২২ মার্চ ২০২০, রবিবার, ১২:৫৬

হাসপাতালে করোনা আতঙ্ক: জ্বর কাশি শ্বাসকষ্টের রোগীরা সেবা-পরামর্শ পাচ্ছেন না

বেসরকারিতে এ ধরনের রোগী এলে পাঠানো হচ্ছে সরকারি হাসপাতালে * অত্যাধুনিক হাসপাতালগুলোতে করোনা সন্দেহে আসা রোগীদের পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে

করোনাভাইরাস আতঙ্কে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল এমনকি রাজধানীর অত্যাধুনিক হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকরা জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। ডাক্তার, নার্সসহ সেবা কর্মীরা রোগীর কাছে আসছেন না, কথা বলছেন না। অনেক হাসপাতালে পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) না থাকায় ডাক্তার এবং অন্য স্টাফরাও জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি রোগীদের কাছে যেতে ভয় পাচ্ছেন।

এতে মৌসুমি ফ্লুতে আক্রান্ত অথবা ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমুনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বা নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসা বা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন। রোগের বিষয়টি নিশ্চিত হতে না পারায় সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। এ নিয়ে অনেকের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

শনিবার ভুক্তভোগী অনেকে যুগান্তরে ফোন করে জানান, চিকিৎসকদের এ ধরনের আচরণ প্রত্যাশিত নয়। সরকারের উচিত রোগীদের মধ্যে যারা করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে ডাক্তারদের কাছে যাবেন তাদের পরীক্ষার আওতায় আনা। এছাড়া অত্যাধুনিক হাসপাতালগুলোতে করোনা সন্দেহে আসা রোগীদের পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। পাশাপাশি দেশের সব হাসপাতালে দ্রুত করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এটা নিশ্চিত না হলে গুজব আতঙ্ক বাড়বে।

সরেজমিন রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, মিরপুরের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, আলোক হেলথ কেয়ার, কিংস্টোন হাসপাতাল, ডা. আজমল হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে- জ্বর, সর্দি, কাশি নিয়ে কোনো রোগী এলে সরকারি হাসপাতালে রেফার করা হচ্ছে। মিরপুর ১২ নম্বর কিংস্টোন হাসপাতালের কাস্টমার কেয়ার ম্যানেজার মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, আমাদের ইমার্জেন্সি ডাক্তারদের বলা আছে জ্বর, সর্দি, কাশি ও হাঁচি নিয়ে কোনো রোগী এলে সরকারি কুর্মিটোলা হাসপাতালে যেন রেফার করা হয়। গত সপ্তাহ থেকে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

ডা. আজমল হাসপাতালের ইমার্জেন্সি চিকিৎসক ডা. রকিবুল হাসান বলেন, যদি এ ধরনের উপসর্গ নিয়ে কেউ আসেন কাউন্সেলিং করে পর্যাপ্ত মেডিসিন দিয়ে সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়। যেহেতু করোনাভাইরাস শনাক্তের কোনো ব্যবস্থা এখানে নেই তাই আমারা ঝুঁকি নিচ্ছি না।

এ প্রসঙ্গে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালের পরিচালক (কমিউনিকেশন ও বিজনেস ডেভেলপমেন্ট) ডা. সাগুফা আনোয়ার যুগান্তরকে বলেন, জ্বর, সর্দি, কাশি ইত্যাদি উপসর্গ নিয়ে আসা কোনো রোগী আমরা ফিরিয়ে দেই না। তবে এ ধরনের উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের কাছে আমরা জানতে চাই তাদের কোনো ভ্রমণর ইতিহাস আছে কিনা। অথবা তাদের পরিবারের কারও বিদেশ ভ্রমণের ইতিহাস আছে কিনা। বা সদ্য বিদেশ ফেরত কারও সংস্পর্শে এসেছেন কিনা। অবশ্য অনেকেই এসব তথ্য গোপন করতে চান। সেটাও আমরা বুঝতে পারি। যদি তাই হয় তাহলে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা তাদের হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠিয়ে দেই। আপনারা কেন পরীক্ষা করছেন না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়টি সরকার নিয়ন্ত্রিত। সরকার যদি আমাদের পরীক্ষা করার নিদের্শ দেয়া তাহলে আমার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।

জানতে চাইলে এ্যাপোলো হাসপাতালের সিনিয়র জিএম ডা. আরিফ মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, আমরা কোনো রোগী ফিরিয়ে দেই না। প্রয়োজনে যে কেউ এসে দেখে যেতে পারেন। জ্বর, সর্দি, কাশি বা করোনাভাইরাসের লক্ষণ আছে এমন রোগী পেলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে রোগীদের আমরা আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা প্রদান করছি। অথবা টেলিমেডিসিন ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও ওষুধ দেয়া হচ্ছে।

সরেজমিন রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অন্যান্য রোগীর সঙ্গে জ্বর, সর্দি-কাশি নিয়ে প্রায় ৮-১০ জন রোগী এসেছেন। তাদের মধ্যে করোনা সন্দেহে ৫ জন রোগীকে সরকার নির্ধারিত হাসপাতাল ও আইইডিসিআর এ পাঠানো হয়। ডাক্তাররা জানান, কোরোনাভাইরাস পরীক্ষা ছাড়া নিশ্চিত করা কঠিন। আমাদের কাছে করোনা পরীক্ষার কোনো কিট বা পরীক্ষাগার নেই। তাই সাধারণ রোগীদের সিভিসি রক্ত পরীক্ষা ও বুকের এক্সে-রে দেয়া হচ্ছে। অতি সন্দেহজনক রোগীদের সরকার নির্ধারিত হাসপাতাল ও আইইডিসিআরে পাঠানো হচ্ছে। ডাক্তার বা নার্সদের মুখের মাস্ক ও হ্যান্ড গ্লাভস ছাড়া ভাইরাস সংক্রমণের কোনো প্রটেকশন সরঞ্জাম নেই বলে তারা জানান।

গাবতলী থেকে আসা এক রোগী যুগান্তরকে বলেন, আমার বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এর আগেও চিকিৎসা নিয়েছিলাম। কিন্তু এবার এলে ডাক্তার আমাকে করোনা রোগী সন্দেহে না দেখেই ফেরত পাঠিয়েছেন। আমাকে ভালো হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বলেন। ডাক্তারকে বারবার বলেও বোঝাতে পারলাম না এ রোগ করোনা নয়। আমি এখন আতঙ্কের মধ্যে আছি।

জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. মনজুর উদ্দিন বলেন, করোনার ঝুঁকি এড়াতে ডাক্তার, নার্স বা স্টাফদের নিরাপত্তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সরঞ্জাম দেয়া হয়নি। সরকার থেকে শুধু হ্যান্ড গ্লাভস ও স্যানিটাইজার দিয়েছে। ভাইরাস সংক্রমণে যেসব পোশাক ও সরঞ্জাম দেয়া প্রয়োজন তা না দিয়ে সাধারণ সার্জিক্যাল সরঞ্জাম দেয়া হচ্ছে। যা ভাইরাস থেকে নিরাপদ নয়। এ প্রসঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. কেএম মামুন মোর্শেদ বলেন, আমরা সরকার থেকে যা পাচ্ছি তাই সব বিভাগের ডাক্তার, নার্স ও স্টাফদের বিতরণ করছি।

এক চিকিৎসক যুগান্তরকে জানান, আমরা আতঙ্কে আছি। আমাদেরও নিরাপত্তা নেই। প্রধান ৪টি পিপিই (পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট) যেমন গ্লাভস, এন-৯৫ মাস্ক, ক্যাপ ও গাউন আমাদের মাঝে পর্যাপ্তভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে না। তাই নিরাপত্তাহীন অবস্থায় বিভিন্ন রোগীদের চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। এসব আমাদের মাঝে সরবরাহ করলে নির্ভয়ে আমরা চিকিৎসা দিয়ে যেতে পারব।

এদিকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে কর্মরত সবাইকে ‘নিজ উদ্যোগে’ নিরাপত্তা সরঞ্জাম ও মাস্ক সংগ্রহ করে ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক। এ কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও চিকিৎসকদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোর্শেদ রশীদ স্বাক্ষরিত নোটিশে বলা হয়- ‘সংক্রমণ ঝুঁকি এড়ানোর প্রতিরোধ কর্মসূচি হিসেবে হাসপাতালে কর্মরত এবং সেবা কাজের সঙ্গে জড়িত সকলের মাস্ক ব্যবহার করা প্রয়োজন। সম্পদের স্বল্পতার জন্য হাসপাতাল থেকে সকলকে মাস্ক সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে সকলকে নিজ উদ্যোগে মাস্ক ব্যবহারের জন্য অনুরোধ করা হল।’

মিটফোর্ড হাসপাতালে কর্মরত একাধিক চিকিৎসক যুগান্তরকে বলেন, আমরা এমন একটি নোটিশ পেয়েছি। আমাদের নিজ উদ্যোগে মাস্ক সংগ্রহ করেতে বলা হয়েছে। যে ধরনের মাস্ক ব্যবহার করে হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করতে হয়, সে ধরনের মাস্ক ইচ্ছে করলেই সংগ্রহ করা যায় না। তাছাড়া এটা নিজ উদ্যোগে সংগ্রহ করার বিষয়ও নয়। আমরা দায়িত্ব পালন করছি, কিন্তু আমাদের কোনো পিপিই সরবরাহ করা হয়নি। সম্পূর্ণ অনিরাপদ অবস্থানে থেকে আমরা দায়িত্ব পালন করছি।’

মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোর্শেদ রশীদ যুগান্তরকে বলেন, ‘ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়, যারা হাসপাতালের ভেতরে রোগীদের সঙ্গে কাজ করছেন তাদের মাস্ক দেয়া হয়েছে। কিন্তু চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী যারা বাইরে কাজ করছেন তাদের কাপড়ের মাস্ক বানিয়ে অথবা কিনে নিতে বলা হয়েছে। তবে নোটিশটি দু’দিন আগের দাবি করে তিনি বলেন, এখন আমাদের স্টাফদের মাস্ক ও গাউন রয়েছে। প্রতিদিনই আমরা সেগুলো সরবরাহ করতে পারব।’

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/291558/