১৩ মার্চ ২০১৭, সোমবার, ৯:১৫

দেখা অদেখা

রাষ্ট্রকে আইন মানতে হবে

সালাহউদ্দিন বাবর

প্রথমে রাষ্ট্রকে আইন মানতে হবে এবং আইনের শাসনের প্রতি সরকারের প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এসব বিষয়ে তার বিভিন্ন বক্তব্যে গুরুত্বারোপ করেছেন। আইনজীবীদের একটি সমাবেশে তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্র যদি নৈতিকতা বজায় না রাখে তাহলে দেশে কোনো দিন শান্তি আসবে না। তাই তো আইন ও শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা। প্রথমে রাষ্ট্রকে নৈতিকতা বজায় রাখতে হবে। আমি (রাষ্ট্র) আইন মানব। আপনারা (জনগণ) আইন মানেন। আপনারা আইনে চলেন। আমি (রাষ্ট্র) আইন মানব না, আইনে চলব না। আর আমি যদি বলি, আপনারা মানেন তাহলে সেই রাষ্ট্র কোনো মতে চলবে না।’ প্রধান বিচারপতি সম্প্রতি অন্ততপক্ষে তিন দফা দেশে আইন ও আইনের শাসন সম্পর্কে বলেছেন। চট্টগ্রামে একটি মহাসম্মেলনে প্রধান বিচারপতি উল্লেখ করেছেন, ‘দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের রক্তদান সফল হবে। আমার একমাত্র আদর্শ স্বপ্ন সবার কাছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সুফল পৌঁছে দেয়া। একটি স্মরণসভায় প্রধান বিচারপতি উল্লেখ করেছেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট। তিনি বলেন, আইনজীবীরা যদি আমাদের প্রতি হাত শক্ত না করেন, আমাদের যদি সহযোগিতা না করেন তাহলে আমরা কোনো মতেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারব না। আমরা অনেক চেষ্টা করছি, বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্ট। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছি। সম্প্রতি কুমিল্লায় আইনজীবী সমিতি আয়োজিত এক সমাবেশে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেছেন, বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে। বিচারকেরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। বিচার কাজে কোনো হস্তক্ষেপ হয় না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং আইনের শাসনের প্রশ্নে আমার শরীরে এক বিন্দু রক্ত থাকতেও কারো সাথে এ বিষয়ে আপস নেই। কথাগুলো কোনো গতানুগতিক কথা নয়। প্রধান বিচারপতি আইনের মানুষ। সারা জীবন আইন ও ন্যায়নীতির চর্চা করেছেন। এ ব্যাপারে সুদীর্ঘ আইনি জীবনের অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও বিবেচনা থেকে তিনি কথাগুলো বলেছেন। এই বক্তব্য দু’টি কারণে গভীর তাৎপর্য বহন করে। প্রথমত, তার এই বক্তব্যে রয়েছে সত্যের প্রতিফলন। দ্বিতীয়ত, বক্তা স্বয়ং দেশের প্রধান বিচারপতি যাকে প্রতিদিন এসব বিষয়ের মুখোমুখি হতে হয়। এসব কথার ব্যাপারে সব মহলের উচিত এর মর্ম উপলব্ধি করা এবং সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব, এর প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করা।

প্রথমে আলোচনা করা যেতে পারে রাষ্ট্রের আইন না মানার বিষয়টি নিয়ে। রাষ্ট্র যদি স্বয়ং আইন না মানে, তবে কোন নৈতিক বলে সে অন্যদের প্রতি আইন মানার পরামর্শ দেবে বা ভূমিকা রাখবে।

আইন মানা না মানার ব্যাপারটি নিয়ে কথা বলার আগে আইন ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোচনা করা যেতে পারে। আইন আসলে কিছু বিধিমালা, যা লিখিত থাকতে পারে আবার অলিখিত হতে পারে। একটি সমাজ বা রাষ্ট্র কিছু নীতিমালা তৈরি করে, সে কিভাবে এবং কোন অধিকার বলে পরিচালিত হবে। সমাজ ও জনগোষ্ঠী সুশৃঙ্খলভাবে এবং ন্যায়-অন্যায়কে চিহ্নিত করে চলবে; তার নির্দেশনা ও সম্মিলিত সমঝোতার মাধ্যমে সমগ্র জনগোষ্ঠী তাকে বিনা দ্বিধায় মেনে চলবে। একটি দেশের ঐতিহাসিক ঘটনাবলি, মুক্তি সংগ্রাম, তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধারণ করে জনগোষ্ঠীর পরম অভিপ্রায় হিসেবে দেশের সংবিধান প্রণীত হয়। সংবিধান, দেশের সর্বোচ্চ আইন। এই আইনের সাথে অন্য কোনো সাধারণ আইন সাংঘর্ষিক হতে পারবে না। সংবিধান আইনের প্রধান উৎস। এ ছাড়া সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্তও আইনের একটি উৎস। একটি দেশের সরকার কিভাবে গঠিত হবে, তার কার্যক্রম, ক্ষমতা ও জবাবদিহিতা কী হবে, সংবিধানে তার দিকনির্দেশনা রয়েছে। শুধু সরকার বা নির্বাহী বিভাগই নয়; রাষ্ট্রের অন্য সব বিভাগের কার্যক্রম দায়িত্ব-কর্তব্য এবং ক্ষমতা কতটা তাও সংবিধানে বিধৃত থাকে। প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিবিধান তৈরি করে আইনসভা, সংসদ বা আইন বিভাগ। নির্বাহী বিভাগের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা এবং অন্যদের প্রয়োজনের আলোকে আইন বিভাগ আইন প্রণয়ন করে থাকে।

প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্র কিভাবে আইন মান্য করবে। কেননা রাষ্ট্র তো বায়বীয় বিষয়। তাহলে কী করে আইন মান্য করবে। আসলে কথাটার মজ্জাগত অর্থ বুঝতে হবে। রাষ্ট্রের প্রধানত তিনটি অঙ্গ রয়েছেÑ নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। তবে আরো ক্ষেত্র রয়েছে, যা রাষ্ট্রের চোখ হিসেবে কাজ করে। যেমনÑ গণমাধ্যম। তাদের সম্মিলিত প্রয়াসই হচ্ছে রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড। তবে রাষ্ট্রের প্রধান বিভাগটি হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ। মূলত তাদের কার্যক্রমই রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে প্রমাণ করে। অন্য যে বিভাগগুলো রয়েছে সেগুলোও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকে। আর তাত্ত্বিকভাবে রাষ্ট্রের বিভাগগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং স্বাধীন। কেউ কারো কাজে হস্তক্ষেপ করে না।

প্রধান বিচারপতি তার বক্তব্যে বলেছেন, রাষ্ট্রকে আইন মানতে হবে। এর সাধারণ অর্থ দাঁড়ায়, রাষ্ট্রের বিভাগগুলো এখন যথাযথভাবে আইন মানার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে না। রাষ্ট্রের প্রধান অঙ্গ যেহেতু নির্বাহী বিভাগ, তাই তাকে নিয়েই প্রথমে আলোচনা করা যেতে পারে। আগেই উল্লেখ করা যেতে পারেÑ নির্বাহী বিভাগের গুরুত্ব বেশি। তাই তাদের কাজের পরিধি বি¯ৃÍত এবং তাদেরই আইন মানা না মানার প্রশ্নটিও বড়। নির্বাহী বিভাগের কাজের পরিধি তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত। সে জন্য তাদের একটি ‘আগ্রাসী’ ভূমিকা থাকে এবং ক্ষমতাও যেহেতু বেশি, তাই আইন অমান্য করার প্রবণতাও তাদের বেশি। আইন মানা এবং আইন অমান্যকারীদের ধরে বিচার বিভাগের কাছে সোপর্দ করার দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগের। তবে নির্বাহী বিভাগের বিরুদ্ধে আইনের বিপরীতে চলার বহু অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে, ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে এমন অভিযোগ অনেক যে, নির্বাহী বিভাগ তাদের সাথে আইনানুগ ব্যবহার করে না। ফলে সংবিধানে তাদের যে অধিকার সন্নিবেশিত রয়েছে তা তারা ভোগ করতে পারে না। অথচ নির্বাহী বিভাগ যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন তারা সংবিধান সংরক্ষণ এবং আইনানুগভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার অঙ্গীকার করে। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, এই অঙ্গীকারের প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল থাকে না। জনগণকে যথাযথ সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক অনিয়ম। গাফিলতিও লক্ষ করা যায়।

আইন অমান্য করার আরো বহু ক্ষেত্র রয়েছে। সরকারের দায়িত্ব প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি আইনানুগ আচরণ। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এর ব্যত্যয় লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা। তাদের পদায়ন করা ও পদোন্নতি দেয়া উচিত দক্ষতা ও যোগ্যতার মাপকাঠিতে। কিন্তু এই নীতিও মানা হচ্ছে না। রাজনৈতিক বিবেচনা এবং আনুগত্যের মাপকাঠিতেই এখন পদায়ন ও পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। এতে বহু কর্মকর্তা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। দক্ষতা ও যোগ্যতা এবং জ্যেষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সরকার আইনানুগভাবে কাজ করতে দিচ্ছে না। এসব বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ এসব বাহিনীর দায়িত্ব হলো, প্রজাতন্ত্রের প্রতিটি মানুষের সমভাবে জানমালের নিরাপত্তা বিধান। এসব বাহিনীর সদস্যরা যেহেতু সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে তাদের কাজের জন্য, তাই তারা বহু ক্ষেত্রে আইন পালন করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে থাকে। অথচ এর কোনো বিহিত হয় না। আইন এখানে অসহায়।

আইন নিজেদের হাতে তুলে নেয়া আইন অমান্যের শামিল। এই ঘটনা দেশে অহরহ ঘটছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের সহযোগী বিভিন্ন সংগঠন সারা দেশে আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। নিজেদের মধ্যে এবং প্রতিপক্ষ সংগঠনের বিরুদ্ধে তারা হাঙ্গামা করে থাকে। এদের কর্মকাণ্ডে মানুষ নিহত পর্যন্ত হচ্ছে। আর এসব হাঙ্গামা ঘটছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্মুখে। কিন্তু তারা তার কোনো প্রতিবিধান করে না, বরং নীরব ভূমিকা পালন করে থাকে। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলেও সরকার কোনো প্রতিবিধান করে না। সরকারের সহযোগী সংগঠনের কর্মীরা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বেআইনিভাবে অরাজকতা সৃষ্টি করছে।

রাষ্ট্রের আরেকটি বিভাগ হচ্ছে আইন প্রণয়ন বিভাগ। এই বিভাগের দায়িত্ব, রাষ্ট্রের জনগণের জন্য বিধান তৈরি করা। কিন্তু বর্তমানে এই বিভাগের গঠনপ্রক্রিয়া নিয়ে রয়েছে ঘোরতর আপত্তি। জনগণের সরাসরি ভোটে আইন প্রণয়ন বিভাগের, অর্থাৎ সংসদের সদস্যরা নির্বাচিত হয়ে থাকেন। এটাই সংবিধানের নির্দেশনা, তথা আইন। কিন্তু এই নির্দেশ মোতাবেক এই বিভাগের সদস্যরা নির্বাচিত হননি। বহু বিতর্কিত একটি ভোটারবিহীন জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে এই সংসদ গঠিত হয়েছে। সংসদের প্রধান কাজ আইন প্রণয়ন করা হলেও তাদের আরেকটি মৌলিক কাজ হচ্ছে সরকার যথানিয়মে ও আইনানুগ পথে চলছে কি না তা দেখা এবং তাদের কাছে সরকারের জবাবদিহি করা। কিন্তু সে কাজটি এই সংসদ করতে পারছে না বিধায় তারা আইনানুগভাবে চলছে না। ভোটারবিহীন নির্বাচনে এই সংসদ গঠিত হয়েছে এবং সরকারের বিরোধী পক্ষ এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ফলে এ সংসদ গঠিত হয়েছে কার্যত একটিমাত্র দলের লোকদের নিয়ে। নিজেরা নিজেদের জবাবদিহি করবে কিভাবে? এতে সংসদ প্রকৃত দায়িত্বগুলো পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। একটি সংসদ যদি স্বয়ং বিতর্কিত হয়ে যায় তবে তারা কিভাবে জনকল্যাণে কাজ করবে? জনগণের কাছ থেকে তারা যেমন কোনো ম্যান্ডেট পায়নি তেমনি জনগণের প্রতিও তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই।

এবার কথা হতে পারে রাষ্ট্রের অপর স্তম্ভতুল্য, বিচার বিভাগ নিয়ে। এই বিভাগের গুরুত্ব ও দায়িত্ব অনেকটা অভিভাবকের মতো। জনগণের অধিকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তারাই শেষ ভরসা। সংবিধান সংরক্ষণ এবং সংবিধানের ব্যাখ্যা করে থাকে বিচার বিভাগ। উচ্চ আদালতের বহু রায় আইনের সমমর্যাদা পেয়ে থাকে। আইনের আলোকে বিচার বিভাগ বিভিন্ন ধরনের মামলার বিচার করে থাকে। কোথাও আইনের ব্যত্যয় ঘটলে বিচার বিভাগ তা দেখে প্রতিবিধান করে। কিন্তু বিচার বিভাগ বহু ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের তোপের মুখে পড়ে। বিচার বিভাগকে যে স্বাধীনতা সংবিধান নিশ্চিত করেছে, তার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো অন্যান্য বিভাগের দায়িত্ব। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে এই স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা চালায় নির্বাহী বিভাগ। নি¤œ আদালতে এই হস্তক্ষেপ বন্ধের জন্য উচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। সমাজে শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য বিচার বিভাগের দায়িত্ব অপরিসীম।

সংবিধানে গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের একটি বিভাগ হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া না হলেও রাষ্ট্রে বিভিন্ন বিভাগে গণমাধ্যমের প্রয়োজন রয়েছে। গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চোখ এবং কান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। সংবিধান গণমাধ্যমকে আইনের অধীনে স্বাধীনতা দিয়েছে। জাতির অগ্রগতি অবক্ষয় এবং জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা-বঞ্চনা গণমাধ্যম তুলে ধরে। গণমাধ্যম জাতির ইতিহাসকে নীরবে ধারণ করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতের ইতিহাস রচনাকারীদের যত প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে যাচ্ছে। সংবিধান গণমাধ্যমকে স্বাধীনতা দিয়েছে বটে, কিন্তু প্রশাসন তথা সরকার মাঝে মধ্যেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে থাকে। শুধু সরকারই নয়, অন্যান্য প্রভাবশালী মহল সাংবাদিকদের লেখার স্বাধীনতায় চাপ সৃষ্টি করে। বহু সাংবাদিক বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দায়িত্ব পালনকালে বহু সাংবাদিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ক্ষমতাসীনদের হাতে নিগৃহীত হন। কখনো কখনো হাঙ্গামায় সাংবাদিকেরা নিহতও হন। এ তো গেল এক দিক, এর ভিন্ন দিকও রয়েছে। সংবাদপত্র অনেক সময় ভুলে যায় যে, তাদের স্বাধীনতা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সংবাদপত্রের অপছন্দের ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে ভুল তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন রচনা করা হয়। কখনো কখনো চরিত্র হনন এবং মানহানিমূলক প্রতিবেদনও তৈরি করা হয়। এমনকি ব্যক্তি ও সংগঠনের বিরুদ্ধে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-এর ঘটনাও ঘটে। এই দায়িত্বহীনতার কারণে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকেরা জনগণের আস্থা ও শ্রদ্ধা হারান। এতে আইন অমান্য হয়। এবার আমরা আইনের শাসনের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে পারি। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সম্প্রতি অন্তত তিন দফা এ নিয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কোনো আপস নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নিরলস চেষ্টা করছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কথায় কথায় বলে থাকেন, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বুদ্ধিজীবী ও সুশীলসমাজের সদস্যরা বলেন, দেশে আইনের শাসন নেই। আইনের শাসন রাষ্ট্র পরিচালনার একটি নীতিবিশেষ, যেখানে সরকারের সব কার্যক্রম আইনের অধীনে পরিচালিত হয় এবং যেখানে আইনের স্থান সব কিছুর ঊর্ধ্বে। সহজ করে বলা যায়, আইনের শাসনের অর্থ এই যে, রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার সব সময় আইন অনুযায়ী কাজ করবে। ফলে রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিকের কোনো অধিকার লঙ্ঘিত হলে সে তার প্রতিকার পাবে। দেশের একজন নাগরিক সব সময় আইনের ছত্রছায়ায় থাকবে। রাষ্ট্র যেসব অধিকার তার জন্য নির্ধারিত করেছে, সে বিনা বাধায় তা ভোগ করবে। আইনের শাসন ততক্ষণ পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে, যতক্ষণ সরকারের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অনুশীলন সাধারণ আদালতে পর্যালোচনাধীন থাকে। আর আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার অধিকার সব নাগরিকের সমান।

১৯৭২ সালের সংবিধানে নাগরিক অধিকারগুলো বিধৃত রয়েছে। সমমর্যাদা ও সুযোগ লাভ ধর্ম পালনের অধিকারের সমতা; আইনের দৃষ্টিতে প্রত্যেক নাগরিকের সমতা, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও বাঁচার অধিকার অযৌক্তিক গ্রেফতার বা আটক, বিচার, দণ্ড থেকে সুরক্ষা, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার, সংগঠন করার এবং মত প্রকাশের অধিকারÑ এসব অধিকার ভোগ করার ক্ষেত্রে যদি কোনো প্রকার বাধা আসে সরকার কিংবা কোনো মহল থেকে, তাহলে তা হবে আইনের পরিপন্থী। আইনসঙ্গত ভিত্তি ছাড়া কোনো নাগরিককে আটক রাখা যাবে না। তার আইনি পরামর্শ লাভের অধিকার বা আইনজীবী দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার নাকচ করা যাবে না। তাকে গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে এবং আদালতের আদেশ ছাড়া তাকে অধিক সময় আটক রাখা যাবে না। কিন্তু লক্ষ করা যায়, সরকারের প্রশাসন বহু ক্ষেত্রেই উল্লিখিত বিধিবিধান লঙ্ঘন করে থাকে, যা আইনের শাসনের পরিপন্থী।

আইনের শাসনের মূল বিষয়, আইনের প্রাধান্য। আইন ভঙ্গ করা ছাড়া কাউকে শাস্তি দেয়া যাবে না। কেউ আইন ভঙ্গ করেছে বলে অভিযুক্ত হলে সাধারণ আদালতে প্রমাণিত হতে হবে। স্বৈরাচারী শাসকের স্বেচ্ছাচারিতার বিপরীতে আইনের শাসন একটি রক্ষাকবচ। আইন হতে হবে পরিষ্কার, মানুষ যাতে সহজে বুঝতে পারে। আইনের আশ্রয় যাতে সবাই সহজে পেতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। আদালতে সবাই যেতে পারবে। বিচার বিভাগ থাকবে নির্বাহী বিভাগ বা অন্য যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন। বিচার হতে হবে প্রকাশ্য। আমাদের দেশে আইনের শাসনের একটি প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে শাসক শ্রেণী ও প্রভাবশালী মহল অন্যায় করে তা থেকে পার পেয়ে যাওয়া। এখানে একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। শাসকদলের অঙ্গ ছাত্রসংগঠন বেআইনিভাবে অস্ত্রশস্ত্র বহন করে এবং তা ব্যবহারও করে। তাতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। এমন পরিস্থিতি অহরহ ঘটছে। তবুও তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। তাদের অন্যায়ের কোনো বিচার এবং প্রতিবিধান হয় না। এমনটি আইনের শাসনের পরিপন্থী। সাম্প্রতিককালের আরেকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, যেখানে আইনের শাসনের ব্যত্যয় ঘটেছে। নির্বাহী বিভাগের অবহেলায় বহু মানুষ বিনা বিচারে কারাগারে বছরের পর বছর ধরে আটক রয়েছে। তাদের কোনো পরিত্রাণ নেই। উচ্চ আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে তাদের হাজির করে জামিন মঞ্জুর করে থাকেন। এতগুলো বছর তাদের জন্য আইনের শাসন কোথায় ছিল? নির্বাহী বিভাগ কি এর জবাব দিতে পারবে?

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/203121