় অনেক গর্ত। গর্তগুলোতে সব সময় পানি জমে থাকে। নোংরা কাদা থাকায় রিকশা-গাড়ি চলাচল তো অবশ্যই, হাঁটাও দায়। ঘটছে অহরহ দুর্ঘটনা। স্থানীয়রা জানান, পানি জমে থাকার কারণে গর্তের গভীরতা বোঝা যায় না। আবার কিছু কিছু জায়গায় এলোপাতাড়ি রড থাকার কারণে রিকশায় চলাচলকারী অনেক মানুষ উল্টে পড়ে হাত-পা ভাঙছেন। রাস্তা পারাপারের সুযোগ না থাকায় গাড়িচাপায় অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মালিবাগ মোড়ের আলিফ ওয়াচ কালেকশনের মালিক মো: সুলতান আলী জানান, মালিবাগ-মৌচাকের নাম শুনলে মানুষ এখন ভয় পান। আমাদের ক্রেতারা এখন আর এ দিকে আসেন না। তাই আমাদের বিক্রি অনেক কমেছে। অনেক কষ্ট করে চলতে হচ্ছে। ফরচুন মার্কেটের মো: রাজীব খান বলেন, মানুষের জন্য আতঙ্কের এক নাম হচ্ছে মালিবাগ-মৌচাক। বিশেষ করে শিশুদের জন্য এ এলাকা এখন হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছোট শিশুদের নিয়ে এখন আর কেউ এ এলাকায় আসেন না। আর রিকশা-গাড়ি ঠিকমতো চলে না। ধুলোবালুর কারণে এ রাস্তা দিয়ে নিয়মিত চলাচলকারী অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আশপাশের সব ক’টি মার্কেট এখন ক্রেতাশূন্যতায় ভুগছে। তাই বিক্রি কমে গেছে। আমাদের এই মার্কেটে তো এখন দিনে এক-দেড় হাজার টাকার বেশি বিক্রি হয় না। খুব কষ্ট করে জীবন যাপন করতে হচ্ছে। মৌচাক মোড়ের ঢাকা বিরিয়ানির ম্যানেজার মারফত উল্লাহ কবির বলেন, জনগণের সুবিধার জন্য যে কাজ করা হচ্ছে, সেই কাজ এখন অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলাচলের রাস্তার ওপর ঢালাই করার কারণে কত মানুষ যে আহত হয়েছেন, তার ঠিক নেই। এসবের ভয়ে এখন এই রাস্তা ভুলেই গেছেন মানুষ। অন্য জায়গা থেকে তারা সব ধরনের কেনাকাটা সেরে নেন। ফুটপাথের ব্যবসায়ী সাদ্দাম হোসেন বলেন, এটা তো উন্নয়নের কাজ হচ্ছে না। এটা আমাদের পেটে লাথি দেয়ার কাজ চলছে। কয়েক মাস ধরে ক্রেতা নেই। অনেক কষ্ট করে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে আছি। ব্যবসার পুঁজি ভেঙে ভেঙে এখন চলছি। এভাবে আর কিছু দিন চলতে থাকলে ঢাকায় থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে। বাড়ি চলে যেতে হবে। রিকশাচালক আবুল হোসেন বলেন, মৌচাক-শান্তিনগর-মালিবাগ রেলগেটের রাস্তার অবস্থা এত খারাপ যে, আমরা অনেক কষ্ট করে চলাচল করি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকি। আগের তুলনায় অনেক কম আয় হয় এখন। অভাবের সংসার আমার আয়ের ওপর চলে, কিন্তু এখন মালিককে জমা দিয়ে ২০০ টাকার বেশি থাকে না। রাস্তায় বড় গর্ত থাকায় দুই দিন পরপর আমার রিকশা নষ্ট হয়। মেরামতের জন্য বাড়তি টাকা লাগে।
মালিবাগ রেলেগেটের পাবনা স্যানিটারির মালিক দলিলুর রহমান বলেন, ধুলোবালু ও নির্মাণকাজের কারণে ব্যবসায়-বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার পথে। মৌচাক থেকে রেলগেট পর্যন্ত অনেক দোকানদার ইতোমধ্যে ব্যবসা গুটিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
এ বিষয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক সুশান্ত কুমার পাল নয়া দিগন্তকে বলেন, পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েই কাজ করা হচ্ছে। তা ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ কাজ রাতের বেলা বেশি করা হয়। তার পরও দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ফ্লাইওভারের বাকি অংশও মেয়াদের মধ্যেই চালু করার চেষ্টা হচ্ছে।
www.dailynayadiganta.com/detail/news/203455