৩ অক্টোবর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১২:২৩

অনলাইন ক্যাসিনোর ফাঁদেও নিঃস্ব অনেকে

প্রয়োজন হয় না ক্লাব। লাগে না সাজসজ্জা। আয়োজন নেই নিরাপত্তার। নেই খেলার সরঞ্জামও। দরকার হয় না নির্দিষ্ট সময়। ২৪ ঘণ্টাই চলে জুয়ার কারবার। যেখানে-সেখানে বসেই অনলাইনে খেলা যায় বেটিং বা গ্যাম্বলিং নামের এই জুয়া। নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে গোপন লিংকে চলা এই জুয়া অনলাইন ক্যাসিনো নামে পরিচিত। দেশে অবৈধ ক্যাসিনো কারবারের বিরুদ্ধে অভিযানের মধ্যে সামনে এসেছে গোপনে চলা এই রমরমা কারবার। টি-২১ এবং পি২৪ নামের অনলাইন গ্যাম্বলিং সাইট খুলে দেশে অনলাইন ক্যাসিনোর প্রবর্তনকারী সেলিম প্রধান গ্রেপ্তারের পর আরো তথ্য বেরিয়ে আসছে।

সেলিম ধরা পড়ার পর সরকারের ‘সাইবার থ্রেট ডিটেকশন অ্যান্ড রেসপন্স’ প্রকল্প থেকে গতকাল বুধবার ৬৭টি গ্যাম্বলিং সাইট বন্ধ করা হয়েছে। এর আগে এ প্রকল্প থেকে প্রায় আড়াই হাজার গ্যাম্বলিং সাইট বন্ধ করে দেওয়ার পরও অনলাইনে জুয়া খেলা যে বন্ধ হয়নি তা সেলিম প্রধানের কারবার থেকেই প্রমাণ মিলছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও বিষয়টি স্বীকার করে গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনলাইনে এই অপরাধের জগত্টা বিশাল। সে তুলনায় আমাদের পর্যবেক্ষণ সক্ষমতা এখনো অপ্রতুল। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

মন্ত্রী বলেন, ‘অনলাইন গ্যাম্বলিং সাইটগুলোর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ থেকেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সেলিম প্রধানকে শনাক্ত করে। তাঁর অবস্থানও নিশ্চিত করা হয় মোবাইল ট্র্যাকিং থেকে। তাঁকে আটকের পর অনলাইন জুয়া সম্পর্কে এত দিন আমাদের জানার বাইরে জুয়াড়িদের অনেক কৌশল নজরে আসছে এবং সে অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

র‌্যাবের তদন্তকারী সূত্রগুলো জানিয়েছে, পাঁচটি দেশের নিবন্ধিত বেটিং সাইটগুলোতে দেশ থেকে অনলাইন জুয়া খেলা হচ্ছে। ব্যাংকে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে এবং ডিলারদের কাছ থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের চিপস বা কয়েন কিনে স্মার্ট মোবাইল ফোন দিয়েই এই জুয়া খেলা চলছে। বাস্তবে ফুটবল-ক্রিকেটসহ বিভিন্ন খেলার সময় বাজি এবং ওই সব খেলার আদলেই হচ্ছে অনলাইন জুয়ার কারবার। জুয়ায় অংশ নেওয়া বেশির ভাগই শিক্ষার্থী বা বয়সে তরুণ। নেশায় পড়ে অনেক হচ্ছে নিঃস্ব। সেলিমের মতো আরো ১৫টি চক্র অনলাইন ক্যাসিনোর দেশীয় ডিলারের কাজ করছে। তারা ১৫০টি ওয়েবসাইট ব্যবহার করছে বলেও তথ্য মিলেছে।

সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইনে বেটিং বা জুয়ার কারবারে বিদেশে অর্থপাচারের পাশাপাশি সাইবার সিকিউরিটিও ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, ‘আমাদের একটি সাইবার মনিটরিং সেল রয়েছে। সেই সেলে আমরা দেখতে পাই কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অনলাইনে ক্যাসিনো গেমিংয়ে নিয়োজিত রয়েছে। এর সূত্র ধরে আমরা কাজ করছি। সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করেই অনলাইন ক্যাসিনো বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, স্থানীয়ভাবে যে মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সংস্থাগুলো আছে তাদের সাহায্যে খুব স্বল্পমূল্যে চক্রগুলো জুয়ার চিপস সরবরাহ করছে। সহজ ও খেলা নিয়ে হওয়ায় তরুণরা বেটিং গেমের নামে জুয়ায় ঝুঁকে পড়ছে। এর মূল ডেভেলপার হচ্ছে চীন, হংকং, কোরিয়া, ফিলিপাইন ও ইউক্রেনের মতো কিছু দেশ। এসবের প্রতিরোধে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। সামাজিক সচেতনতাও প্রয়োজন।

তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, পাঁচটি দেশের সাইটগুলোতে ক্রিকেট, ফুটবল, রাগবি ম্যাচ চলার সময় লাইভ (তাত্ক্ষণিক) বাজি ধরার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া যেসব ক্লাবের ম্যাচ কোনো চ্যানেলে সম্প্রচার হয় না সেই ক্লাবের খেলা নিয়েও হয় বাজি। সেলিম প্রধানের টি-২১ এবং পি২৪ সাইটের জন্য তিনটি ইন্টারনেট গেটওয়ে ব্যবহার করা হচ্ছিল। এসব গেটওয়েতে লেনদেনের টাকা সেলিম, তাঁর সহযেগী আখতারুজ্জামান ও রোকন সংগ্রহ করতেন। এরপর হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন। মাসে ৯ কোটি টাকা এবং দুই বছরে ৩৫০ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। দুই বছর ধরেই লন্ডনে টাকা পাচার করছিলেন সেলিম।

সূত্র জানায়, জুয়া খেলার জন্য জুয়াড়িদের প্রথমে অনলাইন সাইটগুলোতে নিবন্ধন করতে হয়। জুয়ায় অংশ নিতে অর্থ পরিশোধ করতে হয় ক্রেডিট কার্ডে। দেশে এসব জুয়ার সাইট নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এজেন্ট। অনেক ক্ষেত্রে মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয় জুয়ার টাকা। সেলিমের টি-২১ ও পি-২৪ চালাতে মোবাইল ফোনে আগে অ্যাপস ডাউনলোড করতে হতো। অনেক খেলার জন্য চিপস বা জুয়ার কয়েন কিনতে হয় ডিলারদের কাছ থেকে। ফেসবুকে পেজ খুলে অনেক জুয়াড়ি চিপস বিক্রি করে। খেলায় হারলে আগে দেওয়া টাকা বা চিপস খোয়া যায়। জিতলে লাভসহ ফেরত আসে। এমন চিপস বিক্রি করার ১৫টি এজেন্টের সন্ধান পেয়েছে র‌্যাব। সব মিলে ১৫০টি সাইটের গেটওয়ের তথ্য মিলেছে। তদন্তকারীরা জানান, উত্তর কোরিয়ার ‘দো’ ছাড়াও কয়েকজন বিদেশির ব্যাপারে তথ্য মিলেছে, যারা দেশে অনলাইন ক্যাসিনো কারবারের মার্কেটিং করে।

ভয়ংকর জুয়া ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ অনলাইনে ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ নামের এক ভয়ংকর জুয়া চলছে। কয়েকজন ভারতীয় বিদেশে বসেই এ খেলা পরিচালনা করে। বাংলাদেশে রয়েছে তাদের কয়েক শ ডিলার। তিন পাত্তি গোল্ড একটি অ্যানড্রয়েড অ্যাপ। এর মাধ্যমে চলছে ভার্চুয়াল জুয়া। প্রতিদিন ভার্চুয়াল বোর্ডে লেনদেন হয় কোটি কোটি চিপস (জুয়ার কয়েন)। ডিলারদের ফেসবুক পেজের কমেন্ট বক্স থেকে নম্বর পায় জুয়াড়িরা। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এক জুয়াড়ি বলেন, তিন পাত্তি গোল্ড হচ্ছে ‘তিন তাসের খেলা’। খেলার সবচেয়ে বড় কার্ড হলো তিন টেক্কা আর সর্বনিম্ন কার্ড ২-৩-৫। এ গেমের মূল বস্তুটি হচ্ছে চিপস বা কয়েন। এক কোটি চিপসের মূল্য ছয় মাস আগেও ছিল ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। এখন ৭০-৮০ টাকায় পাওয়া যায়। গেমের ভেতর থেকেই ডলারের বিনিময়ে কম্পানি তাদের চিপস বিক্রি করে। কিন্তু গেম কম্পানির কাছ থেকে ডলারের মাধ্যমে চিপস কেনা অনেকেরই সাধ্যের বাইরে, কারণ তারা চিপসের মূল্য অনেক বেশি নেয়। অনেক খেলোয়াড়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই তাই তারা চিপস বা জুয়ার কয়েন কেনে ডিলারদের কাছ থেকে ৬৭টি গ্যাম্বলিং সাইট বন্ধ করল সরকার সেলিম ধরা পড়ার পর ‘সাইবার থ্রেট ডিটেকশন অ্যান্ড রেসপন্স’ প্রকল্প থেকে গতকাল ৬৭টি গ্যাম্বলিং সাইট বন্ধ করা হয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউব বা গুগলের মতো ওয়েবসাইট থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব ও সামাজিক মূলবোধ পরিপন্থী নির্দিষ্ট কোনো কনটেন্ট অপসারণে বিদেশি কর্তৃপক্ষের কাছে যাতে ধরনা দিতে না হয়, তার জন্যই ‘সাইবার থ্রেট ডিটেকশন অ্যান্ড রেসপন্স’ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর মাধ্যমে ফেসবুক বা ইউটিউবে কোনো আপত্তিকর মন্তব্য, পোস্ট বা ভিডিও দেশের বাইরে দেখা গেলেও বাংলাদেশে দেখতে না পারার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পটি চূড়ান্তভাবে গ্রহণের আগে এর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। আগামী ৩১ ডিসেম্বর এটি বিটিআরসির কাছে হস্তান্তর করা হবে। বিটিআরসিই এটি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে। ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টার বা এনটিএমসিও এটি ব্যবহার করতে পারবে। ১৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প থেকে গত মে মাস পর্যন্ত ২২ হাজার পর্নো এবং আড়াই হাজারের মতো গ্যাম্বলিং সাইট বন্ধ করা হয়। এটি বাস্তবায়ন করছে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকায় অবস্থিত টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তর। সেখানেই স্থাপন করা হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে দেশের ২৯টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) এবং তিনটি ন্যাশনাল ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জ (নিক্স)।

এ প্রকল্প ও অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন অপরাধ সম্পর্কে মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, পর্নো ও জুয়া সম্পর্কে আমাদের অবস্থান হচ্ছে জিরো টলারেন্স। কিন্তু এ অপরাধের বিশালত্ব হচ্ছে রাক্ষসের মতো। রাক্ষস বধ করলেও তার রক্তের ছিটা থেকে যেমন অনেক রাক্ষস জন্ম নেয়, তেমনি পর্নো ও জুয়া সাইটগুলো বন্ধ করলে হাজারটা বিকল্প সাইট তৈরি হয়ে যায়। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।

এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায় সেলিম ধরা পড়ার নতুন যে ৬৭টি গ্যাম্বলিং সাইট বন্ধ করা হয়েছে, সেগুলো সবই ক্যাসিনোসংক্রান্ত। সাইটগুলোর ওয়েব অ্যাড্রেসে ক্যাসিনো শব্দটি যুক্ত ছিল। ক্যাশ সার্ভারের মাধ্যমেও এই অনলাইন জুয়া চলছে।

এদিকে গতকাল সেলিম প্রধান ও তাঁর সহযোগীদের আসামি করে রাজধানীর গুলশান থানায় দুটি মামলা দায়ের করেছে র‌্যাব। একটি মামলা করা হয়েছে মানি লন্ডারিং আইনে, অন্যটি মাদক আইনে। মানি লন্ডারিং মামলায় সেলিমসহ আটজনকে আসামি করা হয়েছে, যার মধ্যে উত্তর কোরিয়ার তিন নাগরিকও রয়েছেন। মাদক আইনে করা মামলায় সেলিমকে সাত দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেছে পুলিশ। মানি লন্ডারিং আইনের মামলার অন্য আসামিরা হলেন সেলিমের ব্যক্তিগত সহকারী রোমান, সীমান্ত রনি, শান্ত, আক্তারুজ্জামান, উত্তর কোরিয়ার নাগরিক মি. তু, লি ও লিম। মাদক মামলায় সেলিমের সঙ্গে রোমান ও আক্তারুজ্জামানকে আসামি করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত সোমবার দুপুরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট থেকে নামিয়ে আনা হয় সেলিম প্রধানকে। ওই রাতে গুলশানের ২ নম্বর এভিনিউর ৯৯ নম্বর সড়কের ১১/এ নম্বর বাড়ি এবং মঙ্গলবার দুপুরে বনানীর ২ নম্বর সড়কের ২২ নম্বর বাড়িতে সেলিমের বাসা-কাম-অফিসে অভিযান চালায় র‌্যাব। এসব অভিযানে ২৯ লাখ পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা, ৭৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকার সমপরিমাণ ২৩টি দেশের মুদ্রা, ১২টি পাসপোর্ট, ১৩টি ব্যাংকের আট কোটি টাকার ৩২টি চেক, ৪৮ বোতল বিদেশি মদ, একটি বড় সার্ভার, চারটি ল্যাপটপ ও দুটি হরিণের চামড়া উদ্ধার করা হয়। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে সেলিমকে কারাগারে পাঠান র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/10/03/821837