গুলিস্তানের ফুটপাথ দখল করে গড়ে উঠেছে স্থায়ী দোকান। রোদ থেকে রক্ষার জন্য উপরে কাপড়ের ছাউনী দেয়া হয়েছে। ফুটপাথ পুরো দখলের পর হকাররা রাস্তায় বসিয়েছে জুতার দোকান। তাতে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়ে যানজট লেগে থাকলেও সেদিকে কারও নজর নেই -মতিউর সেন্টু
৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, শনিবার, ১২:০৬

ফুটপাথ দখলের রাজত্ব

টাকার বিনিময়ে সুযোগ দিচ্ছে পুলিশ : নীরব সিটি কর্পোরেশন

রাজধানীতে পথচারীদের চলাচলের জন্য ফুটপাথ আছে ৫১৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন এলাকায় ২৯২ কিলোমিটার ফুটপাথ রয়েছে, উত্তর সিটিতে আছে ২২৩ কিলোমিটার। উত্তর সিটি কর্পোরেশনে অবশ্য বেশিরভাগ ফুটপাথ হকারমুক্ত করা হয়েছে। তবে দক্ষিণের অভিজাত এলাকার সামান্য অংশ বাদ দিলে পুরো এলাকার অধিকাংশ ফুটপাথই কোনো না কোনোভাবে বেদখল হয়ে আছে। দক্ষিণের গুলিস্তান, মতিঝিল, পল্টনের মতো ব্যস্ত এলাকার ফুটপাথ দখল করে রেখেছে হকাররা। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের ফায়দা নিচ্ছে পুলিশ, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা ও লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজরা। এ ছাড়া দুই সিটিতেই ফুটপাথের ওপর কোথাও গাছ, কোথাও আবার বিদ্যুৎ বা টেলিফোনের খুঁটি, সুইচ বক্স। কোথাও ফুটপাথজুড়ে বসেছে ফুটওভার ব্রিজের খুঁটি, সিঁড়ি। আছে পুলিশ বক্সও। বিভিন্ন বিপণিবিতানের সামনে ফুটপাথের দখল করে নিয়েছে যানবাহন। এসব কারণে ফুটপাথ শুধু নামেই আছে, পথচারীদের হাঁটার অবস্থা নেই।

রাজধানীর গুলিস্তানের ফুটপাথ যেনো টাকার খনি। প্রতিদিন এই ফুটপাথ থেকে টাকা তোলা হয় প্রায় ৬ লাখ টাকা। মাস শেষে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এই টাকা যায় রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ, মাস্তান, প্রভাবশালী ও লাইনম্যানদের পকেটে। এ কারণে ফুটপাথ উচ্ছেদ করতে গেলেই বাধা আসে। অস্ত্রহাতে ছুটে আসে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। সরেজমিনে দেখা গেছে, গুলিস্তান এলাকার ফুটপাথ দখল করে একেবারে স্থায়ী দোকান বসিয়ে ফেলেছে হকাররা। শুধু তাই নয়, ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তার সিংহভাগ এখন হকারদের দখলে। যান চলাচলের জন্য রাস্তার একটা লেন কোনোমতে খালি। সেখান দিয়ে যান চলাচল করতে গিয়ে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের মাথায় প্রতিনিয়ত যানজট লেগেই থাকে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু এভিনিউ হয়ে ফুলবাড়ীয়া মোড়েও পুরান ঢাকাগামী গাড়ির দীর্ঘ সারি থাকে সারাদিনই। রাস্তা দখল করে হকারদের দোকানের কারণে গুলিস্তান আন্ডারপাস থেকে ফুলবাড়ীয়ার দিকে যাওয়ার উপায় নেই। জিরো পয়েন্ট হয়ে ঘুরে যেতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তারা ওই রাস্তায় রেকার রাখার ছলে পুরো রাস্তা বন্ধ করে হকারদের বসার সুযোগ করে দেন। শুক্র ও শনিবার বাদে প্রতিটি কর্মদিবসে পিকআওয়ারে গুলিস্তান পুরনো সিনেমা হলের সামনে এ দৃশ্য দেখা যায়। এ ছাড়া সুন্দরবন মার্কেটের দুদিকের রাস্তা বন্ধ করে হকারদের বসার সুযোগ করে দেয় পুলিশ।

হকারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গুলিস্তানে ফুটপাথ আছে ৩০টি। এসব ফুটপাথে হকারদের দোকান আছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার। এর মধ্যে ২ হাজার ৫০২ জন সিটি কর্পোরেশনের তালিকাভুক্ত। বাকিরা তালিকাভুক্ত নয় এবং বেশিরভাগই রাস্তা দখল করে দোকান বসায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই সাড়ে ৪ হাজার দোকান থেকে প্রতিদিন গড়ে দেড়শ’ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। প্রতিদিন এই চাঁদার পরিমাণ কমপক্ষে ৬ লাখ টাকা। মাস শেষে যা হয় ১ কোটি ৮০ লাখ।

জানা গেছে, গুলিস্তানের ৩০টি ফুটপাথে চাঁদা তোলার জন্য ৩০ জন লাইনম্যান আছে। প্রতিটি লাইনম্যানের আবার একজন করে সহকারী আছে। লাইনম্যান ও তাদের সহকারী মিলে ৬০ জনের আবার একজন নেতা, একজন ক্যাশিয়ার ও একজন সহকারী আছে। ৬০ জনের এই নেতার নাম বাবুল। এর সহকারী আমীন ও শাহীন। ৬৩ জনের এই সিন্ডিকেটকে রক্ষার জন্য রাজনৈতিকভাবে সরকার সমর্থক একটি সংগঠনও বানানো হয়েছে। যার সভাপতি আবুল হাশেম কবীর। জানা গেছে, গুলিস্তানের ফুটপাথের প্রতিটি দোকান থেকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা তোলা হয়। যারা সরাসরি এই চাঁদা তোলে তারা সব সময় থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। লাইনম্যান নামধারী এসব চাঁদাবাজদের পেছনে রয়েছে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশ। এ কারণে তারা কাউকে তোয়াক্কা করে না। হকাররা তাদের কাছে জিম্মি। হকারদের ভাষায়, কথায় কথায় এরা লাঠিপেটা করে, অপমান করে, মালামাল কেড়ে নেয়।

অনুসন্ধানে গুলিস্তানের লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজদের নাম জানা গেছে। এরা নিজ নিজ দখলে থাকা ফুটপাথ থেকে প্রতিদিনই চাঁদা তোলে। এরা হলো- আমীর হোসেন, রজ্জব, কানা সিরাজ, লম্বা হারুন, হারুনের শ্যালক দেলোয়ার, খোরশেদ, হাসান, হিন্দু বাবুল, সেলিম, জজ, ছালেক, রব, সুলতান, লিপু, মনির, আখতার, জাহাঙ্গীর, কালা নবী, সর্দার ছালাম, শহীদ, দাড়িওয়ালা সালাম, আলী মিয়া, কাদের, চাটগাইয়া হারুন, সাজু, ঘাউরা বাবুল, লম্বা শাজাহান ও বিমল।

হকারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উচ্ছেদ অভিযান শুরু হলে এরা তৎপর হয়ে ওঠে। সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতাদের কাছে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। এমনকি উচ্ছেদ অভিযান পন্ড করার জন্য তারা ‘মাস্তান’ বাহিনীও ঠিক করে রাখে। এজন্য এরা লাখ লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করে না। আলাপকালে একজন লাইনম্যান জানান, ফুটপাথে কেউ ইচ্ছা করলেই চাঁদাবাজি করতে পারে না। এজন্য নেতার অনুমতি লাগে। পেছনে ‘লোক’ লাগে। তাদের পেছনেও সরকার দলীয় ‘লোক’ রয়েছে। ফুটপাথের চাঁদার টাকার ভাগ ওই সব নেতাও পায়। তারাই পেছন থেকে লাইনম্যানদের শক্তি জোগায়। এই শক্তির বলেই চলে লাইনম্যানরা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হকার্স লীগ ও বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এম এ কাশেম বলেন, চলতি বছর প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একনেক সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হকারদেরকে পুনর্বাসন করা হবে। লাইনম্যান নামধারী দক্ষিণ সিটির চাঁদাবাজি মামলার আসামিদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা চাই তালিকাভুক্ত হকারদের কাছে থেকে সরকার রাজস্ব আদায় করুক। তাহলে এ চাঁদাবাজি এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে।

এদিকে, হকার ছাড়াও ফুটপাথ দখলের অনেক অনুষঙ্গ আছে। মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের সামনে ফুটওভার ব্রিজের খুঁটি ও সিঁড়ি করা হয়েছে ফুটপাথের ওপর। তাতে পুরো ফুটপাথই দখল হয়ে গেছে। মহাখালীর আমতলী থেকে গুলশানের দিকে যেতে দু’পাশের ফুটপাথে অনেক জায়গায় ভাঙা, কোথাও দখল করে রাখা হয়েছে দোকানের জিনিসপত্র রেখে। সেতু ভবন থেকে আমতলী সিগন্যাল পর্যন্ত রাস্তার একপাশে ফুটপাথ অপ্রশস্ত। দু’জন পথচারী পাশাপাশি হাঁটতে কষ্ট হয়।

মহাখালী রেলক্রসিং থেকে আমতলী হয়ে কাকলী পর্যন্ত ফুটপাথের বিভিন্ন অংশে থাই অ্যালুমিনিয়ামের দোকানের জিনিসপত্র রেখে কাজ করা হচ্ছে। গুলিস্তান পার্কের দক্ষিণ পাশের রাস্তায় ফুটপাথ বলে কিছু নেই। রাস্তার একপাশ ভাঙাচোরা, সেখানে বিভিন্ন পরিবহনের কাউন্টার করা হয়েছে।

সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের কাছে নতুন ফুটপাথ করেছে ডিএসসিসি। প্রশস্ত এ ফুটপাথের একটি অংশে আবার যাত্রী ছাউনি করা হয়েছে। ছাউনির একপাশে একটি টিকেট কাউন্টার ফুটপাথের পুরোটাই খেয়ে ফেলেছে।

মতিঝিল স্টক এক্সচেঞ্জ ভবন থেকে সোনালী ব্যাংক প্রধান কার্যালয় পর্যন্ত ফুটপাথ হকারদের দখলে। একই রাস্তার অর্ধেকের বেশি অংশজুড়ে গাড়ি পার্কিং করা থাকে। রাস্তার বিপরীতেও একই চিত্র। এসব কারণে কর্মদিবসে এই রাস্তায় যানজট লেগেই থাকে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানী ঢাকার বেশিরভাগ ফুটপাথের নকশায় ত্রুটি আছে। ফলে দখল না হওয়া যেটুকু ফুটপাথ খোলা আছে, তাও অনেক ক্ষেত্রে পথচারীদের চলার উপযোগী নয়। অথচ ফুটপাথ পথচারীবান্ধব হলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে যেত।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবে, সারাদেশে দুর্ঘটনায় নিহতের ৪৩ শতাংশই পথচারী। আর ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে পথচারীর সংখ্যা ৪৭ শতাংশ। বুয়েটের সহযোগী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, রাজধানীতে সড়কে নিহতদের একটি বড় অংশ রাস্তায় চলতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। ফুটপাথ ব্যবহারের উপযোগী না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই পথ চলেন রাস্তার পাশ দিয়ে। ফুটপাথগুলো পথচারীবান্ধব হলে এ ধরনের দুর্ঘটনা কমে যেত।

https://www.dailyinqilab.com/article/232375/