ছোট্ট এই শিশুও ডেঙ্গু আক্রান্ত। রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চলছে তার চিকিৎসা। ছবি : কালের কণ্ঠ
৭ আগস্ট ২০১৯, বুধবার, ৯:৫৪

ডেঙ্গুর চেয়ে বেশি ছড়াচ্ছে ইনফ্লুয়েঞ্জা

► আরো ৯ জনের মৃত্যু ► আগস্টের প্রথম পাঁচ দিনেই হাসপাতালে ভর্তি ১১,৪৫১ জন

ডেঙ্গুতে প্রতিদিনই লম্বা হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। ফলে আতঙ্ক আর উদ্বেগ কাটছেই না। সরকার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় নানামুখী উদ্যোগ নিলেও দমছে না ডেঙ্গু। তবে এর আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে আরেক উদ্বেগজনক পরিস্থিতি। বিশেষ করে ঘরে ঘরে ও হাসপাতালে ছড়িয়ে থাকা জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৩০-৩৫ শতাংশ রোগীর শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাস পাওয়া গেলেও বাকিদের বেশির ভাগই আক্রান্ত হয়েছে অন্য কয়েকটি ভাইরাস ও জীবাণুতে। এর মধ্যে সোয়াইন ফ্লু, ভিক্টোরিয়া ইলনেস, এমনকি ইয়ামাগাতা ইলনেসের মতো ফ্লুও রয়েছে।

এদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় আরো ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে তিনজন। তাঁরা হলেন চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের মনোয়ারা বেগম (৭২), ফরিদপুরের হাবিবুর রহমান (২১) ও মানিকগঞ্জের শিবালয়ের কৃষক আমজাদ মণ্ডল (৫২)। ঢাকার আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে মারা যান ইতালিপ্রবাসী হাফসা লিপি (৩৪)। এ ছাড়া দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রবিউল ইসলাম (১৭) নামের এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছে রিহানা নামের তিন বছর বয়সী এক শিশু। রাজধানীর ধানমণ্ডি জেনারেল অ্যান্ড কিডনি হাসপাতালে মদিনা আক্তার নামের এক শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ডেঙ্গু নিয়ে রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হানিফ (৪২) গত সোমবার রাতে মারা গেছেন। মানিকগঞ্জের মুন্নু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগী রাজু খান (৪০) গত সোমবার ভোরে মারা গেছেন।

এদিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। ঢাকায় সংস্থাটির আবাসিক প্রতিনিধি ড. বর্ধন জং রানা বিবিসি বাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরই মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুরোধ পেয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. আয়েশা আক্তারের দেওয়া তথ্য অনুসারে, আগস্ট মাসের প্রথম পাঁচ দিনেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১১ হাজার ৪৫১ জন। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে দুই হাজার ৩৪৮ জন। ঢাকার ৪০টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে এক হাজার ২৮৪ জন। গতকাল সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে মিটফোর্ড হাসপাতালে ২৮৩ জন। আর ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে গতকাল নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে এক হাজার ৬৪ জন। গত ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত সারা দেশের হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয় ২৯ হাজার ৯১২ জন। এর মধ্যে ২১ হাজার ৯২১ জন চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। বাকি সাত হাজার ৯৬৮ জন বিভিন্ন হাসপাতালে গতকাল পর্যন্ত চিকিৎসাধীন ছিল। আর সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ জনে। তবে বেসরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি।

৭০ শতাংশ রোগীর অন্য ভাইরাসের কারণে জ্বর : সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সার্ভেইল্যান্সের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ২০ বছরের মধ্যে এবারই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। মৃত্যুও বাড়ছে সমান গতিতে। ডেঙ্গুর এত ব্যাপকতার মধ্যেও যারা জ্বরের উপসর্গ নিয়ে ডেঙ্গু সন্দেহে পরীক্ষা করতে আসছে তাদের মাত্র ৩০ শতাংশের ডেঙ্গু পজিটিভ হচ্ছে। কিন্তু বাকি ৭০ শতাংশ, যারা জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে তাদের শরীরে ডেঙ্গু না থাকলেও অন্য কী কারণে জ্বর হয়েছে সেটা নিয়েও শুরু হয়েছে পর্যবেক্ষণ।

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘অন্য কী কী কারণে এবারের জ্বরের প্রকোপ দেখা দিয়েছে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছি। এর মাধ্যমে অন্য কিছু ফ্লু ও ইনফেকশনের নমুনাও পাচ্ছি। তবে ওই প্রক্রিয়া এখনো চলমান রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সাধারণত এপ্রিল থেকেই বরাবর আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপ শুরু হয়, যা চলতে থাকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। আর ডেঙ্গু শুরু হয় আরো কিছু সময় পরে। কিন্তু এবার অনেকটা একই সময়ে দুই ধরনের সমস্যা শুরু হয়েছে।’

আইইডিসিআর হসপিটাল বেসড হিউম্যান ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভেইল্যান্সের একাধিক রিপোর্ট বিশ্লেষণে দেখা যায়, এবার জুন থেকেই সারা দেশে ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ে আগের চেয়ে বেশি মাত্রায়। দেশের ৯টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ৫৫ শতাংশই বিভিন্ন ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত। এমনকি করনারি কেয়ার ইউনিটে থাকা রোগীদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ কোনো না কোনো ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছে। আলাদা করে ওই হাসপাতালগুলোর শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা শিশু রোগীদের মধ্যে ৪৭ শতাংশের বিভিন্ন ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ার প্রমাণ মিলেছে।

ওই তথ্য অনুসারে সন্দেহজনক ৭০২ জন রোগীর ল্যাব টেস্ট করে এর মধ্যে ১৯৭ জনের শরীরে এ/এইচ ৩, ৫৬ জনের শরীরে এইচ১এন১ (সোয়াইন ফ্লু), ১০৬ জনের শরীরে ভিক্টোরিয়া ইলনেস এবং একজনের শরীরে ইয়ামাগাতা ইলনেসের ভাইরাস পাওয়া গেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক কমিটির উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘শুধু ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেই হবে না। এর সঙ্গে অন্য ভাইরাসগুলোর দিকেও নজর রাখতে হবে, উপসর্গ দেখে সেগুলোরও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো চালাতে হবে। অনেকে ডেঙ্গুর সঙ্গেই কোনো কোনো ফ্লুতে আক্রান্ত হতে পারে। কারণ অনেক ফ্লু এমনি এমনি সেরে গেলেও আবার মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে।’

তিনি বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন অপরিহার্য হলেও আমাদের দেশে এখনো সেই সুবিধা সরকারিভাবে সব মানুষের জন্য দেওয়া হয়নি, শুধু হাজিদের জন্য এ সুবিধা রাখা হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারিভাবে ভ্যাকসিন পাওয়া গেলেও তা অনেকটা ব্যয়বহুল হওয়ায় সাধারণ মানুষের পক্ষে এটি সবার জন্য নেওয়ার সুযোগ থাকে না।’

আরো ৯ মৃত্যু : ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন জানান, ফরিদপুরের হাবিবুর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ৩১ জুলাই এখানে ভর্তি হন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।

মানিকগঞ্জের শিবালয়ের আমজাদের ছোট ভাই রাশেদ মণ্ডল বলেন, আমজাদ গত শুক্রবার জ্বরে আক্রান্ত হলে তাঁকে মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে তাঁকে গত সোমবার মধ্যরাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। গতকাল মঙ্গলবার সকালে তাঁর মৃত্যু হয়।

চাঁদপুরের বৃদ্ধা মনোয়ারা বেগম ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত শনিবার থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার ভোরে তাঁর মৃত্যু হয়।

এদিকে স্বামী-সন্তান নিয়ে দেশে বেড়াতে এসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে মারা যান ইতালিপ্রবাসী হাফসা লিপি। হাসপাতালের পরিচালক জসিমউদ্দিন খান জানান, ওই নারী চার দিন ধরে সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আইসিইউতে থাকা অবস্থায় গত সোমবার রাতে তাঁর মৃত্যু হয়।

দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গতকাল মঙ্গলবার ভোরে মারা যাওয়া রবিউল ইসলামের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈলের নেকমরদ খগড়পুর গ্রামে। সে রাজধানীর মিরপুর হাফেজিয়া মাদরাসার ছাত্র ছিল। ঢাকা থেকে জ্বর নিয়ে এসে রবিউল গত ৩০ জুলাই হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছিল।

এদিকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গতকাল মঙ্গলবার সকালে রিয়ানা (৩) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। রিয়ানা গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর নকাইহাট এলাকার আশরাফুল ইসলামের মেয়ে। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকদলের মুখপাত্র ডা. সাইদুজ্জামান জানান, গত ৩ আগস্ট ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে ঢাকা থেকে রিয়ানাকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল সকালে সে মারা যায়।

রাজধানীর ধানমণ্ডির বেসরকারি একটি হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গতকাল মঙ্গলবার ভোরে মদিনা আক্তার নামে এক শিশু মারা গেছে। জানা যায়, মদিনা চাঁদপুরের মতলব উত্তরে ঘনিয়ারপাড় অক্সফোর্ড কিন্ডারগার্টেনের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। গত শনিবার গ্রামের বাড়িতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে মদিনাকে চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে রাজধানীর ধানমণ্ডি জেনারেল অ্যান্ড কিডনি হাসপাতালে ভর্তি করে স্বজনরা। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল ভোরে মদিনা মারা যায়।

ঢাকা মেডিক্যালে ৫০ আইসিইউ বেড চালু : গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে এক পর্যালোচনা সভায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নতুন ৫০টি আইসিইউ বেড চালু, ঈদের ছুটিতে যারা ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যাবে তাদের জন্য সতর্কতামূলক প্রচারণার ব্যবস্থা, ঈদের ছুটিতে সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের হেল্প ডেস্ক খোলা রাখা, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ডেঙ্গু রোগীকে স্থানীয়ভাবে ন্যাশনাল গাইডলাইন অনুযায়ী চিকিৎসা নিশ্চিত করা, ঈদের ছুটিতে কমিউনিটি ক্লিনিকের সার্বক্ষণিক সেবা চালু রাখাসহ আরো কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সভায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ, রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। (প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কালের কণ্ঠ’র স্থানীয় প্রতিনিধিরা)

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/08/07/801179