১২ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ১০:০৪

গরুর মাংস খাওয়া ছাড়তেই হচ্ছে!

মাংসের টুকরা আরও ছোট হয়েছে, কিন্তু দাম বেড়েছে। এ কারণে রাজধানীর রেস্তোরাঁয় গরুর মাংস ভুনা, তেহারি অথবা শিককাবাবের মতো পদগুলোর বিক্রি কম। এর সরাসরি ভুক্তভোগীদের একজন কারওয়ান বাজারের মাংস ব্যবসায়ী আবদুল মতিন। খাবারের দোকানগুলো আগে তাঁর দোকান থেকে দিনে ৬০০ থেকে ৭০০ কেজি মাংস কিনে নিত। এখন সেটা অর্ধেকে নেমেছে।

কারওয়ান বাজারে আছে প্রায় কুড়িটি মাংসের দোকান। এর পাঁচ-ছয়টি বাদে বাকিগুলো এখন বন্ধই থাকে। রাজধানীর অন্যান্য বাজারের চিত্রও মোটামুটি একই রকম। মাংসের বাজারে এ ধসের কারণ মূল্যবৃদ্ধি। বেশি দিন আগের কথা নয়, ২০১৪ সালেও প্রতি কেজি গরুর মাংসের জাতীয় গড় দাম ছিল ২৭৫ টাকা। এখন সেই মাংস কিনতে গেলে গুনতে হবে কেজিপ্রতি ৪৮০ থেকে ৫২০ টাকা। সম্প্রতি এক লাফে দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি প্রায় ৪০ টাকা।

৫০০ টাকা রাজধানীর রিকশাচালক কিংবা হকারদের এক দিনের আয়ের সমান। গরুর মাংস অনেক আগেই তাঁদের নাগালছাড়া হয়েছে। সীমিত আয়ের পরিবারগুলোরও এখন আর নিত্যদিন গরুর মাংস কেনার সামর্থ্য নেই। অনেক পরিবারে এখন গরুর মাংস কেনা হয় কেবল অতিথি এলে। ভবিষ্যতে হয়তো অতিথি এলেও তাদের পক্ষে গরুর মাংস কেনা কঠিন হবে। কারণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, গরুর মাংসের এখনকার দাম তো কমবেই না, বরং বাড়তে পারে।

মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এখন যে দামে বিক্রি হয় তাতেও মাংস ব্যবসায়ীদের লোকসান হয়। লোকসানের কারণে বাজারের ৫০ শতাংশ মাংসের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। গরুর মাংসের দাম বাড়ার জন্য তিনি গরুর দাম বাড়া, গাবতলী গরুর হাটে অবৈধ হারে খাজনা আদায়, চাঁদাবাজি ও চামড়ার দাম কমে যাওয়াকে দায়ী করেন।

গরুর মাংসের সঙ্গে বেড়েছে খাসি ও ছাগলের মাংসের দামও। আসল খাসি এখন কেজিপ্রতি ৮০০ টাকার নিচে কেনা যাচ্ছে না। অন্যদিকে ছাগল ও ভেড়ার মাংস বিকোচ্ছে কেজিপ্রতি ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা দরে, যা আগে কেজিপ্রতি ৫০-১০০ টাকা কম ছিল।

গরুর মাংস কিনতে না পেরে নিম্ন আয়ের মানুষেরা গরুর মাথার মাংস কিনতেন। সেই মাথার মাংসের কেজিও এখন ৩২০ টাকায় উঠেছে, যা বছর দু-এক আগেও ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা ছিল। গরুর ভুঁড়ির দাম বেড়ে হয়েছে কেজিপ্রতি ২০০-২২০ টাকা, যা ছিল ৮০-১০০ টাকা। একটি মগজ এখন আর ২০০ টাকার কমে কেনা যাচ্ছে না, যা মাস ছয়েক আগেও ১২০-১৫০ টাকায় কেনা যেত।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১১ সালে গরুর মাংসের জাতীয় গড় দাম ছিল কেজিপ্রতি ২৫৯ টাকা। পরের দুই বছর তা কেজিপ্রতি ২৬৩ ও ২৭০ টাকা ছিল। দাম লাফ দেয় ২০১৫ সালে, ওই বছর গড় দাম দাঁড়ায় কেজিপ্রতি ৩৪৪ টাকায়। বৃদ্ধির এ কারণ ভারত থেকে গরুর সরবরাহ কমে যাওয়া। ভারতে নরেন্দ্র মোদী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৫ সালের এপ্রিলে দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং সে দেশের সীমান্তরক্ষীদের উদ্দেশে বাংলাদেশে গরু ঢোকা পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে বলেন। এরপর থেকেই ধাপে ধাপে মাংসের দাম বেড়েছে। তবে মাংস ব্যবসায়ীদের দাবি, এর সঙ্গে দেশীয় কিছু কারণও আছে। তাঁরা গরুর হাটের খাজনার নামে চাঁদাবাজি বন্ধসহ চার দফা দাবিতে ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ দিনের ধর্মঘট পালন করেন। ধর্মঘট শেষ হওয়ার পর দাম কেজিতে ৩০-৪০ টাকা বেড়ে যায়।

মাংসের দামের এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কয়েকটি উপায় দেখছেন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি বৈঠকে বসতে পারে। এ ছাড়া বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার পরামর্শ দেন তিনি।

ক্যাব সভাপতি মনে করেন, ভোক্তাদের পক্ষ থেকে একটি প্রতিরোধ গড়ে ওঠা দরকার। মানুষ গরুর মাংস কেনা কমিয়ে দিলেই ব্যবসায়ীরা দাম কমাতে বাধ্য হবেন। দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে তিনি দেশে গরু পালন বৃদ্ধির ওপর জোর দেন।
মাংস ব্যবসায়ী সমিতির রবিউল আলম বলেন, ‘মাংসের দাম ৩০০ টাকায় নামিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য আমাদের কিছু প্রস্তাব আছে। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন কেউ আমাদের কথা শুনছে না।’ তিনি বলেন, ‘চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায় গাবতলী গরুর হাটে অবস্থিত আমাদের কার্যালয়টিতেও তালা মেরে দিয়েছে একটি সিন্ডিকেট।’

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1105291