১২ অক্টোবর ২০১৯, শনিবার, ২:৩৪

'আমি তো কোনো অন্যায় করিনি, মারছ কেন'

বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। শিবির সন্দেহে যখন আবরারকে মারধর করা হচ্ছিল, তখন তিনি বারবার নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। একপর্যায়ে আবরার বলেন, 'আমি কোনো অন্যায় করিনি, আমাকে মারছ কেন?' এরপর মারধরের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতে আবরার বুয়েটের শেরেবাংলা হলের কয়েকজন ছাত্রের নাম জানিয়ে বলেন, ওরা শিবিরকর্মী হতে পারে। ওই নামগুলো জানার পর হামলাকারীরা তাৎক্ষণিক তাদের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, তারা শিবিরকর্মী নয়। তখন 'মিথ্যা' বলার অপরাধে ফের আবরারকে নির্যাতন করা হয়। গ্রেফতার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির সূত্র ধরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। গতকাল শুক্রবার আবরার হত্যা মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে আরেক আসামি মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন।

পাঁচ দিনের রিমান্ডের চার দিন শেষে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের বহিস্কৃত ক্রীড়া সম্পাদক জিয়নকে শুক্রবার ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয়। মহানগর হাকিম সারাফুজ্জামান আনসারী তার জবানবন্দি নথিভুক্ত করেন। এর আগে বৃহস্পতিবার আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে এ মামলার আরেক আসামি ইফতি মোশাররফ সকাল।

জানা গেছে, জিয়নকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তার জবানবন্দিতে আবরার হত্যার ভয়ঙ্কর বর্ণনা উঠে আসে। জিয়ন স্বীকার করে, সে নিজেও আবরারের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। এ ছাড়া আবরারের ওপর দফায় দফায় হামলা চালায় অনিক সরকার, রবিন, সকাল ও মুজাহিদুর রহমান। অন্যরা যখন মারধর করছিল, তখন জিয়ন আবরারের হাত ধরে রাখে। আর আবরারের পায়ের নিচে স্টাম্প দিয়ে পেটাতে থাকে সকাল।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, পেটানোর সময় আবরার বারবার শিবির সংশ্নিষ্টতা অস্বীকার করছিলেন। এ সময় হামলাকারীরা বলতে থাকে, 'শিবির না হলে তোর ফেসবুকে এ ধরনের স্ট্যাটাস কেন।' নির্যাতনের সময় বেশ কয়েকবার ফ্লোরে শুয়ে পড়েন আবরার। তখন আবার তুলে মারধর করা হয়। কেউ কেউ তখন মুখ ভেংচি কেটে বলছিল, 'ও ঢং ধরেছে। ওষুধ পড়লে ঠিক হয়ে যাবে।' নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কয়েকবার বমিও করেন আবরার।

একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, আবরারকে ধরে নেওয়ার পর তার মোবাইল ও ল্যাপটপে কী রয়েছে, তা চেক করছিল কয়েকজন। ওই সময় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক জিয়ন ২০১১ নম্বর কক্ষে যায়। তখন মেহেদী আবরারের কাছে জানতে চায়, বুয়েটে কারা কারা শিবির করছে। এ সময় ভয়ে এলোমেলো কথা বলেন আবরার। তখন একজন ওই রুমে ক্রিকেট খেলার স্টাম্প নিয়ে আসে। ওই স্টাম্প দিয়ে আবরারকে মারধর করে সকাল।

একপর্যায়ে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক অনিক সরকার আবরারকে বেধড়ক পেটাতে থাকে। হাঁটু, পা, পায়ের তালু ও বাহুতে স্টাম্প দিয়ে দেড় শতাধিক আঘাত করে সে। এতে ভেঙে যায় স্টাম্প। পরে মশারি টানানোর লোহার রড দিয়ে মারা হয়। অনিক মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে নতুনভাবে মারধর শুরু করে জিয়ন। আবরারকে চড় এবং স্টাম্প দিয়ে হাঁটুতে মারতে থাকে সে। একপর্যায়ে রশি দিয়ে মারতে থাকে মুজাহিদ। মারধরের পর আবরার অচেতন হয়ে পড়লে হামলাকারীদের একজন বলে, 'ওকে গোসল করিয়ে মালিশ করিয়ে দেওয়া হোক।' এ সময় আবরারের কক্ষ থেকে কাপড়চোপড় আনা হয়।

অমিত ও তোহা পাঁচ দিনের রিমান্ডে :আবরার হত্যাকাণ্ডে গ্রেফতার অমিত সাহা ও হোসেন মোহাম্মদ তোহাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গতকাল শুক্রবার তাদের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

বুয়েট শাখা ছাত্রলীগ কর্মী তোহা এমই বিভাগের ১৭তম ব্যাচের ছাত্র। গত রোববার রাতে শেরেবাংলা হলে তার ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি তোহা। ডিবির তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ওই রাতে আবরারকে যে ক'জন তার কক্ষ থেকে ডেকে নিয়েছিল, তাদের মধ্যে তোহাও ছিল। অন্যদিকে, প্রযুক্তিগত তদন্তে সম্পৃক্ততা পেয়ে অমিত সাহাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এই ছাত্র শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে থাকত। আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করার সময় সেখানে তার উপস্থিতি না থাকলেও ফোনে সে নির্যাতনের নির্দেশ দেয়।

গতকাল তোহা ও অমিতের শুনানির সময়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা আদালতকে বলেন, আবরারকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। শেরেবাংলা হলের যে কক্ষে আবরারকে নির্যাতন করা হয়, সেটি অমিত সাহার কক্ষ। অপর আসামি তোহা আবরারকে ডেকে ওই কক্ষে নিয়ে আসে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অন্যদের গ্রেফতার করার জন্য দুই আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি। অন্যদিকে তোহার আইনজীবী আদালতের কাছে দাবি করেন, আবরার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তোহা জড়িত নয়।

এদিকে, আবরারের রুমমেট মিজানুর রহমান মিজানকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। গতকাল পুলিশ তাকে আদালতে হাজির করে মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারাগারে আটক রাখার আবেদন করে।

এজাহারভুক্ত আরও দুই আসামি গ্রেফতার :এদিকে, গতকাল ডিবি পুলিশ সিলেট ও সাতক্ষীরায় পৃথক অভিযান চালিয়ে আবরার হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আরও দুই আসামিকে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে এজাহারভুক্ত ৮ নম্বর আসামি মাজেদুল ইসলামকে গতকাল ভোরে সিলেটের শাহ কিরন এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। সে বুয়েটের এমএমই বিভাগের ১৭তম ব্যাচের ছাত্র।

এ ছাড়া গতকাল দুপুরে সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে এজাহারভুক্ত ১৪ নম্বর আসামি শামীম বিল্লাহকে গ্রেফতার করা হয়। সে বুয়েটের নেভাল আর্কিটেকচার বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ডিবি জানায়, হত্যাকাণ্ডের পর শামীম তার বাড়ি শ্যামনগরের ভুরুলিয়া ইউনিয়নের ইছাপুর খানপুর গ্রামে আত্মগোপন করে ছিল। সেখান থেকেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। এখন পর্যন্ত ওই মামলায় মোট ১৮ আসামিকে গ্রেফতার করা হলো। এর মধ্যে ১৪ জন এজাহারভুক্ত ও চারজন এজাহারের বাইরের আসামি রয়েছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শামীম জানিয়েছে, সে সাতক্ষীরা হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল।

অবশ্য শামীম বিল্লাহর দাদি মমতাজ বেগম বলেন, গত মঙ্গলবার রাতে বাড়িতে যায় শামীম। সে আত্মসমর্পণ করবে বলে পরামর্শ নেওয়ার জন্য বাড়িতে এসেছিল।

https://samakal.com/bangladesh/article/1910931