১২ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ৯:৪৯

সরেজমিন

খাগড়াছড়ির মানুষ চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ

পাহাড়ি-বাঙালিনির্বিশেষে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির সব শ্রেণি-পেশার মানুষ চাঁদাবাজির কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। যাঁদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ, তাঁরাও পাহাড়ি-বাঙালিনির্বিশেষে কয়েকটি আঞ্চলিক দল ও সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।

খাগড়াছড়ির কয়েকটি এলাকা ঘুরে ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে কৃষিজীবী থেকে চাকরিজীবী, শ্রমজীবী থেকে ব্যবসায়ী—সবাইকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদা দিয়ে যেতে হচ্ছে বছরের পর বছর।

খাগড়াছড়ির পানছড়ি, দীঘিনালা ও সদরের কয়েকটি এলাকায় নানা শ্রেণি-পেশার অন্তত অর্ধশত ব্যক্তি তাঁদের ওপর চাঁদাবাজির চাপ সম্পর্কে প্রথম আলোকে জানান। একজন পরিবহন ব্যবসায়ী বলেন, চাঁদা দিতে কখনো একটু দেরি হলেই যানবাহন আটকে রাখা থেকে জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা পর্যন্ত ঘটে। কিছুদিন আগে একই কারণে একটি ট্রাক জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।

কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, কিছুদিন আগে খাগড়াছড়ির একটি বাড়ি থেকে চাঁদার ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার হওয়ার পর তাঁদের কাছে পরোক্ষ সূত্রে খবর আসছে যে এখন এক কোটি টাকা চাঁদা তুলে দিতে হবে। কৃষিজীবীরা তাঁদের চাষাবাদের ফল, ফসল, সবজি, হাঁস-মুরগি বিক্রি করলেও নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিতে হয়।

খাগড়াছড়ি জেলায় এই চাঁদা নেয় আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা), বাঙালি ছাত্র পরিষদের দুই গ্রুপ এবং সীমিত পরিসরে জাতীয় জনসংহতি সমিতি।

খাগড়াছড়িতে সবচেয়ে বড় আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ। ছাত্র, যুব, নারী সংগঠনসহ এই দলের শাখা-প্রশাখা প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। চাঁদা নেওয়ার অভিযোগও তাদের সম্পর্কেই সবচেয়ে বেশি। তারা চাকরিজীবীদের কাছ থেকে মাসিক ভিত্তিতে চাঁদা নেয়। কৃষিজীবীদের কাছ থেকে মৌসুম ভিত্তিতে এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় চাঁদা সংগ্রহ করে। চাঁদার অর্থ দিয়ে দল পরিচালনা করা হয়। এর মধ্যে দলের কর্মসূচি পালন, দলের সার্বক্ষণিক নেতা-কর্মীদের ভাতা প্রদান, বিভিন্ন কেনাকাটা প্রভৃতি সব খরচই অন্তর্ভুক্ত। অভিযোগ হচ্ছে,Ñএই চাঁদার হার অত্যধিক।
এ বিষয়ে জানার জন্য যোগাযোগ করা হলে ইউপিডিএফের দুজন নেতা প্রথম আলোর সঙ্গে মুখোমুখি বসে কথা বলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই নেতারা বলেন, দেশের সব রাজনৈতিক দল চাঁদা তুলে দল পরিচালনা করে। তাঁরাও দল পরিচালনার জন্য জনগণের কাছ থেকে চাঁদা নেন। তবে এ জন্য তাঁরা কোনো জোর-জুলুম করেন না। বরং জনগণের নিরাপত্তা বিধানে কাজ করেন। চাঁদার একটি পয়সাও দলের কোনো নেতা-কর্মীর ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যয় করা হয় না। এমন কোনো প্রমাণ কেউ দিতে পারলে তাঁরা প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবেন।

এই নেতারা বলেন, ব্যবসায়ীদেরও তাঁরা সহায়তা করেন, নিরাপত্তা দেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন ব্যবসায়ী এক লাখ টাকা মুনাফা করলে হয়তো পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দেন। কিন্তু ইউপিডিএফ নিরাপত্তা না দিলে হয়তো দেখা যাবে, তিনি ওই ব্যবসাটাই করতে পারবেন না। তাই ব্যবসায়ীরা স্বেচ্ছায় তাঁদের চাঁদা দেন। কৃষিজীবী, শ্রমজীবীরাও তা-ই।

চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে অন্যতম আঞ্চলিক দল জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) সম্পর্কেও। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এই দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা সুধাসিন্ধু খীসা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সব চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে যাবে, যদি প্রশাসন ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করা বন্ধ করে।

পানছড়ি শহরতলীর বাসিন্দা ইকরাম (ছদ্মনাম) বছরখানেক আগেও দিনমজুরি করতেন। এখন বাঙালি ছাত্র পরিষদের চাঁদা তুলে দেওয়ার কাজ নিয়েছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এই কাজে পরিশ্রম কম, আয় বেশি। চাঁদা কাদের কাছে চাওয়া হয়েছে, কে কত দেবেন, তা তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়। তিনি নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে সেটা তুলে নেতাদের কাছে পৌঁছে দেন। এই তাঁর কাজ।

খাগড়াছড়ি শহরেও এই পেশার লোক আছেন। আছেন বিভিন্ন উপজেলা শহরে, শহরতলী এবং গ্রামেও। একাধিক অসমর্থিত সূত্র বলেন, বাঙালি ছাত্র পরিষদের¯স্রষ্টা ও পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন খাগড়াছড়ির পৌর মেয়র রফিকুল আলম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নই, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ সৃষ্টি করেছে প্রশাসন, তাদের স্বার্থে। এরাও চাঁদাবাজ। এই সংগঠনের মধ্যে দুটি গ্রুপও সৃষ্টি করেছে প্রশাসন, যাতে প্রয়োজন হলে এই দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি করে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল দেখানো যায়।’

বাঙালি ছাত্র পরিষদের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের দুটি গ্রুপেরই স্থায়ী উপদেষ্টা একজন। এ ছাড়া আরও চারজন বিভিন্ন সময় তাঁদের উপদেশ-পরামর্শ দিয়ে থাকেন। নাম প্রকাশ না করে তাঁরা বলেন, এই চারজনই খাগড়াছড়ির সবার পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।

চাঁদাবাজি বন্ধ করতে প্রশাসনের ভূমিকা জানার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করে জানা গেছে, এ ব্যাপারে প্রশাসনের কোনো কার্যক্রম নেই। তবে তাঁরা গণমাধ্যমকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে চাঁদাবাজির ব্যাপকতা সম্পর্কে জানাশোনা অনেক কথা বলে থাকেন।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1105303