১২ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ৯:২৫

৬৩ লাখ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকায়

বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও লোকসান কমানোর অজুহাত দেখিয়ে এবার কৃষিতে ভুর্তকি প্রত্যাহার হচ্ছে। দীর্ঘ দিন ধরে কৃষিতে প্রণোদনা হিসেবে সেচে ব্যবহৃত বিদ্যুতে ২০ শতাংশ ভর্তুকি পেতেন কৃষকরা। শিগগিরই কৃষকরা এ সুবিধা খেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এনিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে আধা-সরকারি পত্র (ডিও লেটার)। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ ভর্তুকি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেচ মওসুমের আগে বিদ্যুৎ বিভাগের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকায় দেশের প্রায় ৬৩ লাখ কৃষক।

বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ড. আহমদ কায়কাউস এ প্রসঙ্গে একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন কৃষিতে স্বাভাবিক হারের চেয়ে অর্ধেক দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। সর্বশেষ হার এক্ষেত্রে ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ৮২ পয়সা। ফলে এখানে ভর্তুকি তুলে দেয়ার বিষয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে এখনও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

তিনি বলেন, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ইউনিটে গড় ব্যয় ৬ টাকা ৫৪ পয়সা। আর বাল্ক হারে (পাইকারিতে) তা বিক্রি করা হয় ৪ টাকা ৬৭ পয়সা দরে। এর ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ৮৭ পয়সা লোকসান হয়। এ হিসাবে গত অর্থবছর প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভর্তুকি উঠিয়ে দেয়া হলে বেড়ে যাবে কৃষিপণ্য উৎপাদন ব্যয়। তবে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য গত কয়েক বছর ধরে বাড়েনি। কিছু ক্ষেত্রে দাম উল্টো কমে গেছে। ফলে সেচের ভর্তুকি প্রত্যাহার হলে বিপদে পড়বেন বিদ্যুৎ চালিত সেচ যন্ত্র ব্যবহারকারী কৃষকরা।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বোরো, গম, আলু, ভুট্টা ও পেঁয়াজ চাষে সেচ দিতে হয়। এর মধ্যে বোরো চাষে সেচ লাগে সবচেয়ে বেশি। মূলত গভীর নলকূপ, অগভীর নলকূপ ও লো-লিফ্ট (হালকা) পাম্প দিয়েই চলে সেচকাজ। এর বাইরে সনাতনী পদ্ধতির সেচও রয়েছে। তবে যন্ত্রের সাহায্যে সেচ দেন ১ কোটি ৭৫ লাখ ৫৪ হাজার কৃষক। এর মধ্যে ৬২ লাখ ৯৭ হাজার ২১৪ জন কৃষক ব্যবহার করেন বিদ্যুৎ চালিত সেচ যন্ত্র। ভর্তুকি তুলে দিলে মূলত এসব কৃষকই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

সূত্র জানায়, বর্তমানে অঞ্চলভেদে বোরো চাষে প্রতি বিঘা জমিতে সেচকাজে বিদ্যুৎ খরচ হয় গড়ে ১ হাজার ৮০০ টাকা। আর হেক্টরপ্রতি খরচ প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে ভর্তুকি হিসেবে ২০ শতাংশ ছাড় পান কৃষকরা। অর্থাৎ সেচের বিদ্যুতে হেক্টর প্রতি গড়ে ২ হাজার ৭০০ টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়। এটি তুলে দেয়া হলে চাষে ব্যয় বেড়ে যাবে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ) মো. মোশাররফ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগের সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানা নেই। এটি প্রত্যাহার করা হলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। চিঠি পেলে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

তথ্যমতে,বর্তমানে সেচে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। সংস্থাটির বিদ্যুতে ৩ লাখ ১৪ হাজার সেচ যন্ত্র চলে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসব যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। আর ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সংস্থাটির অধীনে চলমান সেচ যন্ত্র ৩১ হাজার। এসব সেচ যন্ত্র দিয়ে ২২ লাখ ৪৯ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হয়।

সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ও লোকসান নিয়ে সম্প্রতি বৈঠক করে বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে খাতটির আয় বৃদ্ধিতে বেশকিছু নির্দেশনা দেয়া হয়। সভায় কৃষি কাজে প্রদত্ত ২০ শতাংশ ভর্তুকি প্রত্যাহারের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় বরাবর ডিও লেটার দেয়ার নির্দেশনা দেন তৎকালীন বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মনোয়ার ইসলাম।

সূত্র জানায়, দেশে ৫৪ লাখ ৯০ হাজার ৩৪৭ হেক্টর জমিতে যন্ত্রের সাহায্যে সেচ দেয়া হয়। এর মধ্যে প্রায় ৪১ শতাংশ জমিতে ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ চালিত সেচ যন্ত্র। বাকি ৫৯ শতাংশ জমিতে ব্যবহৃত সেচ যন্ত্র ডিজেলচালিত। এর মধ্যে ডিজেল ভর্তুকি আগেই তুলে দেয়া হয়।

এদিকে চলতি মৌসুমে তিন লাখ ৫৩ হাজার সেচযন্ত্র চলবে বিদ্যুতে। এতে দুই হাজার ২৩৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন। আগামী দুই মাসে বিদ্যুতের চাহিদা সাড়ে ৯ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাবে।

সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় সভায় এ আশঙ্কা করা হয়। চলতি সেচ মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সভাটি আয়োজন করা হয়।

বৈঠকে পিডিবি জানায়, প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া সেচ মৌসুম চলে মে পর্যন্ত। তবে বেশি চাহিদা থাকে এপ্রিল ও মে মাসে। গত বছর ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল সাত হাজার ৫৭১ মেগাওয়াট। চলতি সেচ মৌসুমে গড়ে ৯ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সংসদে বলেছেন, কৃষি উন্নয়নে সরকার গত পাঁচ অর্থবছরে ৪১ হাজার কোটি ৬ লাখ টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। সার, বিদ্যুৎসহ প্রভৃতি খাতে এ ভর্তুকি দেয়া হয়। তবে কৃষিকাজে ডিজেলচালিত সেচ যন্ত্রে কোনো ভর্তুকি দেয়া হয়নি। তিনি জানান, ২০১১-১২ অর্থবছরে কৃষিতে ভর্তুকি দেয়া হয় ৬ হাজার ৪৯৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১১ হাজার ৯৯৯ কোটি ৯৯ লাখ, ২০১৩-১৪২ অর্থবছরে ৮ হাজার ৯৭৩ কোটি ৫১ লাখ, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭ হাজার ১০১ কোটি ৬ লাখ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেয়া হয় ৬ হাজার ৪২৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ চাহিদা ও সরবরাহ নিশ্চিতের জন্য বৈঠকে বেশ কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। গ্যাসের কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। তবে এতে কোনো সমস্যা হবে না বলেই আশা করা যায় ।

http://www.dailysangram.com/post/275264