২৯ অক্টোবর ২০১৯, মঙ্গলবার, ১২:১৪

চট্টগ্রাম বন্দর-এনবিআর দ্বন্দ্ব

সাত কারণে ভোগান্তিতে বন্দর ব্যবহারকারীরা

বন্দর কর্তৃপক্ষের অভিযোগ- এনবিআরের কারণে প্রতিদিন ৪-৫ হাজার ট্রাক ও সমসংখ্যক শ্রমিক ঢুকে বন্দরকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মধ্যে দীর্ঘদিন ৯টি বিষয় অনিষ্পন্ন রয়েছে। এর মধ্যে ৭টি বিষয় পণ্য খালাস ও বন্দর থেকে ছাড়করণ সংক্রান্ত।

বাকি দুটি বন্দর কর্তৃপক্ষ ও এনবিআরের মধ্যে দেনা-পাওনা সংক্রান্ত। বন্দর কর্তৃপক্ষের অভিযোগ- সাতটি বিষয় নিষ্পন্ন না হওয়ায় বন্দর কার্যক্রম পরিচালনায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে।

বন্দরে প্রতিদিন ৪-৫ হাজার গাড়ি ঢুকে যানজটের সৃষ্টি করছে। পণ্য ডেলিভারি দেয়ার জন্য ৪-৫ হাজার শ্রমিক প্রবেশ করে বন্দরের নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।

এমনকি এনবিআরের সমন্বয়হীনতায় বন্দর ব্যবহারকারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের এক প্রতিবেদনে এ অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি নৌ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দর কর্তৃপক্ষ ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা যায়, নানান সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় বন্দরের অপারেশন এলাকায় রাজস্ব বোর্ড কার্যক্রম পরিচালনা কারুক তা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় চায় না।

নৌ মন্ত্রণালয় ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ চায়, অপারেশন এলাকার বাইরে গিয়ে রাজস্ব বিভাগ কাজ করুক। অপরদিকে এনবিআর মনে করছে, রাজস্ব আয়ের স্বার্থেই বন্দরের ভেতরে কাজ করা উচিত। বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেদের ব্যর্থতার দায় এড়াতে এনবিআরকে দোষারোপ করছে।

এসব বিষয় নিষ্পত্তি করতে ৩১ অক্টোবর বৈঠক ডেকেছে নৌ মন্ত্রণালয়। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, জননিরাপত্তা বিভাগ, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থ বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টদের অংশ নিতে অনুরোধ করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম প্রসঙ্গে পরিবহন সচিব মো. আবদুস সামাদ যুগান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এনবিআর ও রাজস্ব বোর্ডের মধ্যে কিছু সমস্যা বিরাজমান রয়েছে। সমস্যাগুলো সমাধানে বৈঠক ডাকা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বন্দরের অপারেশন এলাকায় রাজস্ব বোর্ড কাজ করার কারণে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। বন্দরের কার্যক্রম স্লো হয়ে যাচ্ছে। আমরা চাই না, বন্দরের অপারেশন এলাকায় কাস্টমস কাজ করুক। তারা দূরবর্তী জায়গায় কাজ করতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশেই বন্দর থেকে দূরবর্তী এলাকায় কাস্টমস কাজ করে। এখানেও সেটাই চাই।’

তবে এ বিষয়ে রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক আধুনিকায়নের সদস্য খন্দকার আমিনুর রহমানের বক্তব্য হল- ‘আমেরিকার কোস্টগার্ড হুমকি দেয়ার পর বন্দর কর্তৃপক্ষের টনক নড়েছে। এখন তারা দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে।’

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘পৃথিবীর কোন দেশে বন্দরের বাইরে কাস্টমস কাজ করে? চবকের টাকা থাকার পরও তারা স্ক্যানিং মেশিন কেনে না কেন? আইসিডিতে তারা কতদিনে পণ্য পাঠায়? এ ধরনের অনেক প্রশ্ন রয়েছে। অথচ আমরা দ্রুততার সঙ্গে সব ধরনের কাজ করে যাচ্ছি।’

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে এনবিআরের সঙ্গে সাত বিষয় নিষ্পত্তি না হওয়ায় বন্দরের কার্যক্রমে সৃষ্ট সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এগুলো হল- সব এফসিএল কনটেইনার বন্দরের বাইরে ডেলিভারি না দেয়া, ৩৭টির বেশি আইটেম অফডকে ডেরিভারি না দেয়া, ৩ হাজার ৯৭৯টি বক্স ও ৬১৭টি গাড়ি অকশন না দেয়া, কনটেইনার স্ক্যানিংয়ে বিলম্ব, গ্রিন চ্যানেল চালু না হওয়া, কনটেইনার কায়িক পরীক্ষায় সমন্বয়হীনতা এবং সব বক্স ডেলিভারি না দেয়া।

এছাড়া চবক ও এনবিআরের মধ্যে অকশন হিস্যা বাবদ ৮০ কোটি ৩০ লাখ ৪৮ হাজার টাকা বকেয়া আদায় এবং জাহাজ থেকে ভ্যাট বাবদ ১৬২ কোটি ৭৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা আদায় সংক্রান্ত বিষয় অনিষ্পন্ন রয়েছে।

সব এফসিএল কন্টেইনার বন্দরের বাইরে ডেলিভারি না দেয়া : চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে দেখা যায়, এনবিআর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৩৭ ধরনের পণ্যবাহী এফসিএল (ফুল কনটেইনার লোড) অফডক থেকে ডেলিভারির অনুমতি দেয়া আছে; যা মোট এফসিএলের ২০-২০ শতাংশ।

আর বক্স হিসেবে ডেলিভারি হয় ১০-১২ শতাংশ। বাকি ৬৫-৭০ শতাংশ কনটেইনার বন্দর থেকে খুলে ডেলিভারি দেয়া হয়।

এতে বন্দরের কনটেইনার সংরক্ষণের প্রায় ৩০ শতাংশ স্থান অপচয় হয়। এতে জাহাজের কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া এসব পণ্য নিতে প্রতিদিন প্রায় ৪-৫ হাজার ট্রাক-কাভার্ডভ্যান বন্দর এলাকায় প্রবেশ করে যানজটের সৃষ্টি করে। পণ্য ডেলিভারি দেয়ার জন্য ৪-৫ হাজার শ্রমিক বন্দরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে; যা বন্দরের নিরাপত্তার জন্য হুমকি ও ঝুঁকিপূর্ণ।

৩৭টির বেশি আইটেম অফডকে ডেরিভারি না দেয়া : বিশ্বের অন্যান্য বন্দরের মতো আরও ৯ ধরনের এফসিএল কনটেইনার বন্দরের সংরক্ষিত এলাকার বাইরে প্রাইভেট ডিপোতে স্থানান্তর এবং মালামাল আনস্টাফিং ও ডেলিভারির অনুমতি চাওয়া হলেও রাজস্ব বোর্ড সাড়া দেয়নি।

৯টি আইটেম হল- পলিপ্রপিলিন, পেপার, আসবাবপত্র, স্কিমড মিল্ক পাউডার, আয়রন-স্টিল পণ্য, সব ধরনের লবণ, টেলো, টাইলস ইত্যাদি।

এছাড়া ২০১১ সালের ২৬ ডিসেম্বর এনবিআর এক চিঠির মাধ্যমে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র সদস্যদের সরাসরি শতভাগ এফসিএল কনটেইনার ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে আমদানিকৃত ফেব্রিক্স ও অ্যাক্রেলিক ইয়ার্ন অফডকে নিয়ে খালাসের অনুমতি দিলেও পরের বছর তা স্থগিত করে। বর্তমানে এ ধরনের কনটেইন আমদানি হচ্ছে প্রায় ৮ দশমিক ৭ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব পণ্য অফডকে ডেলিভারি দেয়া হলে জট কমবে।

কনটেইনার স্ক্যানিংয়ে বিলম্ব : কনটেইনার স্ক্যানিংয়ে গড়ে ২-৩ মিনিট লাগে। কিন্তু রিপোর্ট প্রিন্ট নিয়ে ভেরিফাই করতে লাগছে ৩০-৩৫ মিনিট। অপরদিকে কনটেইনার স্ক্যানিং হয়ে গেট পাস হতে সর্বোচ্চ ৫-১০ মিনিট লাগার কথা। কিন্তু পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে বেশি সময় লাগছে।

কনটেইনার ও গাড়ি অকশন না দেয়া : বন্দরে ৩ হাজার ৯৭৯টি বক্স ও ৬১৭টি গাড়ি অকশন না দেয়ায় বন্দরে পড়ে থাকায় জায়গা নষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যে সাউথ কনটেইনার ইয়ার্ডে অকশনযোগ্য ১ হাজার ২৪৯টি বক্স ও অন্যান্য ইয়ার্ডে ২ হাজার ৭৩০টি বক্স এনবিআরকে হস্তান্তর করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মডেলের ১৯০টি গাড়ি এবং ২০০২-২০১৯ সাল পর্যন্ত আসা বিভিন্ন মডেলের ৩০ দিন অতিক্রান্ত হওয়া ৪২৭টি গাড়ি রয়েছে।

গ্রিন চ্যানেল চালু না হওয়া : বড় বড় প্রতিষ্ঠান বিপুলসংখ্যক কনটেইনার প্রতিনিয়ত ডেলিভারি নিয়ে যায়। তাদের কাস্টমস ও বন্দরের প্রক্রিয়া বিশেষ করে স্ক্যানিং ও গেট ভেরিফিকেশনের জটিল প্রক্রিয়া পার হতে অনেক সময়ক্ষেপণ হচ্ছে।

বর্তমানে প্রায় ১৫ শতাংশ কনটেইনার এপ্রেইজ করে মালামাল ডেলিভারি নিতে হয়। এতে ব্যয় ও সময় বেশি লাগছে। বন্দরের ডেলিভারি কার্যক্রম গতিশীল করার সুবিধার্থে গ্রিন চ্যানেল চালু হলে কার্যক্রমের গতিশীলতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়বে।

কনটেইনার কায়িক পরীক্ষায় সমন্বয়হীনতা : মোট আমদানিকৃত কনটেইনারের মধ্যে বন্দরের অভ্যন্তরে ১২-১৫ শতাংশ কায়িক পরীক্ষা করা হয়। এ কাজে কাস্টমসের বিভিন্ন শাখার সমন্বয়হীনতার কারণে একই কনটেইনার বারবার পরীক্ষা করা হয়। এতে বন্দরের ইয়ার্ড, স্পেস, জনবল ও ইকুইপমেন্টের কর্মক্ষমতার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না।

সব বক্স ডেলিভারি না দেয়া : এফসিএল বক্স হিসেবে আসা ১০-১২ শতাংশ মালিকের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে ডেলিভারি দেয়া হয়। কমার্শিয়াল আইটেমসহ সব ধরনের এফসিএল পণ্য বক্স-অন-চেসিস ডেলিভারি প্রদানের অনুমতি দেয়া হলে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমে গতিশীলতা আসবে ও উৎপাদনশীলতা বাড়বে।

এনবিআর-বন্দরের মধ্যে দেনা-পাওনা : নিলামে বিক্রীত পণ্যের বিক্রয়লব্ধ অর্থের হিস্যা বাবদ এনবিআরের কাছে ৮০ কোটি ৩০ লাখ ৪৮ হাজার ১৮৪ টাকা পাবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ওই টাকা দ্রুত দাবি করেছে তারা।

এদিকে এনবিআর জাহাজ থেকে ভ্যাট বাবদ ১৬২ কোটি ৭৯ লাখ ২৫ হাজার ৩০০ টাকা বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি করেছে। এর জবাবে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলেছে, ২০১৩-১৫ অর্থবছরে ভ্যাট আদায়ে নির্দেশনা না থাকায় শিপিং এজেন্ট থেকে আদায় করা সম্ভব হয়নি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/237662/