২২ জানুয়ারি ২০২০, বুধবার, ১২:২৬

সড়কে বেড়েছে মৃত্যু, দিনে ১৮ প্রাণহানি

যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাবে গত শনিবার এক দিনে সারাদেশে সড়কে মৃত্যু হয়েছে ২৭ জনের। আহত হয়েছেন ৪৩ জন। তার আগের দিন সড়কে নিহত হয়েছেন ১৮ জন। চলতি জানুয়ারি মাসে দিনে গড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন ১৮ জন। প্রায় সবাই বলছেন, সড়কে হঠাৎ প্রাণহানি বেড়েছে। তাদের মতে, সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার প্রধান কারণ আইন প্রয়োগে দুর্বলতা।

বহুল আলোচিত সড়ক পরিবহন আইনের প্রয়োগ খাতাকলমে গত ১৭ নভেম্বর শুরু হলেও, বাস্তবে সড়কে পুরোপুরি কার্যকর নয় আইনটি। ট্রাফিক আইন ভঙ্গে আগে মাসে গড়ে দেড় লাখের মতো মামলা হতো শুধু ঢাকা মহানগরে। এ সংখ্যা এখন হাজারের কাছাকাছি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভ্রাম্যমাণ আদালতে কমেছে মামলা জরিমানা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, আইনের দুর্বল প্রয়োগ দুর্ঘটনা বাড়ায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর আরও কিছু কারণ রয়েছে। ঘন কুয়াশা ও শীতের সকালে ফাঁকা রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোও এর অন্যতম কারণ।

সম্প্রতি পিকনিক ও বিয়ের একাধিক গাড়ি দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। সিলেট, যশোর, ঝিনাইদহে এমন ঘটনা ঘটেছে। সাইফুন নেওয়াজ বলেছেন, উৎসবের সময় সারা পৃথিবীতেই সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। অন্যান্য দেশে তা নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বাংলাদেশে তার অভাব রয়েছে। পিকনিক ও বিয়ের গাড়ি গান বাজিয়ে বেপরোয়া চলে। এতে দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপ নেই।

ঘন কুয়াশায় দুর্ঘটনা এড়াতে 'ফগ লাইট' জ্বালিয়ে গাড়ি চালাতে হয়। ফগ লাইট ঠিক না থাকলে আইনানুযায়ী জরিমানা হওয়ার কথা। গাড়ির ফিটনেস পাওয়ার কথা নয়। যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেছেন, এ জায়গায় বড় ঘাটতি রয়েছে। 'ফগ লাইট' কার্যকর নয়, এমন গাড়িও সড়কে বিনা বাধায় চলছে, দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে।

মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, যাত্রীকল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে শীতের সকালে নছিমন, করিমন, ভটিভটি, ইজিবাইকের মতো অবৈধ যানবাহনে দুর্ঘটনা ঘটছে বেশি। কারণ, ঠান্ডায় হাত অবশ হয়ে থাকায় চালক ঠিক সময়ে ব্রেক কষতে পারছেন না। এসব গাড়ির ব্রেক আছে নামকাওয়াস্তে। দুর্ঘটনা বন্ধ করতে হলে এগুলো বন্ধ করতে হবে।

সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের পর লক্কড়ঝক্কড় যেসব গাড়ি ধরা পড়ার ভয়ে রাস্তায় নামেনি, সেগুলো আবার ফিরে এসেছে- যা দুর্ঘটনার বড় কারণ। নতুন আইন কার্যকরের পর পুরোনো মোটরযান অধ্যাদেশ রহিত হয়েছে। কিন্তু নতুন আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। কারণ, সড়ক পরিবহন আইনের প্রয়োগ শুরু হলে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা ফের আন্দোলনে নামতে পারেন- এ শঙ্কাতেই আইনের দুর্বল প্রয়োগ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিআরটিএ সূত্র।

আড়াই মাসের বেশি সময় আগে আইন কার্যকর হলেও, নতুন আইনে অনলাইনে মামলা দায়েরে এখনও প্রস্তুত নয় পুলিশ। কয়েক বছর ধরে রাজধানীতে 'পজ মেশিনে' মামলা করছে পুলিশ। আইন কার্যকরের পর হাতে লেখা স্লিপের মাধ্যমে মামলা শুরু হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক সমকালকে বলেছেন, নতুন আইনে কোন ধারায় কত জরিমানা করা হবে, তার তথ্যসংবলিত সফটওয়্যার হালনাগাদের কাজ শেষ হয়েছে। গত শুক্রবার ডিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম এর উদ্বোধন করেছেন। সফরওয়্যারটি ডাটা এনালিস্টদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখন তা 'পজ মেশিনে' ইন্সটল করা হবে। কবে নাগাদ ইন্সটল শেষ করে পজ মেশিনের মাধ্যমে মামলা করা সম্ভব হবে,- এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেননি যুগ্ম কমিশনার। তিনি বলেছেন, শিগগির পজ মেশিন প্রস্তুত হয়ে যাবে।

নতুন আইন প্রয়োগে শিথিলতার স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায় মামলার পরিসংখ্যান থেকে। আইন কার্যকরের আগে ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগে গত অক্টোবর মাসে রাজধানীতে এক লাখ ৮৭ হাজার মামলা দায়ের করে ডিএমপি। জরিমানা আদায় করে সাত কোটি টাকা। আইন কার্যকরের পর নভেম্বর মাসে মামলার সংখ্যা ছিল হাজারের কম। ডিসেম্বর মাসে মামলার সংখ্যা জানায়নি পুলিশ। তবে ডিএমপি সূত্র জানিয়েছে, মামলার সংখ্যা তিন হাজারের কম।

একই অবস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। ডিসেম্বর মাসে ৭৫০টি মামলা হয়েছে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালতে। নভেম্বরে মামলা হয় ৪৪৬টি। কিন্তু অক্টোবরে মামলা হয়েছিল ১ হাজার ২৩টি। কমেছে জরিমানাও। বিআরটিএ চেয়ারম্যান ড. কামরুল আহসান বলেছেন, আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে, তবে সর্বোচ্চ জরিমানা করা হচ্ছে না। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য এ ছাড় দেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু পরিবহন খাত-সংশ্নিষ্ট প্রায় সবাই সমকালকে জানাচ্ছেন, নতুন আইনে জরিমানা করলে মালিক-শ্রমিকরা ফের আন্দোলনে নেমে সড়ক অচল করে দিতে পারেন, এ আশঙ্কায় কঠোর হচ্ছে না সরকার। অন্যদিকে পুরোনো আইন তার প্রয়োগযোগ্যতা হারিয়েছে। ফলে সড়কে বিশৃঙ্খলা বেড়েছে। আইন কার্যকরের পর প্রথম কয়েক দিন জরিমানার ভয়ে রাস্তায় গাড়ি সুশৃঙ্খলভাবে চললেও, আইনের প্রয়োগ না থাকায় আবার নৈরাজ্য ফিরে এসেছে। গাড়ির কাগজ হালনাগাদ করতেও বিআরটিএতে নেই ভিড়।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে গত বছর দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সাত বছর ঝুলে থাকার পর পাস হয় সড়ক পরিবহন আইন। এতে সড়কে আইন ভঙ্গে জরিমানা বেড়েছে ১০ থেকে হাজার গুণ। বেড়েছে কারাদণ্ডও। আইনটিকে কঠোর আখ্যা দিয়ে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা নভেম্বরের মাঝামাঝি কয়েকদিন সড়ক অচল করে রাখেন। এর পর আইনের তিনটি ধারার প্রয়োগ ৩০ জুন পর্যন্ত স্থগিত করা হয়।

জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ সমকালকে বলেছেন, যে ক'টি ভালো আইন রয়েছে, তার একটি সড়ক পরিবহন আইন। যদি প্রয়োগই না করা হয়, তাহলে এত সময় ব্যয় করে নতুন আইন করার দরকার কী ছিল? আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ না হলে, দুর্ঘটনা বাড়তেই থাকবে।

চলতি মাসের শুরুতে প্রকাশিত নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এবং যাত্রীকল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সড়কে মৃত্যু বেড়েছে। সমিতির হিসাবে ২০১৯ সালে পাঁচ হাজার ৫১৬ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন সাত হাজার ৮৫৫ জন। আহত হয়েছেন ১৩ হাজার ৩৩০। ২০১৮ সালের তুলনায় গত বছর সড়কে প্রাণহানি বেড়েছে ৮ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ।

https://samakal.com/bangladesh/article/200110401/