১২ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ৯:৩৫

বন্ধ হচ্ছে না প্রশ্নপত্র ফাঁস

একদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস বা ফাঁসের গুজব ঠেকানো যাচ্ছে না, অন্যদিকে মূল উৎস চিহ্নিত করতে পারছে না পুলিশ ও প্রশাসন। বিজি প্রেস থেকে প্রশ্ন ফাঁসের সন্দেহ করা হলেও সেখান থেকেই যে এমন ঘটনা ঘটছে, তা–ও এখন পর্যন্ত পুলিশ নিশ্চিত হতে পারেনি।

সদ্য শেষ হওয়া মাধ্যমিক পরীক্ষার দিন সকালে কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন ফাঁসের একটি সিন্ডিকেট চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এই তদন্তে বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকজন শিক্ষককে চিহ্নিত করা ছাড়া মূল উৎস পর্যন্ত যাওয়া কঠিন বলে মনে করছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই। তাঁরা বলছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। তা ছাড়া পরীক্ষা শুরুর কয়েক দিন আগে থেকেই এই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে যে শক্তিশালী চক্রটি জড়িত, তারা এখন পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে।

এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাও শুরু হবে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন সূত্র জানায়, অনেকটা দিশেহারা অবস্থায় মন্ত্রণালয় ‘ডিজিটাল’ ব্যবস্থায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে পরীক্ষার দিন সকালেই স্থানীয়ভাবে প্রশ্নপত্র ছেপে পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু কবে থেকে তা বাস্তবায়িত হবে, তা এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. কায়কোবাদ প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও ছাপা হয়। ৫০ থেকে ৬০ জন মানুষের হাত ঘুরে যে প্রশ্নপত্র ছাপা হবে, সেখানে তা ফাঁস হবে না, সেটিই বরং অসম্ভব ব্যাপার। তিনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় আগে এ বিষয়টি অস্বীকার করে গেছে, কিন্তু এখন তারাও মনে করছে কিছু একটা হয়েছে। এ জন্য নতুন চিন্তা করছে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন পদ্ধতি এখনই শুরু করা উচিত বলে মত দেন ওই তথ্যপ্রযুক্তিবিদ।

কয়েক বছর ধরেই পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ উঠছে। সদ্য শেষ হওয়া এসএসসির গণিতসহ একাধিক বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপক গুঞ্জন ছিল। বিশেষ করে গণিত পরীক্ষার দিন সকালে প্রশ্নপত্র হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্তের সঙ্গে যুক্ত ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দুজন কর্মকর্তা গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা চেষ্টা করলেও এখন পর্যন্ত মূলে যেতে পারেননি। অভিযানের সময় মনে হয় অমুককে ধরলেই বুঝি মূল উৎস বের করা যাবে। কিন্তু একটি পর্যায়ের পর তাঁরা আর যেতে পারেন না। তবে এই দুই কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের সন্দেহ বিজি প্রেসের দিকে, যদিও যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ তাঁদের হাতে নেই।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এবার মূল উৎস বের করার সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন। তাঁরা আশা করছেন, এবার এটা পারবেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা বোর্ড ও প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে তদন্ত করা গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান প্রক্রিয়ায় তাঁরা দেখতে পারছেন, পরীক্ষার দিনের সকালটা বাদ দিলে এর আগে বিজি প্রেস ছাড়া আর কোথাও প্রশ্নপত্র ও পাণ্ডুলিপি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখার সুযোগ নেই।

জানতে চাইলে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের পরিচালক মুহাম্মাদ আল-আমীন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের বহু জায়গা থাকে। তবে যে-ই করুক, পুলিশ তা তদন্ত করে দেখতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সদ্য শেষ হওয়া এসএসসি পরীক্ষায় কয়েকটি বিষয়ের প্রশ্নপত্রের কোনো কোনো সেট পরীক্ষার আগের দিন রাতেই ফাঁস হয়। বিষয়টি জানতে পেরে ভোররাতে প্রশ্নপত্রের সেট পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা বোর্ড এ বিষয়ে কিছু বলতে চায় না।

এর আগে ২০১৪ সালে ঢাকা বোর্ডের অধীন এইচএসসি পরীক্ষার ইংরেজি ও গণিত (তত্ত্বীয়) দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নপত্র হুবহু ফাঁস হয়। সরকারি তদন্তেই তা প্রমাণ হয়েছিল। ওই সময় আগের দিন রাতে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের নমুনা ফরিদপুর থেকে পাওয়া গিয়েছিল। আরও কয়েকটি পরীক্ষায় একই ধরনের ঘটনা ঘটলেও তা স্বীকার করা হয়নি। এর আগে ২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে রাজধানীতে দায়ের হওয়া ৭০টি মামলার ১টিও প্রমাণ করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। শাস্তি পায়নি কোনো অপরাধী। মামলা থেকে অব্যাহতি ও খালাস পেয়ে গেছে অনেকেই।

তবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে এসএসসি পরীক্ষার দিন সকালে প্রশ্ন ফাঁসের একটি চক্র খুঁজে পেয়েছে পুলিশ। এদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তা স্বীকারও করছেন, যার সর্বশেষ প্রমাণ মতিঝিলে জ্ঞানকোষ একাডেমি নামে একটি কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে শিক্ষকদের একটি সিন্ডিকেট।

মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনার মো. শহীদুল্লাহ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে স্কুলশিক্ষক ও কোচিং সেন্টারের ব্যবসায় জড়িত ২১ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শিক্ষক আবদুল আলীমসহ দুই শিক্ষকের জবানবন্দি এবং পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রশ্ন পৌঁছার পরপরই মুঠোফোনে ছবি তোলা হয়। এরপর তাঁরা ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্নপত্র সিন্ডিকেট সদস্যদের কাছে পাঠাতেন।

সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না
কয়েক বছর ধরে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি স্বীকারই করতে চায়নি। ২০১৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনা হলে বর্তমান মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইনের (তখন অতিরিক্ত সচিব) নেতৃত্বে তদন্ত হয়। এতে প্রমাণিত হয়, ঢাকা বোর্ডের ইংরেজি ও গণিত (তত্ত্বীয়) দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। কমিটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত করে উৎস বের করার সুপারিশ করেছিল। যদিও তা এখনো সম্ভব হয়নি।

ওই কমিটির সুপারিশ ছিল ‘ডিজিটাল’ ব্যবস্থায় প্রশ্নপত্র পরীক্ষার দিন সকালে জেলা প্রশাসক বা উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ওই এলাকায় ছেপে তা পরীক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা।

জানতে চাইলে সোহরাব হোসাইন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখনই প্রক্রিয়াটা শুরু করতে চাই। আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষায় সম্ভব না হলে পরবর্তী এসএসসি পরীক্ষার সময় থেকে নতুন পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র স্থানীয় পর্যায়ে ছেপে পরীক্ষা নেওয়া হবে।’

সচিব বলেন, পাবলিক পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে নেওয়ার জন্য আগামী সপ্তাহে একটি কমিটি গঠন করা হবে, যাঁদের সুপারিশের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1105315