১২ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ৯:২২

তৃতীয় নয়ন

ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গা : ঠেঙ্গানি নয়, পুনর্বাসন হোক

মীযানুল করীম

বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে বড় কয়েকটি দ্বীপের সাথে বা কাছাকাছি কিছু চর আছে। এগুলোর মধ্যে নিঝুমদ্বীপের মতো কাব্যিক নাম যেমন আছে, তেমনি রয়েছে ঠেঙ্গারচরের মতো শ্রুতিকটু নাম। অবশ্য পুরনো মানচিত্রে দেখা যেত, বাংলাদেশের দক্ষিণে ‘চর লেংটা’-ও ছিল। এই ‘লেংটা’কে পোশাক পরিয়ে নতুন নাম দেয়া হয়েছে কি না, জানা নেই।
কয়েক দিন ধরে ‘ঠেঙ্গারচর’ নামটি বারবার সংবাদপত্রের শিরোনাম হচ্ছে। কারণ সরকার মিয়ানমার থেকে আগত হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে সুদূর কক্সবাজার জেলার টেকনাফ-উখিয়া থেকে হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে পাঠানোর তোড়জোড় করেছে। এ নিয়ে প্রশাসনের হাঁকডাক এবং বক্তব্য ও ব্যস্ততার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকের ধারণা হয়েছে, এই সরকার যেহেতু অনেক বড় পদক্ষেপই ‘গায়ের জোরে’ বাস্তবায়ন করেছে, অতএব, রোহিঙ্গাদের ঠেঙ্গিয়ে হলেও ঠেঙ্গারচরে পাঠানো হবে। কারো কারো আতঙ্ক দেখে মনে হতে পারে, এই চর বুঝি এক ধরনের কালাপানি। আবার এটাও বাস্তবতা যে, দেশের দক্ষিণ-পূর্বপ্রান্তে অনেক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু কয়েক দশক ধরে বাস করছে এবং এতে স্থানীয়ভাবে কিছু সমস্যাও দেখা দিয়েছে। তদুপরি ১৯৭৮ ও ’৯১ সালের মতো সম্প্রতি আবার রোহিঙ্গা শরণার্থীর স্রোত সৃষ্টি হয়েছিল। আগামী দিনে যে একই সঙ্কটের পুনরাবৃত্তি হবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে? বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সঙ্কটের জন্য মোটেও দায়ী নয় এবং তার পক্ষে অনির্দিষ্টকাল তাদের শরণার্থী হিসেবে রাখাও কঠিন। তবে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ না হওয়া পর্যন্ত তাদের আপাতত এ দেশে থাকার মোটামুটি সুবিধাজনক ব্যবস্থা তো করা চাই।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আগমন নতুন নয়। কারণ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাদের ওপর হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতনসহ নির্মূল অভিযান চলছে অনেক আগে থেকেই। রোহিঙ্গাদের আবাস প্রধানত বাংলাদেশসংলগ্ন রাখাইন স্টেটে, যা ইতিহাসে আরাকান নামে পরিচিত। তারা ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলিম এবং তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিগত অনেকটা মিল রয়েছে কক্সবাজার অঞ্চলের সাথে। মিয়ানমারে সরকার ও সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বর্বরতা থেকে বাঁচতে অনেক রোহিঙ্গা সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় পালাতে গিয়ে সাগরে বা বনজঙ্গলে প্রাণ দিয়েছেন। এ সবকিছুর বিবেচনায় মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা হত্যা-নির্যাতনসহ উচ্ছেদ অভিযানের শিকার হলে প্রথমেই ছুটে আসে পাশের বাংলাদেশের দিকে। গত অক্টোবর মাসে সে দেশে আবার সেনা-পুলিশের পৈশাচিকতা শুরু হলে শত শত রোহিঙ্গা টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। তবে অচিরেই বাংলাদেশ সরকারের একাধিক বাহিনী কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে এদের আগমন বন্ধ করে দেয়। অবশ্য ওই সীমান্তপথে মিয়ানমার থেকে মানুষ (রোহিঙ্গা) আসা ঠেকানো গেলেও মাদক (ইয়াবা) আসা বন্ধ হচ্ছে না। যা হোক, কক্সবাজার জেলায় প্রথমে ১৯৭৮ সালে, এরপর ১৯৯১ সালে রোহিঙ্গা আশ্রয় প্রার্থী নরনারীর ঢল নেমেছিল। মোট দুই লাখের বেশি ছিল তাদের সংখ্যা। তাদের একটা বড় অংশ উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার শরণার্থী শিবিরে রয়ে গেছে। বলা যায়, তাদের মিয়ানমার ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের দীর্ঘকাল এ দেশে অবস্থানে স্বাভাবিকভাবেই কিছু সমস্যাও দেখা দিয়েছে। এর সাথে যোগ হয়েছে সম্প্রতি আরো বেশ কিছু রোহিঙ্গার এ দেশে আশ্রয় গ্রহণের বিষয়টি। এটা বাংলাদেশের জন্য ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’র মতো।

এই পরিস্থিতিতে সরকার সম্প্রতি হঠাৎ ঘোষণা দেয়, ‘রোহিঙ্গাদের ঠেঙ্গারচরে পুনর্বাসন করা হবে।’ এটা শুনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কেউ হলেন বিস্মিত, কেউ বা বিক্ষুব্ধ। আবার কারো ধারণা, ঠেঙ্গারচরে আসলেই যদি পুনর্বাসন করা যায়, তাহলে এই সমস্যার সুরাহা হতে পারে। কত চরের নাম শুনি; কিন্তু প্রশ্ন হলো, ‘ঠেঙ্গারচর’ কোথায়? জায়গাটির নাম অপরিচিত। ম্যাপ খুলেও পেলাম না। কৌতূহল হলো, এই চর কি মূল ভূখণ্ড সংলগ্ন, নাকি সাগরের বুকে জেগে ওঠা ক্ষুদ্র স্থলভাগ?

অবশেষে যা জানা যায়, তা হচ্ছেÑ ঠেঙ্গারচরকে হাতিয়ার একটি চর হিসেবে তুলে ধরা হলেও এটা হাতিয়া দ্বীপ থেকেও অনেক দূর। দৈনিক নয়া দিগন্তের ৭ মার্চ সংখ্যায় নোয়াখালী প্রতিনিধির পাঠানো সচিত্র প্রতিবেদন ছাপানো হয়েছে। এর শিরোনাম : ‘অবকাঠামো উন্নয়ন ও জীবিকায়ন ছাড়া ঠেঙ্গারচরে বসতি স্থাপন সম্ভব নয়।’ এই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, হাতিয়া ও সন্দ্বীপের মাঝে দুর্গম স্থানে এই ঠেঙ্গারচর। হাতিয়া নোয়াখালী জেলার একটি উপজেলা হলেও জেলা সদর থেকে সেখানে যাতায়াতের ব্যবস্থা আজো উন্নত নয়। আর হাতিয়া দ্বীপ থেকে নৌপথে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ঠেঙ্গারচর যাওয়া-আসা যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টকর, তা সহজেই বোধগম্য। সন্দ্বীপ ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত নোয়াখালীর অংশ ছিল। এখন এটি চট্টগ্রামের একটি উপজেলা। সেই সন্দ্বীপের পাঁচ কিলোমিটার দূরে ঠেঙ্গারচর জেগে উঠেছে। বিশাল মেঘনার মোহনায় এর অবস্থান বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে। আয়তন ১০ হাজার একর বা ১৫ বর্গমাইলের মতো। ২০১০-১১ সালে এই চরে সরকার বনায়ন শুরু করে এবং ২০১৩ সালে গেজেটের মাধ্যমে ঠেঙ্গারচরকে ঘোষণা করা হয়েছে সংরক্ষিত বন হিসেবে। চার হাজার ৮০০ একরের এই বনে আছে চার থেকে ৮ ফুট দীর্ঘ কেওড়া গাছ। এখন এই রিজার্ভ ফরেস্ট বা সংরক্ষিত অরণ্য ধ্বংস করে রোহিঙ্গাদের সুদূর টেকনাফ থেকে এনে বসতি গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

ঠেঙ্গারচর বসবাসের উপযোগী নয় এবং ঠেঙ্গাড়ে মার্কা দস্যু-দুর্বৃত্তদের কারণে বিপদের ঝুঁকি অনেক। সেটা নয়া দিগন্তের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এতে জানানো হয়, হাতিয়ার ওছখালী থেকে ২০ কিলোমিটার নদীপথে ট্রলারে পাড়ি দিয়ে ঠেঙ্গারচরে পৌঁছাতে হয়। এতে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। অত্যন্ত দ্রুতগামী স্পিডবোটে ৩০ মিনিট লাগে। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ প্রহরার দরকার পড়ে। ঠেঙ্গারচর যাওয়া-আসার পথে আছে জলদস্যুর ভয়।

দুর্বৃত্তরা জেলেদের নৌকায় হামলা, অপহরণ, লুণ্ঠন, মুক্তিপণ আদায় প্রভৃতি অপরাধে লিপ্ত থাকে। তারা মূলত ঠেঙ্গারচর ও আশপাশে অবস্থান নিয়ে অপহরণ করে। দূরবর্তী ভিন্ন পরিবেশ থেকে আসা দরিদ্র রোহিঙ্গারা ঠেঙ্গারচরে নিরাপদ থাকবে কি না, এটা একটা বড় প্রশ্ন। কারণ তাদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা বিধান করা সহজ হবে না। রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনসংক্রান্ত কাজে বিশেষ করে দাতাসংস্থা এবং এনজিও কর্মকর্তারা সেখানে বারবার যেতে হবে, অনেককে অবস্থান করতে হবে। তাদের সর্বক্ষণ পুলিশ প্রটেকশনে থাকা জরুরি হয়ে পড়বে। অনেকে অন্য রকম আশঙ্কাও করছেন। তা হলো, ঠেঙ্গারচরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের কিন্তু লোকও দুর্র্বৃত্তদের সংস্পর্শে এসে অপরাধ-অপকর্মে জড়িয়ে পড়তে পারে।

দেশের অনেক জায়গায় বিশেষ করে নদ-নদী বা উপকূলের চর নিয়ে বিভিন্ন জেলা কিংবা উপজেলার মধ্যে বিরোধ দেখা যায়। ঠেঙ্গারচর নিয়েও বিরোধ বিদ্যমান। এই বিরোধ নোয়াখালী আর চট্টগ্রামের মাঝে। চরের মালিকানা নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ অচিরেই সুরাহা করা না হলে তা শুধু রোহিঙ্গা পুনর্বাসন নয়, উন্নয়নসংক্রান্ত নানা কাজেও জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। নয়া দিগন্তের খবর, ঠেঙ্গারচরে বেশ কয়েক বছর ধরে বনায়ন ও এর তত্ত্বাবধান করে আসছে নোয়াখালী জেলা প্রশাসন। কিন্তু চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ থেকে কম দূরত্বের কারণে সেখানকার লোকদের দাবি, এই চর সন্দ্বীপের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

ঠেঙ্গারচরে কোনো জনবসতি নেই পরিবেশ অনুকূল নয় বলে। হাতিয়া, সন্দ্বীপ ও ঢালচরের মৎস্যজীবীরা ঠেঙ্গারচরের আশপাশে মাছ ধরে এবং মাঝে মাঝে এই চরে এসে বিশ্রাম নেয়। চরটিতে তৃণভূমি রয়েছে, যেখানে আশপাশের এলাকার মানুষের গরু-মহিষ বিচরণ করে। আর বিভিন্ন ধরনের পাখি তো আছেই। তবে এখনো ঠেঙ্গারচর নিচু এবং জোয়ারের পানিতে এর অনেকাংশ ডুবে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের মওসুমে যখন প্রবল জোয়ার ও বড় বড় ঢেউ সৃষ্টি হয়, তখন চরটি আরো প্লাবিত হওয়াই স্বাভাবিক। আর ঝড়ের সময় সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ঘটলে চরের বসতি বিলীন হতে পারে। চার পাশে উঁচু বেড়িবাঁধ দেয়া ছাড়া সেখানে বাস করা সম্ভব হবে না। ঠেঙ্গারচর নিয়ে সরকারের বড় পরিকল্পনা থাকলেও এই চরের স্থায়িত্ব নিয়ে এখনো অনেকে সন্দিহান।

রোহিঙ্গাদের ঠেঙ্গারচরে পাঠানোর ব্যাপারে প্রশাসনের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। ৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল জয়নাল আবেদীন এ ব্যাপারে ঠেঙ্গারচর পরিদর্শন করে এসেছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সরেজমিন রিপোর্ট দেয়ার জন্য ওই চরে যেতে নোয়াখালীর ডিসি এবং বিভাগীয় বন কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছে।

নোয়াখালীর বন বিভাগ ঠেঙ্গারচর মানুষের বাসযোগ্য করে তোলার জন্য পাঁচটি করণীয় আছে বলে মনে করে। এ ব্যাপারে সরকারকে জানানো হয়েছে। করণীয়গুলো হচ্ছেÑ (ক) ঠেঙ্গারচরের ভূমি স্থায়ী হবে কি না মাটি পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া, (খ) জোয়ার থেকে বাঁচাতে বেড়িবাঁধ তৈরি করা, (গ) খাবার পানির সুব্যবস্থা, (ঘ) ঝড়-জলোচ্ছ্বাসকালীন আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ এবং (ঙ) সার্বিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।

যা হোক, সরকারের কিছুটা বোধোদয় ঘটেছে; যদিও ঠেঙ্গারচর রোহিঙ্গা ইস্যুর কোনো টেকসই দাওয়াই নয়। জেনেভায় এবার জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিটি বাংলাদেশ পরিস্থিতির বিষয়ে দুই দিনব্যাপী পর্যালোচনা বৈঠকে মিলিত হয়েছিল। এতে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘নিবন্ধন থাক বা না থাক, সব রোহিঙ্গাকে ঠেঙ্গারচরে পাঠিয়ে দেয়া হবে। তবে তা করা হবে সেখানে অবকাঠামো উন্নয়নের পর। সরকার নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলাধীন ঠেঙ্গারচরে সড়ক, বাসা, মসজিদ, হাসপাতাল, স্কুলসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করবে। এর পরই মিয়ানমার থেকে আগত উদ্বাস্তুদের সেখানে পুনর্বাসন করা হবে। তাদের মধ্যে ৩৩ হাজার নিবন্ধিত এবং তিন লাখের বেশি অনিবন্ধিত।’ জাতিসঙ্ঘকে আরো জানানো হয়, ‘সরকার পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের আদমশুমারি করেছে। তারা অবস্থান করছে কক্সবাজার এবং সেই সাথে তিন পার্বত্য জেলা, চট্টগ্রাম ও পটুয়াখালী জেলায়।’ তবে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সীমান্ত থেকে দূরবর্তী পটুয়াখালীতে যাওয়ার কারণ জানা যায়নি। সরকার বলেছে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসমেত নানাবিধ সুবিধা পাওয়ার জন্য শুমারির আওতায় রোহিঙ্গাদের তথ্যকার্ড দেয়া হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইন্দোনেশিয়া সফর করে এলেন। ৮ মার্চ নয়া দিগন্তে দু’টি খবর। একটি হলো, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে জাকার্তার সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি। ইন্দোনেশীয় প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদোর সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে শেখ হাসিনা আরো বলেছেন, মিয়ানমারের এই শরণার্থীরা বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যা এবং এর সমাধান প্রয়োজন। একই দিনের অন্য খবরটি হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিটির শুনানিতে বলেছেন, অবকাঠামো উন্নত করে ঠেঙ্গারচরে পাঠানো হবে রোহিঙ্গাদের।

প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন, রোহিঙ্গাদের দলে দলে আগমন ও আশ্রয় প্রার্থনা, তাদের ত্রাণ কার্যক্রম ইত্যাদি নিঃসন্দেহে একটা বিরাট সমস্যা। এর সুষ্ঠু সমাধান চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তবে সমস্যা সমাধানের নামে যদি তা আরো জটিল ও ব্যাপক হয়ে ওঠে, তাহলে বুঝতে হবে, সংশ্লিষ্ট পদক্ষেপ বাস্তবোচিত ও দূরদর্শিতাপূর্ণ নয়। রোহিঙ্গা ইস্যুর শান্তিপূর্ণ, স্থায়ী ও সর্বাঙ্গীণ সুরাহা হওয়া জরুরি। এর মূল সমাধানের চাবিকাঠি বাংলাদেশ নয়, মিয়ানমারের হাতে। এ সমস্যা মিয়ানমারের সরকারগুলো সৃষ্টি করেছে এবং বাড়িয়ে দিয়েছে। এটা সমাধান করার দায় তাদের এবং তাদের পক্ষেই এটা সম্ভব। এ জন্য মিয়ানমারের সরকার তথা রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সামরিক বাহিনী, আমলাতন্ত্র এবং সে দেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সদিচ্ছা, মানবিকতা ও দায়িত্ববোধ থাকতে হবে। রোহিঙ্গা ইস্যুর সুরাহার পথ হলো, তাদের দেশে ফিরিয়ে নেয়া, অবিলম্বে নাগরিকত্ব প্রদান এবং সব গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগের সুযোগ সৃষ্টি। বাংলাদেশে তাদের আশ্রয় দান করা মানবিক দায়িত্ব। তবে এটা সমস্যার কোনো সমাধান নয়, সাময়িক উপশম মাত্র। অতীতের বাংলাদেশ সরকার মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে অসংখ্য রোহিঙ্গাকে আশ্রয় ও সাহায্য দিয়েছে। বর্তমান সরকার পরিস্থিতির চাপে মনে করছে, তাদের দূরবর্তী একটি দ্বীপে পাঠিয়ে দিলে ঝামেলা মিটবে। কিন্তু এতে সমস্যা কমবে না বাড়বে, তা এখনই বিচার-বিবেচনা করা উচিত।

দেখতে হবে, ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের পাঠানো সমীচীন কি না; এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্য স্থায়ী বা অস্থায়ী বসতি যা-ই হোক না কেন, এই সুযোগে বর্বর বর্মি (মিয়ানমার) সরকার সামান্য অজুহাতে আরো অনেক রোহিঙ্গাকে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়ার কি সম্ভাবনা নেই?

‘ঠেঙ্গারচর’ নামটি কখন কারা কেন রেখেছিলেন, জানা যায়নি। শুনতে যে এ নাম মোটেও ভালো লাগে না, এ ব্যাপারে একমত হবেন সবাই। যেখানে ‘চর ওসমান’ হয়ে গেছে ‘নিঝুমদ্বীপ’; সেখানে ‘ঠেঙ্গারচর’ নামটি বদলিয়ে সুন্দর ও অর্থবহ নাম দেয়া হবে বলেই সবার প্রত্যাশা। কিন্তু পত্রিকার খবর হলো, নোয়াখালীর বর্তমান জেলা প্রশাসকের নামে ঠেঙ্গারচরকে চর মুনির নামে অভিহিত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তা-ও খোদ ওই ডিসির পক্ষ থেকে। আমরা জানি না, কোন যুক্তিতে এটা করা হয়েছে। গত ৪ জানুয়ারি ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর আনুষ্ঠানিকভাবে নামকরণের এই প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আমরা আশা করি, সরকার সব দিক বিবেচনা করে এবং অতীতের দৃষ্টান্তগুলো সামনে রেখে একটি যথার্থ নাম ঠেঙ্গারচরের জন্য নির্ধারণ করবে, যাতে পরে এ নিয়ে আপত্তি ও বিতর্ক সৃষ্টি না হয়।

রোহিঙ্গারা স্বদেশ থেকে বিতাড়িত, অসহায় এবং প্রধানত দরিদ্র। তারা বছরের পর বছর ধরে কক্সবাজার জেলার একাধিক স্থানে মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাদের স্থানান্তরের আগে নিশ্চিত হতে হবে, নতুন জায়গায় পুনর্বাসিত হলে নতুন করে কোনো বড় সমস্যা সৃষ্টি হবে না। আর জেনেশুনে ও তাড়াহুড়ো করে তাদের বিপদের মুখে ছেড়ে দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

আমরা মনে করি, বন বিভাগ তাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যেসব করণীয় সম্পর্কে বলেছে, সেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের সরেজমিন পরিদর্শনের আলোকে আরো করণীয় যোগ হতে পারে এ ক্ষেত্রে। হাতিয়া-সন্দ্বীপ উপকূলে জলদস্যুদের অব্যাহত দৌরাত্ম্যের প্রেক্ষাপটে দুর্বৃত্তদের দমন ও আইনশৃঙ্খলা বিধানকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। এ জন্য প্রথমেই পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ ও আনসার মোতায়েন করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের মানুষ আশা করে, অসহায় রোহিঙ্গাদের প্রতি নৈতিক, মানবিক, ধর্মীয় যে দায়িত্ব আমরা বোধ করি; তা সরকার ও জনগণ মিলে পালন করবে। সেই সাথে সমস্যাটির প্রকৃত ও স্থায়ী সুরাহার জন্য দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যথাসাধ্য কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে সরকার দ্বিধা করবে না।

পাদটীকা : সংসদ বাংলা অভিধান কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি প্রমিত অভিধান হিসেবে সমাদৃত। এতে ঠেঙ্গা বা ঠেঙা শব্দের অর্থ লাঠি ও ঠেঙ্গানো। সেই সাথে জানানো হয়েছে, ঠেঙ্গানো বা ঠেঙ্গানি শব্দের অর্থ, লাঠি দ্বারা প্রহার করা। বাংলা ভাষায় ‘ঠেঙ্গা’ মানে লাঠি হলেও হিন্দিতে এর অর্থ, ঠেঙ বা পায়ের মতো লম্বা। লাঠি দিয়ে একে অন্যের সাথে মারামারি করলে এটাকে বলা হয় ‘ঠেঙ্গাঠেঙ্গি’। প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ল অতীতের কুখ্যাত ‘ঠেঙ্গাড়ে’ দুর্বৃত্তদের কথা। এরা অবিভক্ত বঙ্গসহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে পথিকের মাথায় লাঠি মেরে সর্বস্ব লুটে নিত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ‘সতীদাহ’ বেআইনি করার পাশাপাশি ঠেঙ্গাড়ে দস্যুদের কঠোরভাবে দমন করেছিলেন। ‘ঠেঙানি’ শব্দটি বাংলাদেশে বহুলপরিচিত। পুলিশের ঠেঙানি এ দেশে এখন নিত্যকার ব্যাপার।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/202764