১ নভেম্বর ২০১৯, শুক্রবার, ১২:৫৩

টিকিট মাস্টার থেকে ওয়ার্ড কাউন্সিলর

আশির দশকের কথা। জীবন ও জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসেন ময়নুল হক মঞ্জু। ঠাঁই নেন গোপীবাগের এক আত্মীয়ের বাসায়। এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে বাসের টিকিট মাস্টারের কাজ পান। একপর্যায়ে

তিনি সায়েদাবাদ টার্মিনালে চাঁদাবাজি শুরু করেন। এসময় স্থানীয় বিএনপি দলীয় এক এমপি’র সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে উঠে। কিন্তু রাজনীতির হাওয়া বদল হলে বোল পাল্টিয়ে তিনি ওয়ার্ড কাউন্সিলরের পদ বাগিয়ে নেন। সম্পর্ক গড়েন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে।

ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। কাউন্সিলর ও সরকার দলীয় নেতা পরিচয়ে প্রভাব খাটিয়ে শুরু করেন দখলদারি ও চাঁদাবাজি। গড়ে তুলেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। চলমান ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর র‌্যাব-৩ এবং র‌্যাবের সদর দপ্তরে ওই এলাকার একাধিক ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ করেন। অভিযান শুরু হওয়ার পর তিনি কিছুদিন আত্মগোপনে যান। র‌্যাবের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে তদন্ত অব্যাহত রাখেন। বুধবার রাজধানী সুপার মার্কেটের এক ব্যবসায়ী মঞ্জুর বিরুদ্ধে ওয়ারী থানায় একটি মামলা করেন। এরই প্রেক্ষিতে গতকাল সকালে র‌্যাবের একটি দল টিকাটুলি এলাকা থেকে মঞ্জুর অফিসে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে। অভিযানে তার গাড়ি চালক সাজ্জাদ হোসেনকেও গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে যে ২১ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে শোকজ নোটিশ দেয়া হয়েছিল তার মধ্যে মঞ্জুও ছিলেন। ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মঞ্জু ওয়ারি থানা আওয়ামী লীগের সদস্য। এছাড়াও তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কমিটিতেও সদস্য ছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে তাকে আওয়ামী লীগের ওই কমিটি থেকে বাদ দেয়া হয়।

শুধু তাই নয়, টিকাটুলী এলাকায় অবৈধ দখলদারি, ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসায় ইন্ধন, মতিঝিলের ক্যাসিনো কিংদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী লালন করাসহ তার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ আছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। তার বিরুদ্ধে একাধিক গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলেও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা তার পকেটে থাকার কারণে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং তিনি দিন দিন বেপরোয়া হয়েছেন। শুদ্ধি অভিযান শুরু হলে তার নাম আবারও ওই এলাকার লোকজনের মুখে মুখে আসে। একাধিক ব্যক্তি তার নামে র‌্যাবের সদর দপ্তরে অভিযোগনামা নিয়ে হাজির হন।

মঞ্জুকে গ্রেপ্তারের পর প্রেস ব্রিফিংয়ে র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফিউলাহ বুলবুল জানান, চলমান ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের ধারাবাহিকতায় দুপুর ১ টার দিকে ওয়ারি থানার টিকাটুলিতে ময়নুলের অফিসে অভিযান চালায় র‌্যাব। তার অফিস থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় তার কাছ থেকে দুটি পিস্তল, মদ, গাঁজা, ইয়াবা, ফেন্সিডিল, যৌন উত্তেজক ওষুধ ও একটি পাসপোর্ট, বেশ কিছু জমির দলিল ও কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়।

ভবনের চতুর্থ তলার একটি কক্ষে কাঠের তৈরি একটি বাক্স পাওয়া গেলেও সেখানে কিছু পাওয়া যায়নি। তিনি আরও জানান, বুধবার রাতে কাজী মো. রনি নামে রাজধানী সুপার মার্কেটের একজন ব্যবসায়ী ওয়ারী থানায় একটি মামলা করেন। মামলার এজাহার নামায় অভিযোগ করা হয়েছে যে, কাউন্সিলর মঞ্জু তার কাছে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন এবং ওই টাকা না দেয়ায় বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়েছেন। মামলার বিষয়ে জানার পর র‌্যাব অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারে, ওই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে এ ধরণের আরও অনেক অভিযোগ আছে। এর ভিত্তিতেই অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা রয়েছে। সব মামলায়ই তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি-দখলবাজি ও সন্ত্রাসের অভিযোগ রয়েছে।

তিনি আরও জানান, কাউন্সিলর মঞ্জু চাঁদাবাজির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে সেসব অর্থ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত পরিবারের কাছে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেছেন। কী পরিমাণ অর্থ তিনি পাচার করেছেন এটি তদন্তের বিষয়। মঞ্জু নিজেও একজন মাদকসেবী। চাঁদাবাজি-দখলবাজি ছিল তার আয়ের প্রধান উৎস।

তিনি আরও জানান, রাজধানী সুৃপার মার্কেটের ব্যবসায়ীরা কাউন্সিলর মঞ্জুর বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছেন, তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করবেন বলে জানিয়েছেন। আমাদের কাছে মনে হয়েছে তাকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার এটাই সময়। অভিযানের পর তিনি পলাতক ছিলেন কী-না- এ প্রশ্নর উত্তরে তিনি জানান, অভিযানের পর তিনি কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন। দীর্ঘদিনের অভিযোগ সত্ত্বেও এতোদিন কেন গ্রেপ্তার করা হয়নি? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, কাউকে গ্রেপ্তার করলেই হবে না, তার বিরুদ্ধে যথাযথ প্রমাণের বিষয় রয়েছে। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে মামলা হবে।

র‌্যাব-৩ এর এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গত নির্বাচনে মঞ্জু ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠেন। মঞ্জুর বৈধ কোনো আয় নেই। সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজিই তার অর্থের উৎস। হাটখোলার বাসায় মঞ্জুর কেউ থাকে না। স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। মঞ্জু নিজেও নিয়মিত সেখানে যাতায়াত করেন। মঞ্জু তার চাঁদাবাজির সমস্ত টাকা আমেরিকায় পাঠাতেন বলে র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন।

সূত্র জানায়, টিকাটুলীতে ২০১৮ সালের এপ্রিলে আশরাফুল নামে এক ব্যক্তি একটি পেট্রোল প্যাম্প স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। ওই সময় মঞ্জু তার কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। টাকা না দেয়ার কারণে পেট্রোল প্যাম্প স্থাপন করতে পারেননি ওই ব্যবসায়ী। ওই ঘটনায় আশরাফুল ওয়ারি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। সূত্র জানায়, ওয়ারির টিকাটুলি এলাকায় তার নামে অন্তত তিনটি ফ্ল্যাট দখলের অভিযোগ রয়েছে। ওই তিনটি ফ্ল্যাটের বর্তমান বাজার মূল্য পাঁচ কোটি টাকা বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, ডেমরার ও কদমতলীল দনিয়া এলাকায় চারটি প্লট দখলের অভিযোগ আছে। ওই প্লটে বালু ফেলে তার নামে সাইনবোর্ড টাঙ্গানোর অভিযোগ আছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।

https://www.mzamin.com/article.php?mzamin=197248