পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। ছবি: যুগান্তর
৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, মঙ্গলবার, ১:০৯

কৌশলে বাড়ানো হচ্ছে প্রকল্পের ব্যয়, কঠোর অবস্থানে পরিকল্পনা কমিশন

গাড়ি, ভাতা, বিদেশ সফরসহ নানা আকর্ষণ রয়েছে -ড. শামসুল আলম * ছোট প্রকল্প অনুমোদনে কঠোর হতে হবে -ড. জাহিদ হোসেন

উন্নয়ন প্রকল্পে কৌশলে ব্যয় ও সময় বাড়ানো হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের লোভের শিকার হচ্ছে এসব প্রকল্প। এতে একদিকে দেশ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে প্রকল্পের কাঙ্ক্ষিত সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

এমন অবস্থায় কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন। ৬ আগস্ট অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় শুধু বাস্তব প্রয়োজন ছাড়া প্রকল্প সংশোধন প্রস্তাব বিবেচনা না করতে মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং পরিকল্পনা কমিশনের সেক্টরগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এর আগে বলেছেন, প্রকল্প সংশোধনের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেয়া হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে তিন বার কোনো প্রকল্প সংশোধনের জন্য প্রস্তাব এলে তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে উপস্থাপন করা হবে।

প্রয়োজনে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এরকম প্রকল্পের একটি আলাদা তালিকা তৈরি করা হবে। কোনো ক্রমেই বারবার প্রকল্প সংশোধন কাম্য নয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সিডিউল রেট পরিবর্তন, ডিজাইন পরিবর্তন, স্পেসিফিকেশন পরিবর্তন, ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয় বৃদ্ধি, নতুন আইটেম অন্তর্ভুক্ত বা কর্মপরিধি বৃদ্ধির নামেই কৌশলে প্রকল্প সংশোধন করা হয়। কিন্তু এর পেছনে থাকে অন্য উদ্দেশ্য। কেননা প্রকল্প যতদিন চলবে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা ততদিন সুবিধা নিতে পারবেন।

এ বিষয়ে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পে আকর্ষণের তো শেষ নেই। এখন যেমন পুকুর খনন প্রকল্পে এবং ভিটামিন ‘এ’ খাওয়ানো প্রকল্পেও বিদেশ সফর যুক্ত করা হয়।

তাছাড়া প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহার, ভাতা নেয়াসহ নানা সুবিধার কারণে সংশ্লিষ্টরা চান না দ্রুত প্রকল্প শেষ হয়ে যাক। তাছাড়া প্রকল্প তৈরির সময়ই দক্ষতার অভাব থাকে। যেনতেনভাবে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ফলে বাস্তবায়ন পর্যায় এসে ডিজাইন পরিবর্তন, নতুন অঙ্গ সংযোজন করতে হয়।

সূত্র জানায়, পরিকল্পনামন্ত্রীর সভাপতিত্বে ৬ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮-১৯ অর্থবছরের আরএডিপি বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের এডিপির সুষ্ঠু ও গুণগত বাস্তবায়ন বিষয়ক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা।

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সস্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভার কার্যবিবরণী সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের অক্টোবরে পরিকল্পনা বিভাগ থেকে একটি পরিপত্র জারি করে প্রকল্প সংশোধনকে নিরুৎসাহিত করা হয়।

কিন্তু বাস্তবে প্রতিটি প্রকল্প এক বা একাধিকবার সংশোধন করা হয়ে থাকে। প্রকল্প সংশোধনের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে যথাযথ সমীক্ষা ও কারিগরি ডিজাইন ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ করা।

আরও বলা হয়েছে, সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে প্রাথমিকভাবে ছোট কলেবরে প্রকল্প গ্রহণ করে অনুমোদনের পর বাস্তবায়ন পর্যায়ে প্রকল্পের কলেবর বৃদ্ধি করে প্রকল্প সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়।

এতে চলমান প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না। প্রকল্পের কাজের বাস্তবায়ন অগ্রগতি যেমন বাধাগ্রস্ত হয়, তেমনি যথাসময়ে প্রকল্পের সুবিধা হতেও জনগণ বঞ্চিত হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি সামগ্রিকভাবে এডিপি বাস্তবায়ন অগ্রগতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

এক্ষেত্রে গৃহীত কার্যক্রম অনুমোদিত মেয়াদে সম্পন্ন করে নতুন কার্যক্রম নিয়ে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা অধিকতর যুক্তযুক্ত। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, প্রকল্পের শুরুতেই সতর্ক হতে হবে।

বিশেষ করে ছোট প্রকল্পের ক্ষেত্রে কঠোরভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে ছোট দিয়ে শুরু করে প্রকল্প যাতে বড় না হয়।

তিনি আরও বলেন, প্রকল্প চললে ক্ষমতা, ভাতা, গাড়িসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি স্বজনপ্রীতি করে আত্মীয়স্বজনদেরও চাকরি দেয়া যায়। এত সুবিধার আকর্ষণ কেউ সহজেই ছাড়তে চান না।

সূত্র জানায়, এডিপি তৈরিতে নির্দেশনা মানছে না মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) এডিপিতে ৫৮টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছিল। অথচ এসব প্রকল্প ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মধ্যেই সমাপ্ত করার কথা ছিল। সেজন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দসহ বারবার তাগাদাও দেয়া হয়েছিল।

কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। এ অবস্থাকে অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে সমস্যা এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা বলে মনে করে পরিকল্পনা কমিশন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১২টি প্রকল্পকে সমাপ্ত ঘোষণা করে এডিপি থেকে বাদ দেয়ার সুপারিশ করা হয়।

এছাড়া ৩৭টি প্রকল্পে এক লাখ টাকা করে বরাদ্দ দিয়ে চলমান রাখার প্রস্তাব করা হয়েছিল। ইতোমধ্যেই বাকি ৯টি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। মে মাসে অনুষ্ঠিত কমিশনের বর্ধিত সভায় এসব তথ্য উপস্থাপন করা হয়।

আইএমইডি সূত্র জানায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ওই অর্থবছরে মোট ১ হাজার ৭৪০টি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। তার মধ্যে সমাপ্ত হয়েছিল ২৪৬টি প্রকল্প।

বাকি প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৯০টি প্রকল্পের অনুকূলে ৯১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও এক টাকাও ব্যয় হয়নি। আর্থিক অগ্রগতি ছিল শূন্য। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, নতুন প্রকল্পের দরপত্র আহ্বানে বিলম্ব, ঋণ না পাওয়া, অর্থছাড় না হওয়া বা দেরিতে অর্থছাড় হওয়া, ভূমি অধিগ্রহণ না হওয়া, মামলাজনিত সমস্যা, প্রকল্প সংশোধন, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সঙ্গে চুক্তিতে বিলম্ব এবং নামমাত্র বরাদ্দ ইত্যাদি।

এছাড়া ৯৮টি প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি ছিল শূন্য। ওই অর্থবছরের ২৫টি প্রকল্পের অনুকূলে মাত্র ১ লাখ টাকা করে বরাদ্দ ছিল, যার বিপরীতে দুটি প্রকল্প ছাড়া বাকিগুলোর কোনো আর্থিক অগ্রগতি হয়নি।

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ৪৩টি প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয়ের ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় শতভাগ হয়েছে। ২৪৪টি প্রকল্পে ৯০-৯৯ শতাংশ অর্থব্যয় হয়েছে। ২০১টি প্রকল্পে ৭৬-৮৯ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। ২৯০টি প্রকল্পে ৫১-৭৫ শতাংশ ব্যয় হয়েছে।

৩১০টি প্রকল্পে ২৬-৫০ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। ৪৯৭টি প্রকল্পে ২৫ শতাংশের নিচে অর্থব্যয় হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে ২৭৩টি প্রকল্পের আর্থিক এবং ১৯৩টি প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি সন্তোষজনক ছিল না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/216513/