৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, বুধবার, ১:৫৪

সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বরূপ

ইবনে নূরুল হুদা : ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলো দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যকর সংসদ, জবাবদিহিমূলক সরকার, আইনের শাসন ও কালাকানুন বাতিলসহ মৌলিক মানবাধিকার, সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দীর্ঘদিনে সেসব স্বপ্ন আজও প্রায় অধরায় রয়ে গেছে। দুর্বার গণআন্দোলনের সাফল্য পাওয়া গেলেও গণতন্ত্রকে এখনো শৃক্সক্ষলমুক্ত ও মজবুতভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। রাজনীতিতে অস্ত্র, কালো টাকা, নির্বাচনে অনিয়মের সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। ফলে দেশে সুশাসনও নিশ্চিত করা যায়নি। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের পরিবর্তে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলেও তার সুফলগুলো আজও আমাদের নাগালের বাইরে। যা একটি স্বাধীন জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনকই বলতে হবে।

একটি দলনিরপেক্ষ ও দক্ষ প্রশাসনের স্বপ্ন আমাদের দীর্ঘদিনের হলেও অতীতের স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক সরকারের আদলেই দেশে দলীয়করণ অব্যাহত আছে। ফলে শুধু আইনের শাসনের ব্যত্যয় ঘটছে না বরং ক্ষমতার ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। আমলাতন্ত্র ও আইন-শৃক্সক্ষলা বাহিনীর মধ্যে অনাকাক্সিক্ষতভাবে রাজনীতির চর্চা ও দলীয় আনুগত্য প্রবল হয়ে উঠেছে। এমনকি রাজনীতিবিদরা নিজেদের রক্ষা ও পৃষ্ঠপোষকতার জন্য আইন-শৃক্সক্ষলা বাহিনী ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যপহার করছেন বলে অভিযোগ আরও জোরালো হয়েছে। নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালতের সকল পর্যায়ে দলীয়করণ ও রাজনীতিবিদদের প্রভাব মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিকে বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে দেশে অপরাধীদের দৌড়াত্ম্য, অপরাধপ্রবণতা ও দুর্নীতি এখন প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। মূলত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ও কার্যকর সংসদের অনুপস্থিতি, গণতন্ত্র-গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দুর্বলতা এবং আইন ও সাংবিধানিক শাসনের অভাবে আমরা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়নি।

একটি প্রতিনিধিত্বমূলক কার্যকর সংসদ গঠিত হতে হলে সে সংসদকে অবশ্যই গঠিত হতে হবে অবাধ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতার বিষয়টি খুবই স্পষ্ট। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ কখনোই কার্যকর বা ফলপ্রসূ হয় না। আর সংসদীয় ব্যবস্থা এমন এক প্রকার শাসনব্যবস্থা, যাতে সর্বময় ক্ষমতা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সংসদের ওপর ন্যস্ত থাকে। যুক্তরাজ্য, ভারত ও বাংলাদেশসহ বহু দেশেই সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা রয়েছে। এই ব্যবস্থায় সংসদের কার্যক্রম, দলীয়ব্যবস্থার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য, কার্যকারিতা, শাসনপ্রক্রিয়া, আমলাতন্ত্র, সুশীল সমাজ ও সংশ্লিষ্ট কাঠামোর ভূমিকা, মানব নিরাপত্তা, স্থানীয় শাসন, উন্নয়নকার্যক্রমের প্রকৃতি প্রভৃতি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। ১৯৯১ সাল থেকে আমাদের দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা নতুন করে চালু হলেও তা এখনও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। আমাদের স্বাধীনতার প্রায় ৫ দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে গতিশীল রাষ্ট্রীয় কাঠামো, সময়োপযোগী গণপ্রশাসন এবং সুশাসন নিশ্চিত হওয়াই কাক্সিক্ষত ছিল । কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি।

একথা সর্বজনবিদিত যে, বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদীয় ব্যবস্থা অধিকতর কল্যাণকর, কার্যকর, গতিশীল ও ক্রিয়াশীল। ১৯৭৩ সালে নতুন সংবিধানের অধীনে প্রথম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অবশ্য তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। একথা কারো অজানা নয় যে, ১৯৭৫ সালের প্রথমেই বহুদলীয় ও সংসদীয় ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়। ১৯৭৫ সালে দেশে অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনকভাবে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের ফলে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার অভিযাত্রা শুরু হলেও সংসদীয় ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়নি। অবশ্য ১৯৯১ সালে দেশে নতুন করে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, সংসদীয় পদ্ধতি বলতে যা বোঝায় তা আজও আমাদের হাতে এসে ধরা দেয়নি। নেতিবাচক ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে এর সুফলগুলোও আমরা পুরোপুরি ঘরে তুলতে পারিনি।

বস্তুত সংসদীয় ব্যবস্থার মূল চেতনাই হচ্ছে বহুদলীয় গণতন্ত্র। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের সংসদগুলো যেভাবে গঠিত হচ্ছে এবং যে পদ্ধতিতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে তা সংসদীয় পদ্ধতির সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ নয়। একথা বললে অত্যুক্তি হবার কথা নয় যে, বিগত ১০ম সংসদ ছিল একদলীয়। তারপরও এই সংসদ সংসদীয় পদ্ধতির রূপরেখা হিসেবে চলেনি। বিষয়টি নিয়ে গত বছরের শুরুতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদন ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’এ তুলে ধরেছিল। যা আমাদেরকে হতাশই করেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নির্ধারিত সময়ে সংসদ সদস্যরা অধিবেশনে উপস্থিত না হওয়ায় কোরাম সঙ্কট ছিল উল্লেখ করার মত। ২০১৭ সালে সংসদে গড়ে প্রতিদিন কোরাম সঙ্কটে অপচয় হয়েছে ৩০ মিনিট। যা নবম সংসদে ছিল ৩২ মিনিট। এই অনুপস্থিতির কারণে ১০ম সংসদের প্রথম চার বছরে অপচয় হয়েছে ১২৫ কোটি ২০ লাখ ৬৯ হাজার ৪৪৫ টাকা। যা আমাদের মত দারিদ্য্রপীড়িত রাষ্ট্রের জন্য মোটেই কাক্সিক্ষত ছিল না।
সংসদে অনুপস্থিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিপুল আর্থিক ক্ষতির একটি হিসাবের পাশাপাশি এটাও স্পষ্ট হয়েছে যে, সংসদ সদস্যরা সংসদের গুরুত্ব উপলব্ধি এবং যথাসময়ে সংসদে উপস্থিত হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। আসলে ১০ম সংসদের সদস্যদের বেশির ভাগই সদস্যই বিনাপ্রতিদ্বন্দি¦তায় ‘নির্বাচিত’ ছিলেন। যেহেতু ১০ম সংসদ ছিল কার্যত বিরোধী দলবিহীন তাই তাদের দেরিতে সংসদ অধিবেশনে আসার বিষয়টি কারো কাছেই তেমন গুরুত্ব পায়নি।

সংসদ হচ্ছে আইন প্রণেতাদের সভা। কিন্তু টিআইবির গবেষণায় বলা হয়েছে, ১০ম সংসদ আইন প্রণয়ের কাজে অত্যন্ত স্বল্প সময় ব্যয় করেছে। অথচ অনির্ধারিত আলোচনায় ব্যয় করেছে অনেক বেশি সময়। সরকারের প্রশংসাসূচক আলোচনা হয়েছে মোট সময়ের দশমাংশ। দেশের সমস্যাগুলোর মধ্যে দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রকট হলেও সংসদে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা মোট সময়ের মাত্র চার শতাংশ। বিরোধী দলহীন সংসদের মূল্যবান সময়ের ২৬ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে রাজপথের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের অনর্থক সমালোচনা করে। সংসদের কার্যপ্রণালীবিধিতে সরকারের জবাবদিহি করার অনেক সুযোগ রয়েছে। বিধিতে মন্ত্রীদের প্রশ্নোত্তরসহ বিভিন্ন আলোচনা ও প্রশ্নোত্তরের পদ্ধতি বিধৃত রয়েছে।

সে অনুসারে যদি সদস্যরা আলোচনায় অংশ নেন তবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অনেক বিষয় জানার সুযোগ থাকে এবং সরকার কিভাবে দেশ চালাচ্ছে, তাদের দুর্বলতা কোথায়, তা জানারও সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিন্তু যেহেতু ১০ম সংসদে প্রকৃত বিরোধী দলের কোনো সদস্য ছিল না তাই এই বিষয়ে আলোচনার সুযোগও ছিল না। সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশে সংসদের বিরোধী দলের বিশেষ মর্যাদা এবং ভূমিকার গুরুত্ব রয়েছে। কোনো কোনো দেশে বিরোধী দলের ছায়া মন্ত্রিসভা থাকে। সংসদকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে যেমন নির্বাচিত সদস্যদের গুরুত্ব সর্বাধিক, তেমনি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনেরও রয়েছে গুরু দায়িত্ব। আর আমাদের সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে সেজন্য সর্বময় কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা দিয়েছে। অথচ এই দায়িত্ব ও ক্ষমতা পাওয়া সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জাতির প্রত্যাশা পূরুণে সমর্থ হননি। যা রাষ্ট্রীয় সংবিধানের সুুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং দেশ ও জাতির সাথে প্রতারণা বলেই প্রতীয়মান।

সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি সরকারের ভূমিকা ও সদিচ্ছা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে পুরোপুরি সফল হওয়াও সম্ভব নয়। যেহেতু নির্বাচনের আগে থেকেই ক্ষমতাসীন দল সরকারে থাকে, তাই তারা নির্বাচন পরিচালনার সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পুরিপুরি সক্ষম। ফলে সরকারের হস্তক্ষেপ থাকলে সরকারি কর্মকর্তাদের পক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করা সম্ভব হয় না। আর সে জন্যই সরকারের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিগুলো নির্বাচনের সময় দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করে আসছে। আর এর যৌক্তিকতার বিষয়টিও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কারণ, অতীতে দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে প্রায় সকল নির্বাচনই অবাধ, নিরপেক্ষ ও অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। [চলবে]

https://www.dailysangram.com/post/388348