চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের ধুমঘাট এলাকায় রেলওয়ের জায়গায় তৈরি করা কারখানা। গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রীর ছেলে অনুমতি না নিয়ে এই কারখানা গড়ে তুলেছেন।
১২ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ৯:৪২

চট্টগ্রামের মিরসরাই

প্রভাব খাটিয়ে রেলের জমিতে মন্ত্রিপুত্রের কারখানা!

চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ধুমঘাট এলাকায় রেলওয়ের কাছ থেকে এক ব্যক্তির ইজারা নেওয়া জমিতে প্রভাব খাটিয়ে কারখানা গড়ে তুলেছেন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের ছেলে মাহবুব উর রহমান। যেখানে কারখানাটি (সিমেন্ট-বালুর তৈরি ব্লক বা একধরনের ইট) স্থাপন করা হয়েছে, তা কৃষিজমি হিসেবে ব্যবহারের জন্য ইজারা নেন ওই ব্যক্তি। জমি ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে লাইসেন্স শব্দটি ব্যবহার করে রেলওয়ে।

ধুমঘাটে দুটি রেলসেতু (ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ) রয়েছে। সেতুর নিরাপত্তার স্বার্থে সেখানে কোনো স্থাপনা নির্মাণ না করতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও তা আমলে নিচ্ছেন না মন্ত্রিপুত্র। মিরসরাই গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের নির্বাচনী এলাকা।

রেলওয়ের ওই জমির ইজারাদার মিরসরাই উপজেলার হিঙ্গুলী ইউনিয়নের আজমনগর গ্রামের ব্যবসায়ী একরামুল হক। ২০০৭ সালে তিনি রেলওয়ের ভূসম্পত্তি বিভাগের কাছ থেকে ওই জায়গা ইজারা নেন। এই ইজারা প্রতিবছর নবায়নযোগ্য।
একরামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, রেলের সব শর্ত মেনে তিনি ওই জায়গা ব্যবহার করে আসছেন। তাঁর ইজারা বাতিল হয়নি। জমির খাজনা হালনাগাদ রয়েছে। এরপরও সেখানে কারখানা নির্মাণ করা হয়েছে। বিষয়টি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন তিনি।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, মাহবুব উর রহমানের প্রতিষ্ঠান গ্যাসমিন লিমিটেড গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ফেনী নদীসংলগ্ন হিঙ্গুলী মৌজার প্রায় পৌনে চার একর জায়গা দীর্ঘমেয়াদি ইজারা নিতে রেলপথমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেন। আবেদনপত্রে সেখানে সিমেন্ট-বালুর ব্লক তৈরির শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। কারখানা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র আমদানির উদ্যোগ নিয়েছেন বলেও আবেদনে উল্লেখ করেন।

মন্ত্রিপুত্রের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রেলওয়ে ভূসম্পত্তি বিভাগের সহকারী ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা ওই এলাকা পরিদর্শন করেন। এরপর মাহবুব উর রহমানকে গত ২৬ ডিসেম্বর পাল্টা চিঠি দেয় বিভাগীয় ভূসম্পত্তি বিভাগ।

চিঠিতে বলা হয়, ‘আপনি রেলওয়ের মালিকানাধীন পশ্চিম হিঙ্গুলী মৌজায় ৬ হাজার ৪৮৯ বর্গফুট সেমিপাকা এবং ৯৯০ বর্গফুট পাকা দ্বিতল ভবন নির্মাণের কাজ অব্যাহত রেখেছেন। সহকারী ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা গত ২০ ডিসেম্বর সরেজমিন তদন্তকালে এই নির্মাণকাজ বন্ধ রাখতে আপনার প্রতিনিধিকে অনুরোধ করেছেন। আপনার আবেদনের বিষয়টি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় এ-জাতীয় নির্মাণকাজ আইনানুগ নয় বিধায় অবিলম্বে অবৈধ নির্মাণকাজ বন্ধ এবং ইতিমধ্যে নির্মিত ইমারতাদি অপসারণ করার জন্য আপনাকে নির্দেশ দেওয়া হলো।’

নোটিশ পাওয়ার (চিঠির) সাত দিনের মধ্যে মাহবুব উর রহমানকে দখল ছেড়ে দিয়ে অবৈধ স্থাপনা নিজ উদ্যোগে ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয় ভূসম্পত্তি বিভাগ। তা না হলে উচ্ছেদের পর সব স্থাপনা বাজেয়াপ্ত করে নিলামে বিক্রি করার পাশাপাশি কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, ভূসম্পত্তি বিভাগের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে মাহবুব উর রহমান গত ১ জানুয়ারি রেলপথমন্ত্রীর কাছে আরেকটি আবেদন করেন। ওই আবেদনপত্রে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রীর সুপারিশ ছিল। ওই আবেদনে বলা হয়, বিশ্বস্ত সূত্রে তিনি (মাহবুব) জানতে পেরেছেন যে ধুমঘাট সেতুসংলগ্ন ১৭২ শতক (১ একর ৭২ শতক) জমি কৃষিকাজের জন্য একরামুল হক নামের এক ব্যক্তি ইজারা নিয়েছেন। কৃষিকাজের পরিবর্তে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্য লাইসেন্স (ইজারা) দিলে রেলের বছরে ৫ লাখ ৬২ হাজার টাকা আয় হবে। অন্যদিকে কৃষি লাইসেন্স দেওয়ার ফলে রেলের বছরে আয় হয় ৫ হাজার ১৬০ টাকা।

চিঠিতে ওই জমি বরাদ্দের আবেদন জানিয়ে আরও বলা হয়, ‘আমাদের অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল তথা কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে কাঠামো নির্মাণ করায় দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।’ মাহবুব উর রহমানের এই আবেদনটিও ১ ফেব্রুয়ারি নাকচ করে দেয় বিভাগীয় ভূমি বরাদ্দ কমিটি।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, এলাকাভেদে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্য প্রতি বর্গফুট জমির বার্ষিক ভাড়া সর্বনিম্ন ৪০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৭০ টাকা। আর কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য প্রতি একর জমির ভাড়া বার্ষিক তিন হাজার টাকা।

জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, গণপূর্তমন্ত্রীর ছেলে ব্লক বানানোর কারখানা করতে মিরসরাইয়ে রেলের জায়গার জন্য আবেদন করেছেন। এ বিষয়ে যাচাই-বাছাই চলছে। চট্টগ্রাম থেকে প্রতিবেদন পাওয়া গেলে এ-সংক্রান্ত কমিটি তা মূল্যায়ন করে আবেদনটি বিবেচনায় নেওয়া যায় কি না দেখবে।

ইজারা না নিয়ে রেলের জায়গায় কারখানা করা কীভাবে সম্ভব, তা জানতে মাহবুব উর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু রিং হলেও ফোন ধরেননি তিনি। তবে তাঁর বাবা মোশাররফ হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ধুমঘাট সেতুর সঙ্গে ব্লক তৈরির কারখানার কোনো সম্পর্ক নেই। ফেনী নদীতে তাঁর জন্মের অনেক আগে থেকেই বালু তোলা হচ্ছে। ব্লক তৈরির কাজে সেই বালু ব্যবহার করা হবে। সেখানে পরিবেশবান্ধব ব্লক তৈরির কারখানা স্থাপন করা হচ্ছে। শিগগিরই ভূমি ইজারার অনুমোদন পেয়ে যাবেন বলে আশা করেন তিনি।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সরেজমিনে দেখা যায়, সেখানে একটি দ্বিতল ভবন ও একটি বড় কারখানা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। দুটি ভবনের সামনের অংশে ইয়ার্ড (ব্লক রাখার জায়গা) তৈরি করতে ইট বিছানোর কাজ চলছিল। কারখানার ভেতরে ইট তৈরির যন্ত্র বসানো ছিল। একজন প্রকৌশলী কারখানার পরীক্ষামূলক উৎপাদন তদারক করছিলেন।

গ্যাসমিন লিমিটেড কারখানার প্রকৌশলী আকিদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, পাকা ভবনটি বিদ্যুতের সাবস্টেশন হিসেবে ব্যবহার করা হবে। ভবনে জেনারেটর থাকবে। এটি পরিবেশবান্ধব ইট তৈরির কারখানা।

এ বিষয়ে বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, সেতুর নিরাপত্তার স্বার্থে রেলের প্রকৌশল দপ্তরের মতামতের ভিত্তিতে ধুমঘাট এলাকায় বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের আবেদন নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সেখানে যে স্থাপনা তৈরি হচ্ছে, তাতে কাঁচামাল হিসেবে পাথর, বালু ও সিমেন্ট নদীপথে স্টিমার বা বার্জে করে পরিবহন করা হবে। এ কারণে সেখানে কোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি হলে সেতুর ঝুঁকি বাড়বে।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1105324