৮ ডিসেম্বর ২০১৯, রবিবার, ১২:৫৩

লাইসেন্স আতঙ্কে চাষিরা

উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ট্রাক্টর ব্যবহার বন্ধের পথে

উত্তারাঞ্চলের জেলা রংপুর সদরের কৃষক মো. জব্বার হোসেন (ছদ্মনাম)। নিজের জমি ছাড়াও তার গ্রামের অন্যদের জমি চাষ করে থাকেন ট্রাক্টর দিয়ে। কিছু পরিবহনের কাজও করে থাকেন তার ট্রাক্টর দিয়ে। মাঝে মধ্যে তেল নিতে তাকে শহরে যেতে হয়। এ সময় জেলা সদরের সড়ক পার হতে হয়। এজন্য তাকে বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় প্রশাসনের হয়রানির শিকার হতে হয়। মাঝে মধ্যে উচ্চ অঙ্কের চাদা দাবি করা হয়। পরিস্থিতি এমন যে ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষই বন্ধের উপক্রম হয়েছে। জব্বার হোসেন জানান, দীর্ঘদিন থেকেই ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করে আসছি। এখন প্রশাসন ট্রাক্টর এবং ড্রাইভার হিসেবে লাইসেন্স চাচ্ছেন। কিন্তু আমার তো কোনো লাইসেন্স নেই।

একই অবস্থা গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরের জাহাঙ্গীর হোসেনের (ছদ্মনাম)। গত কয়েক মাস ধরেই তিনিও নানান সময়ে লাইসেন্সের কারণে হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানান। তাদের আশপাশের গ্রামে জমি চাষে ট্রাক্টর প্রয়োজন। বেশ কিছু মানুষ ট্রাক্টর কিনতে চাইলেও হয়রানির কারণে কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন না। ফলে জমি চাষে প্রথাগতভাবেই হালের লাঙ্গল দিয়ে চাষ করতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার নতুন করে ট্রাক্টর প্রয়োজন হলেও কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন না কৃষক।

গত মাসে জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার মালন্দ এলাকায় রাস্তা পারাপারের সময় ট্রাক্টর পুড়িয়ে দেবার ঘটনা ঘটেছে। উপজেলার মানিকপাড়া গ্রামের কৃষক শামসুল হুদা বকুল ও রিপন হোসেনের ট্রাক্টরটি স্থানীয় প্রশাসন পুড়িয়ে দেয়। এ নিয়ে স্থানীয় কৃষকদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তারা এখন ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করতে সাহস পাচ্ছেন না। ক্ষেতলাল উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরাফাত রহমান ইনকিলাবকে বলেন. সাধারণত কৃষি কাজে ব্যবহার করলে কৃষকদের কোনো ঝামেলায় পড়তে হয় না। কিন্তু অনেকেই অবৈধভাবে বালু পরিবহন, ইট পরিবহন ও অন্যান্য পরিবহনের কাজে ট্রাক্টর ব্যবহার করে। তাদের কাছে সাধারণত লাইসেন্স চাওয়া হয়। তবে অবৈধ ব্যবহারকারীদের সাধারণ চাষিরা কিছুটা বিপাকে পড়েছেন বলে শিকার করেন আরাফাত রহমান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি বছর সাড়ে তিন থেকে চার হাজার ট্রাক্টর বিক্রি হয় উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে। কিন্তু ভীতিকর পরিস্থিতির কারণে এ অঞ্চলে ট্রাক্টর বিক্রি কমেছে প্রায় ৫৫ শতাংশ। উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলাতেই বিক্রি নেই বললেই চলে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনও শতভাগ যান্ত্রিকীকরণের আওতায় আসেনি জমি চাষ। তাই চাষাবাদে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমানো ও মাটির গুণাগুণ ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ট্রাক্টর। তাছাড়া শ্রমিক সংকট মেটাতেও কার্যকর ভূমিকা রয়েছে যন্ত্রটি। জমি তৈরি ছাড়াও কৃষি পণ্য পরিবহন ও বহুমুখী ব্যবহারে কৃষকের আয়ের অন্যতম উৎস হতে পারে ট্রাক্টর। কিন্তু কৃষকের মধ্যে এ ধরনের আতঙ্ক ট্রাক্টর ব্যবহার অনেকটাই বন্ধের উপক্রম হয়েছে। তাই ট্রাক্টর মালিক ও ট্রাক্টরের লাইসেন্সিং সমস্যার দ্রæত সমাধান করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

এগ্রিকালচারাল ট্রাক্টর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে প্রায় ৫০ হাজার ট্রাক্টর কার্যকরভাবে চালু রয়েছে। চলতি বছরে নতুন অনুষঙ্গ ‘ লাইসেন্স’ উত্তরাঞ্চলে ভীতিকর পরিবেশ। গত কয়েক মাস ধরেই চলতে দেয়া হচ্ছে না ট্রাক্টর। ট্রাক্টর পুড়িয়ে দেবার ঘটনা, তেলের পাম্প থেকে তেল নিতে গেলে কিংবা কোনোভাবে সড়কে উঠলে আটক করা হচ্ছে ট্রাক্টর। পাশাপাশি মোটা অঙ্কের চাদা দাবি করা হচ্ছে। বিক্রি বন্ধ থাকলে সরকারের যান্ত্রিকীকরণে চলমান ভর্তুকি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। তাই ট্রাক্টর মালিকদের এক বছরের মধ্যে ট্রাক্টরগুলোকে লাইসেন্সের আওতায় আনা যেতে পারে। কিভাবে চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষকদের আরো সহজ শর্তে এবং স্বল্প সুদে ঋণ দিতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। পাশাপাশি দেশে ট্রাক্টর পরিচালনার ক্ষেত্রে ভারতীয় মডেল অনুসরণ করার সুপারিশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

তথ্য মতে, ২০১৭ সাল পর্যন্ত ট্রাক্টরের বাজার ২০-৩০ শতাংশ হারে সম্প্রসারণ হয়েছে। তবে ২০১৭ সালের পর থেকেই কমতে থাকে বিক্রি। ২০১৪ সালে মোট ৪ হাজার ৯০টি ট্রাক্টর বিক্রি হলেও ২০১৫ সালে তা ছিল ৪ হাজার ৩৯২টি এবং ২০১৬ সালে ৫ হাজার ৭৬৫টি। ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ ৯ হাজার ২৫০টি ট্রাক্টর বিক্রি হয়। তবে এরপর থেকেই কমতে থাকে ট্রাক্টরের বাজার। ২০১৮ সালে প্রায় ৮ হাজার ৯৭১ ট্রাক্টর বিক্রি হলেও চলতি ২০১৯ সালে জানুয়ারি থেকে অক্টোবর সময় পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে মাত্র ৬ হাজার ২৮৭টি। ফলে গত বছরের ৭০ শতাংশ ট্রাক্টর বিক্রি হয়নি চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে। আবার ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর এ সময়ে ট্রাক্টর বিক্রির পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৯৯৩টি। ফলে ২০১৯ সালের একই সময়ে তুলনায় বিক্রি কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ।

সূত্র মতে, দেশের বাজারে ট্রাক্টর সংযোজন, আমদানি ও বিপণন করছে এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- দি মেটাল প্রাইভেট লিমিটেডের ট্যাফে, এসিআই মোটরসের সোনালিকা, র‌্যানকন ও কর্ণফুলী লিমিটেডের মাহিন্দ্র, মেটাল প্লাসের আইসার, পারফরমেন্স মোটরসের স্বরাজ, গেটকোর নিউ হল্যান্ড, ইফাদ অটোসের এসকর্ট ও এনার্জিপ্যাকের জন ডিয়ার ব্রান্ডের ট্রাক্টর বাজারে রয়েছে।

দি মেটাল প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী সাদিদ জামিল বলেন, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এ তিন মাসই হলো ট্রাক্টর বিক্রির উপযুক্ত মৌসুম। সারা দেশেই এখন নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। উত্তরবঙ্গে কৃষকের সঙ্গে চলমান ঘটনায় এক ধরনের ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ট্রাক্টর চালানোর ক্ষেত্রে জটিলতা থাকলে তা সময় দিয়ে দ্রæত সমাধান করতে হবে। চালকদের লাইসেন্সিং করা এবং গাড়ীগুলোকে রেজিস্ট্রেশন করার সুযোগ দিতে হবে। তা না হলে কৃষকের মনে আস্থাহীনতা তৈরি হবে। এতে যান্ত্রিকীকরণ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বিপাকে পড়তে পারে দেশের কৃষি খাত।

https://www.dailyinqilab.com/article/252858/