রাজধানীতে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। বিআরটিএ যে সড়কে মোবাইল কোর্ট বসায় সে সড়কে যান চলাচল কমে যায় : নয়া দিগন্ত
১৪ মার্চ ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:৪০

পুরনো গাড়ি ধরার নামে ইঁদুর-বেড়াল খেলা: সাত দিনে ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে ২০৪ গাড়ি; অভিযানের নামে বাণিজ্যের অভিযোগ; পথচারীরা জানালেন ভোগান্তির কথা

 

২০ বছরের পুরনো বাস ধরাকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে চলছে ইঁদুর-বেড়াল খেলা। এক দিকে অভিযান চলছে, অপর দিকে ঠিকই লক্কড়ঝক্কড় গাড়িগুলো চলছে। আগে থেকেই জেনে যাচ্ছে কোন রাস্তায় অভিযান চলছে। ঠিক ওই দিন ওই রাস্তায় পুরনো গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখছেন মালিক-শ্রমিকেরা। আর এই অভিযানের মধ্যেও চলছে ক্ষমতাধরদের গাড়িগুলো। তাদের গাড়ি ধরলে তা ছেড়ে দেয়ার জন্য ফোন আসছে ওপর মহল থেকে। এতে রাস্তায় দায়িত্বরত কর্মকর্তারা গাড়িগুলো ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ দিকে যে রুটে অভিযান চলে সেই রুটে গাড়িস্বল্পতায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। কোথাও কোথাও গাড়ি আটকের নামে বাণিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে। গত এক সপ্তাহে ২০৪টি গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা বলেছেন, এই অভিযানের আগে তাদের সাথে কোনো আলাপ করা হয়নি।
রাজধানীর বাংলামোটর মোড়। গত রোববার দুপুরে সেখানে চেকপোস্ট বসিয়ে অভিযান চালায় পুলিশ। পুলিশের র্যাকারসহ বেশকিছু সরঞ্জামও দেখা গেছে সেখানে। অভিযান চলাকালে ওই রাস্তা প্রায় বাসশূন্য দেখা যায়। যে ক’টি চলাচল করছিল তার ভেতর থেকে পুলিশ দুই-চারটি থামায়। কয়েকটির কাগজপত্র চেক করে কিছু ছেড়ে দেয় আর কয়েকটি আটকে রাখে। সেখানে দায়িত্বরত এক সার্জেন্ট বলেন, তাদের ওপর যে নির্দেশনা রয়েছে সে অনুযায়ী কাজ করছে। ঘটনাস্থলে সাইফ বাবলু নামের এক পথচারী জানান, এই অভিযানের ফলে কোনো বাস পাওয়া যাচ্ছে না। যে দুই-চারটি আসছে তাও যাত্রী বোঝাই। বাবলু বলেন, সোনারগাঁও হোটেল থেকে বের হয়ে প্রেস ক্লাব যাওয়ার জন্য প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো বাস না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হাঁটা শুরু করেছেন। কামাল নামের অপর এক পথচারী জানান, বাস না থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন।
গত এক সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ ২০৪টি গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঠিয়েছে। এর মধ্যে ৬ মার্চ ৫২টি, ৯ মার্চ ৪৬টি, ১০ মার্চ ৪৪টি এবং ১২ মার্চ ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে ৬২টি বাস। ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ জানায়, এগুলো ২০ বছরের বেশি পুরনো বলেই ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, রাজধানীতে অনুমোদিত বাস সাত হাজার ৩৬২টি। তবে এর মধ্যে চলাচল করছে পাঁচ হাজার ৪০৭টি। তবে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সূত্র জানায়, চলাচলকারী বাস সাড়ে তিন হাজারের বেশি হবে না।
গত কয়েক দিন ধরেই রাজধানীতে পুরনো গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। বিশেষ করে ২০ বছরের পুরনো গাড়ি রাস্তায় যাতে চলতে না পারে সেজন্যই এই ব্যবস্থা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ঢাকা সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটি, জেলা প্রশাসন ও মহানগর পুলিশ কখনো যৌথভাবে, আবার কখনো পৃথক অভিযান চালাচ্ছে পুরনো গাড়ির বিরুদ্ধে। যেসব গাড়ির বৈধ কাগজপত্র নেই সেগুলোর বিরুদ্ধেও অভিযান চলছে। একই সাথে যেসব চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, বিআরটিএ আইন অনুযায়ী ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই তাদের বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু গাড়িচালককে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।
এ দিকে পুরনো গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হওয়ায় অনেক মালিক এখন রাস্তায় বাস নামাচ্ছেন না। বিশেষ করে যেসব এলাকায় অভিযান চলে ওই রুটের পুরনো গাড়ি ওইদিন আর রাস্তায় নামে না। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সূত্র জানায়, রাস্তায় যেসব বাস চলাচল করছে তার অনেকই ২০ বছরের পুরনো। যারা কেবল ক্ষমতাধর তারাই এসব গাড়ি রাস্তায় নামাতে সাহস পান বলে একাধিক পরিবহন ব্যবসায়ী জানান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী রুটের এক পরিবহন মালিক জানান, তার দু’টি গাড়ি আছে। র্যাকার লাগানোর ভয়ে ওই গাড়ি এখন তিনি বন্ধ রেখেছেন। ওই মালিক জানান, তারা গাড়ি বন্ধ রাখলেও ক্ষমতাসীনদের গাড়ি ঠিকই চলছে।
ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ গতকাল বলেন, এখানে কিছু জটিলতা আছে। অভিযান নিয়ে আমাদের সাথে কেউ কোনো আলাপ করেনি। তিনি বলেন, কিছু গাড়ির সমস্যা আছে। ওই সব গাড়ির বিরুদ্ধে আইনগত অ্যাকশনের সাথে কোনো দ্বিমত নেই। নাগরিকদের দুর্ভোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের তো কিছু করার নেই।’
মানুষের ভোগান্তির ব্যাপারে পরিবহন মালিক নেতা রুস্তুম আলী খান জানান, কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না করে এই অভিযানের কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। অভিযানের কারণে অনেক মালিক তাদের গাড়ি বন্ধ রেখেছেন। যে কারণে রাজধানীতে পরিবহন সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে রাজধানীতে নতুন কোনো গাড়ি নামেনি। এই অভিযানের আগে কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল নতুন গাড়ি রিপ্লেসমেন্ট করা।
বিপ্লবী সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা বলেন, স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থ হাসিলের জন্য অনেক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই অভিযানকে কেন্দ্র করে একটি মহল অর্থ উপার্জনে নেমেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি জানান, পুরনো গাড়ির কাগজপত্রতো বিআরটিএই দিয়ে থাকে। আবার এগুলোতো বছরের পর বছর পুলিশকে টাকা দিয়েই রাজধানীতে চলাচল করছে।
অপর এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এর আগেও দেখা গেছে এভাবে পুরনো গাড়ি ধরার অভিযান হয়েছে। আবার দৃশ্যত কোনো কারণ ছাড়াই সেই অভিযান শেষ হয়ে গেছে। এবারো হয়তো সেভাবে অদৃশ্য কারণে এই অভিযান কয়েক দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। এর মধ্যে যা হবে তা হলো মানুষের ভোগান্তি, আর কিছু পরিবহন মালিকের হয়রানি। ওই নেতা জানান, এর মধ্যেও বাণিজ্য চলছে। রাস্তায় দাঁড়ালেই দেখা যাবে একই অভিযোগে আটক হওয়া কোনো গাড়ি ছেড়ে দেয়া হচ্ছে, আর কোনো কোনো গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঠানো হচ্ছে।
www.dailynayadiganta.com/detail/news/203467