৩১ আগস্ট ২০১৯, শনিবার, ২:১১

বিশেষ প্রকল্পে 'বিশেষ' লুটপাট

বর্ষা মৌসুমে জলমগ্ন হাওরে নারীদের স্বাবলম্বী করতে একটি বিশেষ প্রকল্প নিয়েছে সরকার। ভাসমান বোরো ধানের বীজতলা তৈরি, বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন এবং হাঁস-মুরগি পালনের মধ্য দিয়ে দারিদ্র্য দূর হবে- এ লক্ষ্যে সরকার হাওরের পাঁচ জেলার ২৮টি উপজেলায় এ প্রকল্প নেয়। একই প্রকল্পের আওতায় উৎপাদন বহুমুখীকরণ ও হাওর এলাকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মহিলা অধিদপ্তরের নেওয়া প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা সোসাইটি ফর ব্রাইট সোশ্যাল সার্ভিসেস (এসবিএসএস)। দুই বছর মেয়াদি এই পাইলট প্রকল্পটি গত বছরের ১ জুলাই শুরু হয়ে ২০২০ সালের ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা। ৬ কোটি ২৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকার এ প্রকল্পের ৪ কোটি টাকার বেশি এরই মধ্যে সংস্থাটি তুলে নিয়ে গেছে। অথচ কাজ হয়েছে সামান্যই। তাদের কাজের মধ্যে সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৬টির মধ্যে পাঁচ উপজেলায় কিছু প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ চলছে হবিগঞ্জের তিন উপজেলায়। প্রকল্পের মেয়াদ আর এক বছরও নেই, এখনও সেই প্রশিক্ষণেই সীমাবদ্ধ আছে সংস্থাটি।

সমকালের অনুসন্ধানে প্রকল্পের আরও নানা অনিয়মের বিষয়টি উঠে এসেছে। গত মে ও জুনে তড়িঘড়ি করে নামমাত্র প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে পাঁচ উপজেলায়। এখনও সদর উপজেলার প্রশিক্ষণ বাকি। অভিযোগ রয়েছে, বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এলাকা থেকে নারীর তালিকা না করে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো এমন এলাকার নারীদের বেছে নেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে উপকারভোগীদের প্রয়োজনীয় বীজ ও উপকরণ দেওয়া হয়নি। প্রশিক্ষণ শেষে সংস্থাটির পক্ষ থেকে উপকারভোগীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রক্ষা করা হয়নি। প্রশিক্ষণ ভাতা ও খাবার টাকা বাবদ জনপ্রতি সর্বোচ্চ ১৩শ' টাকা ছাড়া আর কোনো সুযোগ-সুবিধা তাদের ভাগ্যে জোটেনি। আবার এক উপজেলার নারীরা পেয়েছেন মাত্র এক হাজার করে টাকা। অথচ প্রকল্পের ডিজাইন অনুযায়ী একজন উপকারভোগীর হাঁসের খাবার, বীজ, উপকরণ, প্রশিক্ষণসহ ২২ হাজার পাঁচশ টাকার সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা।

সম্প্রতি আশুগঞ্জ উপজেলার আড়াইসিধা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের উপকারভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেকের হাঁস মরে গেছে। ভাসমান বেড তৈরির জন্য দেওয়া বাদা (বাঁশের তৈরি কাঠামো) অব্যবহূত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। আশপাশ এলাকায় ভাসমান বেড তৈরির জন্য কোনো জলাশয় নেই। কথা হয় আড়াইসিধা গ্রামের আঙ্গুর ভূঁইয়ার স্ত্রী রুমি বেগমের সঙ্গে। প্রশিক্ষণ শেষে শুধু ১৩শ' টাকা পাওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, বেড তৈরির জন্য তার বাড়ির আশপাশে কোনো পানি নেই। বাড়ির পাশের ডোবাটি সম্প্রতি বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ শেষে সংস্থার কেউ আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তাকে কোনো বীজও দেওয়া হয়নি। একই গ্রামের ভূঁইয়াপাড়ার মতিউর রহমানের স্ত্রী রোজিনা বেগমও একই কথা বললেন। তবে তিনি বাড়ির সামনের পুকুরে লাউ ও কুমড়ার জন্য মাচা তৈরি করেছেন। এটি ছাড়া ওই গ্রামের কোথাও ভাসমান বেড খুঁজে পাওয়া যায়নি।

একই উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের হাঁস পালনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একাধিক উপকারভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অনেকের হাঁস মরে গেছে। বাহাদুরপুর গ্রামের আবদুস সাত্তারের স্ত্রী সাহানা বেগম জানান, তার ১২টি হাঁসই মরে গেছে। প্রশিক্ষণের পর তাকে কম বয়েসি ১৫টি হাঁস ও ১০ কেজি খাবার দেওয়া হয়েছিল। পরে হাঁসের খোঁজ নিতে কেউ আসেনি। দুর্গাপুর গ্রামের আক্তার হোসেনের স্ত্রী জোমেলা খাতুন জানান, তার ১৫টির মধ্যে ১৩টি হাঁসই মরে গেছে। তবে একই গ্রামের সেলিম সিকদারের স্ত্রী খোদেজা খাতুনের ১৪টি হাঁসই পানিতে ভাসতে দেখা গেছে।

নাসিরনগরে সরেজমিনে ঘুরেও একই চিত্র পাওয়া গেছে। কথা হয় নাসিরনগরের গুনিয়াউক ইউনিয়নের চিতনা গ্রামের রীতা রানী পালের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রশিক্ষণকালীন ১৩শ' টাকা ও দুটি বাঁশের বাদা পেয়েছেন। তবে তার বাড়ির আশপাশে জলাশয় না থাকায় তিনি ভাসমান বেড তৈরি করতে পারেননি। তিনি সংস্থার পক্ষ থেকে বীজ বা অন্য কোনো সহযোগিতাও পাননি। এ উপজেলার সদর ইউনিয়নের কুলিকুন্ডা গ্রামের মজাদীঘি গোয়াল দীঘিতে গিয়ে কয়েকটি ভাসমান বেড দেখা গেছে। দীঘির পাড়ে এসবিএসএসের একটি ছোট সাইন বোর্ডও চোখে পড়ে। সংস্থার লোকজনই প্রশিক্ষণ চলাকালে শ্রমিক দিয়ে এসব বেড তৈরি করিয়েছিলেন। তবে ওই গ্রামের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীরা জানেন না এসব বেড কাদের জন্য এবং কী কারণে তৈরি করা হয়েছে। ওই গ্রামের আফতাব মিয়ার স্ত্রী রাহমিনা আক্তার জানান, সংস্থার লোকজন লোক দিয়ে কয়েকটি বেড তৈরি করেছে। এসব বেড আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে। কিন্তু এ বিষয়ে কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।

সরাইল উপজেলার সদর ইউনিয়নের উচালিয়া গ্রামের একটি ডোবায় কয়েকটি বাঁশের বাদা কঙ্কালের মতো ভাসতে দেখা গেছে। কথা হয় ওই গ্রামের প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী ইয়াছিন মিয়ার স্ত্রী মুনছুফা খাতুন, আবুল হোসেনের কন্যা মর্জিনা বেগম, আনার মিয়ার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম ও অলি মিয়ার কন্যা মাইমুনা আক্তারের সঙ্গে। তারা সবাই ক্ষোভের সঙ্গে জানান, তারা এসব বেড দুই দফায় তৈরি করলেও সংস্থার লোকজন বীজ না দেওয়ায় সবজি চাষ করতে পারেননি। সরাইল মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা ফাতেমা আক্তার জানান, প্রশিক্ষণ ঠিকঠাক মতো হলেও পরবর্তী কোনো খবর তিনি জানেন না।

বাঞ্ছারামপুর ও নবীনগর উপজেলায়ও একই অবস্থা। এসবিএসএস প্রশিক্ষণ দিয়েই তাদের দায় সেরেছে। অথচ প্রকল্পের ডিজাইন অনুযায়ী এসবিএসএসের নিয়োগপ্রাপ্ত জনবল দিয়ে প্রশিক্ষণ পরিচালনাসহ পরবর্তী কারিগরি সহায়তা এবং মাঠ পর্যায়ের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড তদারকি করার কথা। সে অনুযায়ী ৯ জন ডিপ্লোমা কৃষিবিদ ও একজন এমএসসি (এজি) কৃষিবিদকে দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেয় সংস্থাটি। প্রকল্পের ডিজাইন অনুযায়ী মোট বরাদ্দের ৩০ ভাগ নিয়োগপ্রাপ্ত লোকবলের বেতনভাতার জন্য নির্ধারিত রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ওইসব কৃষিবিদকে নিয়োগ দেওয়ার এক মাসের মধ্যেই নানা অভিযোগ তুলে অত্যন্ত অসম্মানজনকভাবে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়। সংস্থা থেকে চাকরি হারানো পিরোজপুর জেলার ডিপ্লোমা কৃষিবিদ শিশির কুমার বিশ্বাস জানান, বড় আশা নিয়ে ওই প্রকল্পে যোগ দিয়েছিলের। ভেবেছিলেন প্রকল্পটি যেহেতু সরকারি, ভবিষ্যতে হয়তো চাকরিটি সরকারি হবে। কিছুদিন না যেতেই স্বপ্নভঙ্গ হলো। কর্তৃপক্ষ একশজন শ্রমিকের কাজ ২৫ জনকে দিয়ে করানোর জন্য আমাদের বাধ্য করে। এক সময় এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়- আমরা চাকরি ছাড়তে বাধ্য হই।

এসব অনিয়মের ব্যাপারে এসবিএসএসের নির্বাহী পরিচারলক ফেরদৌস আহমদ অনেকটা উত্তেজিত হয়েই বলেন, কে বলেছে আমার লোকজন মাঠে নেই। গতকাল (বুধবার) আমার লোকেরা বাঞ্ছারামপুরে বীজ নিয়ে গেছে। শর্ত অনুযায়ীই প্রকল্পের কাজ চলছে। এ কথা বলেই তিনি ব্যাংকে আছেন বলে ফোন কেটে দেন।

এ ব্যাপারে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বদরুননেছা বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বলতে পারছি না। দেখে পরে জানাব।

https://samakal.com/whole-country/article/19082314/