১২ অক্টোবর ২০১৯, শনিবার, ২:০৫

সুশাসন, সংবিধান ও গণ-অধিকার

-সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

শাসনপ্রক্রিয়া যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উচ্চাভিলাষের বৃত্তে আবর্তিত হয়, তখন সুশাসনের বিচ্যুতি ঘটে। মূলত সুশাসন এমন এক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে সব শ্রেণীর মানুষের অধিকার নিশ্চিত হয় এবং জাতীয় স্বার্থ অক্ষুণœ থাকে। এই প্রক্রিয়ায় শাসনকাজে জনগণ স্বাধীনভাবে অংশগ্রহণ করে; সরকারের নীতি ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত হয় এবং নাগরিকেরা স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করার অধিকার লাভ করে। মূলত সাংবিধানিক শাসনই হচ্ছে ‘সুশাসন’; যেখানে রাষ্ট্র সব নাগরিকের অধিকারের ক্ষেত্রে সমতা বিধান করে এবং জাতীয় স্বার্থ সবার উপরে প্রাধান্য পায়।

রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে নির্বাহী বিভাগ একটি। এই বিভাগের নিয়ামক শক্তিই হচ্ছে আমলাতন্ত্র। বস্তুত, আমলাতন্ত্রের গতিশীলতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি সুশাসনের অন্যতম অনুষঙ্গ। কারণ, আমলারাই সরকারের সব কর্মসূচি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করে থাকেন। তারা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন। তাই সুশাসনের ক্ষেত্রে আমলাদের ভূমিকার বিষয়টি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কারণ সরকার, জনগণ ও আমলাতন্ত্রের ত্রিমাত্রিক সেতুবন্ধই পারে রাষ্ট্রকে সফল ও সার্থক করে তুলতে। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আমলাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিক সমান, এটিই সুশাসনের মূল কথা। আমাদের সংবিধানেও এ নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তা অনেকটা কাজীর গরু কেতাবে আছের মতোই শোনায়। নেতিবাচক ও স্বার্থান্ধ রাজনীতির কারণেই নাগরিক অধিকার এখনো সবার জন্য এক সমতলে আনা সম্ভব হয়নি বরং এ ক্ষেত্রে ভিন্নতা খুবই স্পষ্ট। মূলত রাষ্ট্রাচারের বিচ্যুতি ও রাজনীতির কক্ষচ্যুতির কারণেই নাগরিকেরা বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে।

আসলে আমাদের দেশের রাজনীতি সঙ্ঘাতপ্রবণ হওয়ায় রাষ্ট্রীয় স্বার্থের অনুকূলে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা যায়নি বরং দিন যতই যাচ্ছে ক্ষমতাপ্রেমীরা নিজেদের ক্ষমতার অভিযাত্রাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য প্রভু, গোষ্ঠী ও শ্রেণী তোষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। উপেক্ষিত হচ্ছে সার্বজনীন নাগরিক অধিকার। এমনকি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করা হচ্ছে না বরং তথাকথিত বন্ধুত্বের নামে উজাড় করে দেয়া হচ্ছে সব কিছু। বিপরীতে আদায় করা যাচ্ছে না কানাকড়িও। ফলে আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতিসত্তাও হাসি-তামাশার বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। বিষয়টি উদ্বেগের হলেও স্বার্থান্ধ মহল একেবারেই ভাবলেশহীন। কারণ আত্মপূজা যেখানে মুখ্য, তখন দেশ, জাতি ও জাতীয় স্বার্থ সেখানে গৌণ হবে, এটাই স্বাভাবিক।

মূলত গণমানুষের কল্যাণ ও অধিকার নিশ্চিতের জন্যই রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর উৎপত্তি। প্রাচীনকাল ও মধ্যযুগে রাষ্ট্রকে মনে করা হতো ঈশ্বরের সৃষ্টি করা প্রতিষ্ঠান। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রকে ‘সার্বজনীন কল্যাণ সাধনকারী’ এবং ‘মানুষের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য’ সঙ্ঘ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। আর রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জনসাধারণকে আইন মেনে চলতে বাধ্য করা, সমাজের শান্তি ভঙ্গকারীদের শাস্তির বিধান করা এবং সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, শ্রেণী ও পেশা নির্বিশেষে সব শ্রেণীর নাগরিকের অধিকারের সমতা বিধানও রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব এবং আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আমরা বৈশ্বিক মানদণ্ডে খুবই পশ্চাৎপদ।

মূলত রাষ্ট্র যখন তার গণমুখী চরিত্র হারিয়ে ফেলে তখনই মানুষে মানুষে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। জাতীয় স্বার্থ রক্ষার চেয়ে নিজেদের আত্মপূজার অনুষঙ্গগুলোই মুখ্য হয়ে ওঠে। আর রাজনীতি যখন শুধুই ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, তখন রাষ্ট্র আর কল্যাণমুখী থাকে না বরং শ্রেণী বা গোষ্ঠী বিশেষের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থের অনুষঙ্গ হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত আইন, সংবিধান, শিষ্টাচার, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও রাষ্ট্রাচারের ঐতিহ্য কোনো কিছুই আমলে নেয়া হয় না। ক্ষমতাই যখন মুখ্য, তখন জাতীয় স্বার্থ, মূল্যবোধ ও জনস্বার্থ সেখানে গৌণ হয়ে পড়ে। যেমনটি হয়েছে আমাদের ক্ষেত্রে।

সম্প্রতি আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম যে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে তিস্তার পানিবণ্টনসহ প্রতিবেশীর সাথে দ্বিপাক্ষীয় সমস্যাগুলোর সমাধান হবে। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি পড়েছে ইতোমধ্যে। অনেক প্রত্যাশার সফরে বহুল আকাক্সিক্ষত তিস্তা চুক্তি না হলেও ফেনী নদীর পানি ইতোমধ্যে বিসর্জন দেয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, আমাদের এই বৃহৎ প্রতিবেশী চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে। বাংলাদেশের ভূখণ্ড দিয়ে দেশটির ট্রেন চলবে, এমন খবরও বাতাসে ভাসছে। ফলে তিস্তা চুক্তির স্বপ্নের যে অপমৃত্যু হয়েছে, তা মোটামুটি নিশ্চিত। আর এমন আত্মাহুতির সমালোচনা করার জন্য নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে। বিষয়টি গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজের জন্য সত্যিই লজ্জার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশের রাজনীতিতে একটা উড়নচণ্ডী ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। নিজেদের ক্ষমতা রক্ষার জন্য ক্ষমতাসীনেরা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে চণ্ডনীতির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণভাবে শ্রেণী তোষণের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। সে ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সরকারি চাকরি আইনের গেজেট নোটিফিকেশন জারি করে তা কার্যকারিতাও দেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, সম্প্রতি জারি করা সরকারি চাকরি আইন-২০১৮-এর একাদশ অধ্যায়ের ৪১ এর (১) উপধারায় সরকারি কর্মচারীদের ফৌজদারি অপরাধ বিষয়ে বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সাথে সম্পর্কিত অভিযোগে দায়ের করা ফৌজদারি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র গ্রহণ হওয়ার আগে তাকে গ্রেফতার করতে হলে সরকারের বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি নিতে হবে।

মূলত সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ প্রণয়নের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একধরনের ‘ইনডেমনিটি’ তথা দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনে এ ধারা দুদকের আইনের যে প্রাধান্য তা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেলায় খর্ব করবে। ফলে দুর্নীতির পরিসর আগের তুলনায় বাড়বে। বস্তুত ফৌজদারি মামলা ছাড়াও দুর্নীতির মামলায় আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করার আগে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেফতার করতে চাইলে সরকারের অনুমতি নেয়ার যে বিধান সংযুক্ত করা হয়েছে তা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একধরনের ‘ইনডেমনিটি’ দিয়েছে। আমলাদের জন্য নতুন আইন প্রণয়নে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মানা হয়নি। কারণ, আমাদের সংবিধানের ১৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন’।

মূলত এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতার অবৈধ সম্পদ আহরণে প্রজাতন্ত্রের দুর্নীতিবাজ কর্মচারীরা সহযোগিতা করে আসছে। এতে অসৎ প্রকৃতির আমলাদেরও ‘পোয়াবারো’ হয়েছে এ কথাও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আর উভয়পক্ষের অশুভ ও অনাকাক্সিক্ষত সখ্যের কারণেই ৩০ ডিসেম্বরের মতো একটি ‘মিডনাইট’ নির্বাচনও আমাদের হজম করতে হচ্ছে। আর সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন আইনকে তার প্রতিদান হিসেবেই মনে করা হচ্ছে।

বিষয়টি আত্মসচেতন মানুষকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের মূল চেতনা ও অভীষ্টের পরিপন্থী প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে গ্রেফতারের জন্য সরকারের পূর্বানুমতির বিধান রেখে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ কার্যকর করার সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয় দক্ষ, জনবান্ধব, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক জনপ্রশাসন নিশ্চিত করতে আইনের চোখে সব নাগরিক সমান অধিকারের যে সাংবিধানিক বিধান তার সাথে সাংঘর্ষিক ও বৈষম্যমূলক। তাই বিভিন্ন মহল থেকে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এই আইনকে প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে।

সদ্য কার্যকর হওয়া সরকারি চাকরি আইনের সাংবিধানিক দিক এবং বিভিন্ন দুর্বলতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। তারা একমত হয়েছেন যে, নতুন আইন প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততা, স্বচ্ছতা, উন্নততর পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন নিশ্চিতের পরিপন্থী।

মূলত সংবিধান নিয়ে ক্ষমতাসীনেরা অনেক উচ্চবাচ্য করলেও তাদের দ্বারাই সংবিধান ও জাতীয় স্বার্থ বারবার উপেক্ষিত হচ্ছে। দেশ ও জাতির চেয়ে প্রাধান্য পাচ্ছে আত্মস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থ। তাই দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এই অশুভ বৃত্ত থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় স্বাধীনতার স্বপ্নগুলো আমাদের কাছে অধরাই থেকে যাবে।

http://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/447315