২২ জানুয়ারি ২০২০, বুধবার, ১২:২৫

পোস্টারে নিষিদ্ধ পলিথিন

পরিবেশ রক্ষার আইন কার্যকরহীন : ইসি নির্বিকার

পলিথিন পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ জন্য আইন করে পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেই পরিবেশ বিধ্বংসী নিষিদ্ধ পালিথিনের পোষ্টারে ছেয়ে গেছে রাজধানী ঢাকা শহর। দীর্ঘ দড়িতে ঝোলানো পোষ্টারের জন্য ফুটপাত দিয়ে চলাচল করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। যারা রাজধানী ঢাকা তথা সিটি কর্পোরেশনকে দূষণমুক্ত এবং পরিচ্ছন্ন করার অঙ্গিকার করছেন; সেই মেয়র, কমিশনার প্রার্থীরা নিজেরাই পলিথিনের পোষ্টার টানিয়ে মহানগরের পরিবেশ দূষন করছেন। ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে সব দলের মেয়র ও কমিশনার প্রার্থী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী সবার পলিথিনে মোড়ানো পোষ্টার লাগিয়েছেন। প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুয়াশায় পোষ্টার ছিঁড়ে যেতে পারে সে আশঙ্কা থেকেই পোষ্টারে পলিথিন মোড়ানো হয়েছে। কিন্তু পরিবেশবিদরা উল্টো প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের বক্তব্য যারা ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পরিবেশ বিধ্বংসী পলিথিন ব্যবহার করছেন তারা নির্বাচিত হয়ে নগরের পরিবেশের উন্নতি ঘটাবেন?

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, নগরের পরিবেশ দূষণ ও পানিবদ্ধতার জন্য প্রধানত দায়ী পলিথিন। পলিথিন পঁচতে ৫শ বছর লাগে। এটা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

পরিবেশ বিপর্যস্তের জন্য যেগুলোকে দায়ী করা হয় পলিথিন সেগুলোর অন্যতম । বিশেষ করে রাজধানীর পানিবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ এই পলিথিন। নগরীর ড্রেনেজ ব্যবস্থা পলিথিনের কারণে ভেঙ্গে পড়ে। খাল-জলাশয় ভরাট হচ্ছে, পরিচ্ছন্নতা হারাচ্ছে সড়ক-গলিপথ। সব মিলিয়ে পলিথিনের ব্যাপক ব্যবহারে মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। অথচ আসন্ন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সর্বত্র ঝুলছে পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার। পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর নিষিদ্ধ পলিথিনে মোড়ানো এসব পোস্টার যত্রতত্র পড়ে এগুলো ঢাকার পানিবদ্ধতাকে বাড়িয়ে দেবে বলে পরিবেশবিদরা মনে করেন।

ঢাকার দুই সিটিতে মেয়র বা কাউন্সিলর পদের সব প্রার্থীর প্রতিশ্রুতিতেই অগ্রাধিকার পাচ্ছে, পানিবদ্ধতা মুক্ত পরিচ্ছন্ন ঢাকা। অথচ সব প্রার্থীর প্রাচারণার প্রধান অনুসঙ্গ পোস্টার নিষিদ্ধ পলিথিনে মোড়ানো। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এসব পোস্টারে ছেয়ে গেছে নগরীর রাজপথ থেকে অলি-গলি সর্বত্র। পুরো রাজধানী জুড়েই এখন পলিথিন যে উড়ছে। অতীতের নির্বাচনগুলোয় রাজধানীর সর্বত্র পোস্টারে সয়লাব হলেও এ বছর এসব পোস্টারে বাড়তি যোগ হয়েছে পলিথিন। প্রতিটি পোস্টার পলিথিনে মুড়িয়ে সাঁটানো বা ঝোলানো হয়েছে। অথচ পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতির কথা চিন্তা করেই ২০০২ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন সংশোধন করে সরকার পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাত নিষিদ্ধ করে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল এ বিষয়ে ইনকিলাবকে বলেন, রাজধানীর পানিবদ্ধতার জন্য প্রধানত পলিথিন দায়ী। পলিথিন পঁচতে ৫০০বছর লাগে। এটা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই সরকার আইন করে এটা নিষিদ্ধ করেছে। সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে যারা প্রার্থী হয়েছেন তারা সবাই পানিবদ্ধতা মুক্ত, দূষণমুক্ত পরিছন্ন ঢাকা উপহার দেয়ার কথা বলছেন। যারা নগরীর পানিবদ্ধতা দূর করার দায়িত্ব নেবেন, তারাই যদি পানিবদ্ধতা তৈরী করে সেই নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহার করেন তাহলে নগরবাসীর হতাশ হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। ঢাকার পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি এই পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার নিষেধ বা অপসারণে নির্বাচন কমিশন একেবারেই নিরব। তিনি এসব পোস্টার দ্রæত অপসারণ এবং এগুলোকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ধংসের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি দাবি জানান। একই সাথে এখন থেকে আর কেউ যেন পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার না টানায় তারও জরুরি নির্দেশনা জারিরও দাবি করেন।

রাজধানী জুড়ে পলিথিনে মোড়ানো এসব পোস্টার পরবর্তী সময়ে ড্রেনে-নালা-নর্দমায় ঢুকে নগরীর পানিবদ্ধতা বাড়িয়ে তুলবে বলে মনে করছেন সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) বর্জ্য বিভাগের উপপ্রধান কর্মকর্তা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম বলেন, দুই সিটি কর্পোরেশন জুড়েই পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার দেখা যাচ্ছে। এগুলো পরবর্তীতে ঢাকার পানিবদ্ধতার সৃষ্টি করবে। এসব পলিথিন মোড়ানো পোস্টার এখন আমাদের অপসারণ সম্ভব নয়। এটি এখন নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার। আমরা আশা করবো এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আমরা নির্বাচনের পরে এগুলোকে পরিস্কারের সর্বাত্মক চেষ্টা করবো।

পরিবেশকর্মীরা বলছেন, যারা নগরবাসীকে পরিচ্ছন্ন ঢাকা গড়ার প্রতিশ্রæতি দিচ্ছেন, তারাই ভোটে জিততে ব্যবহার করছেন পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর নিষিদ্ধ পলিথিন। এসব পলিথিন কেবল পানিবদ্ধতাই বাড়াবে না, ড্রেনেজ সিস্টেমকে দীর্ঘমেয়াদে অকেজো করে ফেলবে। সবুজ আন্দোলন গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছে, পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার এবং অন্যান্য ডিজিটাল ব্যানার বন্ধে নির্বাচন কমিশন ও পরিবেশ অধিদপ্তর কোনরূপ ভ’মিকা নিচ্ছে না। সংগঠনটি এ বিষয়ে তাদের জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানায়।

পরিবেশ বিপর্যয়ে বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পলিথিন-মোড়া পোস্টার সাঁটানো বন্ধে সব মেয়রপ্রার্থী, পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি দিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) জাতীয় কমিটির সদস্য সৈয়দ সাইফুল আলম শোভন।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীরা অনেকেই পলিথিন মোড়ানো পোস্টার ব্যবহার করছেন। পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর পলিথিন-মোড়া এসব পোস্টার আগামী বর্ষায় ঢাকায় পানিবদ্ধতার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ঢাকাকে পানিবদ্ধতামুক্ত রাখতে, পরিবেশ রক্ষায় ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পলিথিন-মোড়ানো এসব পোস্টার ব্যবহারে প্রার্থীদের বিরত রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো।

মেয়রপ্রার্থীদের দেওয়া বাপার চিঠিতে বলা হয়, আইন অনুযায়ী পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ। আসন্ন বর্ষায় পলিথিন-মোড়া এসব পোস্টার পানিবদ্ধতার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই আপনাদের প্রতি অনুরোধ, পলিথিন-মোড়ানো পোস্টার ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।

শুধু পলিথিন মোড়ানো পোস্টার নয় আরো নানাভাবে নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘন হচ্ছে। নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী প্রচারে মাইক, লাউড স্পিকার বা উচ্চ শব্দ সৃষ্টি করে এমন কিছু ব্যবহারে নির্ধারিত সময় দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। অথচ মধ্যরাত পর্যন্ত উচ্চঃস্বরে মাইক বাজানো হচ্ছে প্রচারের নামে। বিভিন্ন অলিগলিতে নির্বাচনী ক্যাম্পগুলোতেও অহরহই বাজছে মাইক বা লাউডস্পিকারে নির্বাচনী গান।

রাজধানীর শাহজাহানপুর এলাকায় ঘুড়ি মার্কা এক কাউন্সিলরের লেমিনেট করা পোস্টার লাগাচ্ছিলেন নাজমুল নামের একজন কর্মী। তার কাছে পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার লাগানোর বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, কুয়াশায় ভিজে পোস্টার নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্যই লেমিনেট করা পোস্টার টানানো হয়। এটাতো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তিনি এ বিষয়ে বলেন, আমরা এভাবে ভেবে দেখিনি। নির্বাচন শেষে আমরা এসব নিজ দায়িত্বে সরিয়ে দেব।

https://www.dailyinqilab.com/article/262583