৭ অক্টোবর ২০১৯, সোমবার, ১১:২৫

আলোচনায় এবার যুবলীগ চেয়ারম্যান

অভিযান শুরু ও ব্যাংক হিসাব তলবের পর ওমর ফারুক চৌধুরী অনেকটাই আত্মগোপনে

কিছুদিন আগেও তাকে ঘিরে থাকতেন হাজার হাজার নেতাকর্মী। দলীয় কার্যালয়ে উপচানো ভিড় জমত। এখন এসবের কিছুই নেই। আগেই ব্যাংক হিসাব তলব করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে বলেও খবর ছড়িয়েছে। তবে গতরাত পর্যন্ত এটা নিশ্চিত করা যায়নি। আওয়ামী যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর সবকিছুই এখন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নীতিনির্ধারক নেতারা। যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে গ্রেফতারের পর গতকাল রোববার আবার আলোচনায় এসেছেন সংগঠনের চেয়ারম্যান। ঘুরেফিরেই মুখে মুখে প্রশ্ন ছিল- 'এবার কি ওমর ফারুক চৌধুরীও গ্রেফতার হচ্ছেন?' চার দিন ধরেই অনেকটা 'আত্মগোপনে' রয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবার থেকে গতকাল পর্যন্ত তিনি ফোন ধরেননি। বঙ্গবন্ধু এভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও ধানমণ্ডির যুব জাগরণ কার্যালয়েও যাননি। দু'দিন ধরে ধানমণ্ডির বাড়িতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি।

ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে দলীয় পদবাণিজ্যের নানা অভিযোগ তো রয়েছেই। এ ছাড়া সম্রাটের ক্যাসিনোর ভাগ পেতেন বলেও অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

ওমর ফারুক চৌধুরীর ব্যাংক হিসাব তলবের ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছেন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ ঘরানার অনেকেই। তবে এ ঘটনাকে 'অপ্রস্তুত' এবং 'বিস্ময়কর' হিসেবে দেখছেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ। তিনি উদ্ভূত পরিস্থিতিকে যুবলীগের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধাক্কা হিসেবে দেখছেন। হারুনুর রশীদ সমকালকে বলেন, তারা বুঝতেই পারেননি, ভেতরে এতকিছু হচ্ছে।

ক্যাসিনো-কাণ্ডের শুরুতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াসহ তিন নেতার গ্রেফতারের পর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন যুবলীগ চেয়ারম্যান। তিনি ওই ঘটনাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করেছেন। প্রশাসনকেও দুষেছেন। যুবলীগের প্রশ্নবিদ্ধ নেতাদের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন। এর পরের দৃশ্যপট অন্যরকম। এর পর থেকেই তাকে খুব একটা প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না।

ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা এত দিন তার কর্মকাণ্ড নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেও এখন সবকিছু প্রকাশ্যে এসেছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে ঘিরে ক্যাসিনো-কাণ্ড এবং সাংগঠনিক সম্পাদক (পরে বহিস্কৃত) খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াসহ জি কে শামীমকে গ্রেফতারের পর আলোচনার পুরোভাগে আসেন যুবলীগ চেয়ারম্যান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুবলীগের জ্যেষ্ঠ একজন নেতা সমকালকে বলেন, চেয়ারম্যানের আশকারায় দলে অনেক দুর্বৃত্ত ডালপালা ছড়িয়ে ফেলার সুযোগ পায়। তারা কেন্দ্রীয় কমিটি তো বটে, সারাদেশের জেলা-উপজেলা কমিটি গঠনের ক্ষেত্রেও পদবাণিজ্য করে। এই দুর্বৃত্তায়নের দায় চেয়ারম্যান এড়াতে পারেন না।

সংগঠনের একাধিক নেতা জানান, কমিটির দায়িত্বশীলদের এড়িয়ে একমাত্র দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমানের শলা-পরামর্শেই চূড়ান্ত হতো চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ সব কার্যক্রমের বিষয়ে সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ পর্যন্ত অন্ধকারে থাকতেন। হারুনুর রশীদ অবশ্য এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ। তিনি সমকালকে বলেন, যুবলীগ খুব ভালোমতোই চলছিল। কোনো দ্বন্দ্ব-বিভেদও নেই। সে কারণে তারা সবাই একবাক্যে চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়ে আসছিলেন।

চট্টগ্রামের কয়েকজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, একসময় চট্টগ্রামে জাতীয় শ্রমিক লীগ করতেন ওমর ফারুক চৌধুরী। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর দল বদল করে জাতীয় পার্টির অঙ্গ সংগঠন যুব সংহতির চট্টগ্রাম উত্তর জেলা শাখার নেতৃত্বে আসেন তিনি। এরপর রাউজানে পৈতৃক জমিতে গড়ে তোলেন 'রাও গার্মেন্টস' নামে একটি পোশাক কারখানা।

স্থানীয়রা জানান, যুব সংহতির রাজনীতি করে অর্থনৈতিকভাবে ভালো অবস্থান তৈরি করেন ওমর ফারুক। এরশাদ সরকারের পতনের পর ফারুকের ব্যবসায় ধস নামতে শুরু করে। তিনি তখন রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান। ১৯৯২ সালে যোগ দেন আওয়ামী লীগে।

জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে সোনালী ব্যাংকের চট্টগ্রামের কে সি দে রোড শাখা থেকে রাও নিট অ্যাপারেলস ও রাও গার্মেন্টসের নামে ১১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ঋণ নেন ওমর ফারুক। তাতেও সাফল্য পাচ্ছিলেন না। এর বাইরে আরও একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়ে যান। ওই অবস্থায় ঢাকায় চলে আসেন।

ঢাকায় যুবলীগ চেয়ারম্যানের কোনো ব্যবসা নেই বলে জানিয়েছেন একাধিক নেতা। তবে ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার ৫ নম্বর সড়কে যুব জাগরণের কার্যালয়ে ঢুকতেই দেয়ালে টাঙানো ফলকে ছয়টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম দেখা যায়। সেগুলো হলো- রাও গার্মেন্টস প্রাইভেট লিমিটেড, রাও নিট অ্যাপারেল প্রাইভেট লিমিটেড, রাও ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড, রাও কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, যমুনা ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড, লেক ভিউ প্রপার্টিজ লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে অফিস সহকারী মনির হোসেন কিছু জানেন না বলে সমকালকে জানান। ব্যাংক ঋণ সময়মতো পরিশোধ না করায় সুদে-আসলে ৪৪ কোটি টাকায় রূপ নেয়। এখন পর্যন্ত তিনি ওই টাকা পরিশোধ করেননি। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। দেনার দায়ে তার সহায়-সম্পত্তি নিলামে ওঠার উপক্রম হলেও ততদিনে তিনি যুবলীগের চেয়ারম্যান হয়ে যান। ওই মামলা এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। একসময় ব্যাংক ঋণের কবলে যার সম্পত্তি নিলামে ওঠার উপক্রম, সেই ফারুক চৌধুরী এখন বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক।

বেরিয়ে আসছে অনেক অজানা: যুবলীগের বর্তমান ও সাবেক একাধিক নেতা সমকালকে জানান, আওয়ামী লীগবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম পার্টি ও যুবদলের অনেকে টাকার বিনিময়ে ঠাঁই পেয়েছেন যুবলীগে। বিশেষ করে ২০১২ সালে ষষ্ঠ কংগ্রেসে ওমর ফারুক চৌধুরী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে যুবলীগের ঐতিহ্য বিলীন হতে শুরু করে। অর্থের বিনিময়ে দলে ঢুকে পড়ে বিভিন্ন এলাকায় বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য বিতাড়িতরাও।

কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক সদস্য নওশাদ মাহমুদ রানা সমকালকে বলেন, অর্থের বিনিময়ে দলে অযোগ্য ও প্রশ্নবিদ্ধ অনেক ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন সংগঠনের চেয়ারম্যান। পদভেদে ১০ লাখ থেকে শুরু করে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন তিনি। রানা নিজেও চেয়ারম্যানের চাহিদামতো ৩০ লাখ টাকা দিতে না পারায় দলের পদ পাননি বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, চেয়ারম্যানের একজন প্রতিনিধি (যিনি ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত) গুলশানের একটি রেস্তোরাঁয় ৩০ লাখ টাকার বিষয়টি জানিয়ে ছিলেন। তিনি অস্বীকৃতি জানানোয় কমিটিতে জায়গা হয়নি।

বর্তমান কমিটির আরেক নেতা সমকালকে বলেন, অর্থের বিনিময়ে পদ দেওয়ার ক্ষেত্রে ওমর ফারুক চৌধুরীকে সহযোগিতা করতেন কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্য। তবে এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতেন দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান।

তার দেখা মেলে না কোথাও: ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার ৫ নম্বর সড়কের ১৫/এ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায় যুব জাগরণ বা যুব গবেষণা কেন্দ্রের কার্যালয়। বেশিরভাগ সময় দুপুরের পর থেকে এখানেই সময় কাটান ওমর ফারুক চৌধুরী। তাকে ঘিরে এই বাড়ির নিচেও থাকত অগণিত নেতাকর্মীর ভিড়। গত দু'দিন সেখানে গিয়ে দেখা গেল সুনসান নীরবতা।

অফিস সহকারী এখলাস মিয়া জানান, ওমর ফারুক চৌধুরী বিকেলের সময়টা এখানে কাটান। দলীয় লোকজন আসেন এখানে। তবে কয়েক দিন ধরে এই কার্যালয়ে যান না যুবলীগ চেয়ারম্যান। বৃহস্পতিবার থেকে রোববার পর্যন্ত সমকাল থেকে অনেকবার চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

গতকাল রোববার বিকেল ৪টায় দ্বিতীয় দফায় গিয়েও সেখানে দুই অফিস সহকারী ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায়নি।

ধানমণ্ডির ৮/এ সড়কের ৭৪ নম্বর বাড়িতে থাকেন ওমর ফারুক চৌধুরী। তার খোঁজে শনি ও রোববার ইস্টার্ন হেরিটেজ নামে ওই বাড়ির সামনে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও পাওয়া যায়নি তাকে। নিরাপত্তাকর্মী সাজ্জাদ হোসেন জানান, যুবলীগ চেয়ারম্যান সকালেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেছেন।

https://samakal.com/bangladesh/article/1910515/