গতকাল শুক্রবার বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার অন্যতম আসামী অমিত সাহাসহ দুইজনকে আদালতে হাজির করা হয় -সংগ্রাম
১২ অক্টোবর ২০১৯, শনিবার, ২:১৭

আবরারের ওপর নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা আসামী ইফতি ও জিয়নের

# আসামী শামীম ও মাজেদুল গ্রেফতার
# অমিত শাহ ও তোহা ৫দিনের রিমান্ডে
স্টাফ রিপোর্টার : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় আসামী ইফতির স্বীরোক্তিমূলক জবানবন্দীতে নির্মম নির্যাতন করে আবরারকে হত্যার চিত্র ফুটে উঠেছে। আবরারের ওপর কত নির্মম নির্যাতন করা হয়েছে তা শুনলে চোখে পানি রাখ দায়।
জানা গেছে, ইফতির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বলেছেন, ৪ অক্টোবর বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবিন শেরেবাংলা হল ছাত্রলীগের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে একটি নির্দেশনা দেয়। এতে বলা হয়, আবরার শিবির করে, তাকে ধরতে হবে। -এরপর মেসেঞ্জার গ্রুপে সাড়া দেয় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা।
আবরার তখন বাড়িতে থাকায় ও সকলকে বলে, ‘ওকে বাড়ি থেকে ফিরতে দেন।’ ৬ অক্টোবর রাত আটটার কিছু পর আবরারকে ২০১১ নম্বর কক্ষে নিয়ে আসা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের শুরু রবিন বেশ কয়েকটি চড় মারে আবরারকে রাফাত স্টাম্প এনে সকালের হাতে দেয়, স্টাম্প দিয়ে চার-পাঁচটি আঘাত করে সকাল। এতে স্টাম্পটি ভেঙে যায়। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক অনিক সরকার স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু, পা, পায়ের তালু ও বাহুতে মারতে থাকে। তখন জিয়ন আবরারকে চড় মারে এবং স্টাম্প দিয়ে হাঁটুতে বাড়ি দেয়।
রাত সাড়ে ১০টার দিকে সকাল ক্যান্টিনে খেতে যায়। মিনিট বিশেক পর ফিরে এসে দেখে, আবরার অসুস্থ হয়ে পড়েছে, মেঝেতে শুয়ে আছে। সকাল তখন আবরারকে ধমক দিয়ে উঠে দাঁড় করায়। কয়েকটি চড় মারে। মুজাহিদ তখন কক্ষে থাকা স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরারকে মারে। সকাল আবার স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু ও পায়ে আঘাত করে।
তানভীর তখন চড়-থাপ্পড় মারে। রাত ১১টার দিকে অনিক আসে। হঠাৎ অনিক স্টাম্প দিয়ে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে এলোপাতাড়ি শতাধিক আঘাত করে। আনুমানিক রাত ১২টার পর অনিক আবরারকে মারা থামিয়ে কক্ষের বাইরে যায়। -তখন আবরার অসুস্থ হয়ে পড়ে ও জানায় তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
এর কিছুক্ষণ পরই আবরার বমি করে। তখন রবিন আবরারকে দেখে বলে, ‘ও নাটক করছে’। -এরপর আবরারকে ২০০৫ নম্বর কক্ষে নিয়ে শুইয়ে দেওয়া হয়। এ সময় অমিত সাহা খুদে বার্তা পাঠিয়ে সবকিছু জানতে চায় এবং আবরারকে আরও মেরে আরও তথ্য বের করতে বলে। আবরারের অবস্থা খুব খারাপ জানালে অমিত তাঁকে হল থেকে বের করে দিতে বলে।
এর কিছুক্ষণ পর রবিন ও অনিক ২০০৫ নম্বর কক্ষে আসে। আবরারকে দেখে তাঁরা বলেন, ‘ও ঠিক আছে। এরপর তাঁরা চলে যায়। -এ সময় আবরার আবার বমি করে। রবিন তখন আবরারকে পুলিশের হাতে দেওয়ার জন্য নিচে নামাতে বলে। ১৭ ব্যাচের ছেলেরা আবরারকে নিচে নামানোর চেষ্টা করে। ব্যর্থ হলে তোশকসহ আবরারকে ধরে দোতলা ও নিচতলার সিঁড়িতে নামিয়ে রাখে। তখন আবরার বলছিল যে তাঁর খুব খারাপ লাগছে। সাধারণ সম্পাদক রাসেল তখন নিচে নেমে হলের প্রধান ফটকে পুলিশের সঙ্গে কথা বলছিল। এ সময় মুনতাসির দৌড়ে এসে বলেন, আবরারের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। সকাল তাঁকে মালিশ করতে বলে। ইসমাইল ও মনির তখন অ্যাম্বুলেন্সে ফোন দেয়। অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি হওয়ায় তামিম বাইক নিয়ে বুয়েট মেডিকেলের চিকিৎসক নিয়ে আসে। চিকিৎসক আসার পরপরই অ্যাম্বুলেন্স আসে। চিকিৎসক সিঁড়িতে আবরারকে দেখে বলেন, ‘ও মারা গেছে।’ -পরে সকলে একটি কক্ষে গিয়ে শুয়ে থাকে। সেখান থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
ইফতির পর আসামী জিয়ন গতকাল স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দী দিয়েছে। আবরার হত্যার ঘটনায় রিমান্ডে থাকা আসামী মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের উপ-ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন। গতকাল শুক্রবার ঢাকা মহানগর হাকিম মো. সারাফুজ্জামান আনছারীর আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় এ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন তিনি। পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় এজাহারভুক্ত আরো দুই আসামীকে আটক করা হয়েছে। এরা হলেন শামীম বিল্লাহ ও মাজেদুল। গতকাল শুক্রবার বিকালে সাতক্ষীরা থেকে শামীম বিল্লাহকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
আবরার হত্যার ঘটনায় করা মামলায় শামীম ১৪ নম্বর আসামী। তিনি বুয়েটের মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত ১৮ জন গ্রেফতার হলেন। এর আগে গতকাল সকালে সিলেট থেকে মামলার এজাহারভুক্ত আরেক আসামি মাজদুল ইসলামকে গ্রেফতার করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।
অপর দিকে শুক্রবার ভোর ৪টায় সিলেটের শাহ কিরন এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা-দক্ষিণ বিভাগের ধানমন্ডি জোনাল টিম। বিষয়টি নিশ্চিত করে ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের ডিসি মাসুদুর রহমান জানান, গ্রেফতারকৃতের নাম মো. মাজেদুল ইসলাম (২১)। মাজেদুল বুয়েটের এমএমই বিভাগের ১৭তম ব্যাচের ছাত্র।
এদিকে আবরার হত্যার ঘটনায় বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলসহ গ্রেফতার ১৩ জনকে রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সাংগঠনিক তদন্তের ভিত্তিতে আগের রাতেই বুয়েট ছাত্রলীগের ১১ জনকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করার কথা জানায়।
বুয়েটের তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরারকে গত রবিবার রাতে শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে ২০১১ নম্বর কক্ষে নিয়ে বেধড়ক পেটান বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তাকে ক্রিকেটের স্ট্যাম্প ও লাঠিসোটা দিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় প্রচ- মারধর করা হয়। নির্মম পিটুনিতে আবরার মারা যান। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার মরদেহে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
আবরার ফাহাদ হত্যাকা-ের ঘটনায় তার বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ইতিমধ্যে পুলিশ ১৯ জনকে গ্রেফতার করেছেন। ১৩ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
গ্রেফতার আসামিরা হলেন- বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রাসেল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফুয়াদ হোসেন, অনীক সরকার, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, ইফতি মোশারেফ, বুয়েট ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবিন, গ্রন্থ ও প্রকাশনা সম্পাদক ইশতিয়াক আহমেদ ওরফে মুন্না, ছাত্রলীগের সদস্য মুনতাসির আল জেমি, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম ওরফে তানভীর, মোহাজিদুর রহমানকে, শামসুল আরেফিন, মনিরুজ্জামান ও আকাশ হোসেন, মিজানুর রহমান (আবরারের রুমমেট), ছাত্রলীগ নেতা অমিত সাহা এবং হোসেন মোহাম্মদ তোহা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপ-সম্পাদক অমিত সাহা ও বুয়েটের শিক্ষার্থী হোসেন মোহাম্মদ তোহার ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল শুক্রবার তাদের ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পুলিশ।
এ সময় পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার ও মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম সরাফুজ্জামান আনছারী পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
উল্লেখ্য, গত ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বুয়েটের ১৭তম ব্যাচের ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের ছাত্র আবরার ফাহাদ রাব্বীকে। ওইদিন রাত তিনটার দিকে শেরেবাংলা হলের দ্বিতীয় তলা থেকে আবরারের মরদেহ উদ্ধার করে কর্তৃপক্ষ। পুলিশ জানিয়েছে, তাকে পিটিয়ে হত্যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় একাধিক ভিডিও ফুটেজও পাওয়া যায়। এ ঘটনায় আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে ৭ অক্টোবর রাজধানীর লালবাগ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় ১৯ জনকে আসামী করা হয়েছে।

https://www.dailysangram.com/post/392620