স্মার্ট প্রিপেইড মিটার। ছবি: সংগৃহীত
৬ আগস্ট ২০১৯, মঙ্গলবার, ১১:১১

৭০০ কোটি টাকার প্রিপেইড মিটার কেনার শুরুতেই অনিয়ম

রাজধানীর ১৪ লাখ বিদ্যুৎ গ্রাহকের মিটার স্থাপন অনিশ্চিত

এবার ৭০০ কোটি টাকার স্মার্ট প্রিপেইড মিটার কেনায় ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) বিরুদ্ধে বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে- পছন্দের একটি কোম্পানিকে কাজ দিতে এ সংক্রান্ত দরপত্রে ব্যাপক কারসাজি করা হচ্ছে।

জানা গেছে, ডিপিডিসির একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট পুরো এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। এর আগে একই ধরনের মিটার কেনায় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল পিডিবি (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড), আরইবির (পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড) বিরুদ্ধে।

ডিপিডিসির কাছে দেয়া সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর অভিযোগ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিপিডিসির একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, স্মার্ট প্রিপেইড মিটারের দরপত্রে অনিয়মের বিষয়ে এরই মধ্যে ২টি কোম্পানি লিখিতভাবে তাদের অভিযোগ জানিয়েছে।

কানাডিয়ান একটি কোম্পানি শিগগির তাদের দূতাবাসের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ জানাবে বলেও জানিয়েছে। এ অবস্থায় ডিপিডিসির আওতাধীন রাজধানীর ১৪ লাখ বিদ্যুৎ গ্রাহকের স্মার্ট প্রিপেইড মিটার স্থাপন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান যুগান্তরকে বলেন, পিপিআরের যাবতীয় নিয়মকানুন মেনেই এ দরপত্র যাচাই-বাছাইয়ের কাজ করা হয়েছে। এখনও কোনো কোম্পানিকে রেসপন্সিভ করা হয়নি।

যদি প্রয়োজন হয় তাহলে ডেমনেস্ট্রশনের জন্য ডাকা হবে এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও নেয়া হবে। তবে দরপত্রের অত্যাবশ্যকীয় শর্ত যদি কেউ পূরণ করতে না পারে তাহলে তারা নন-রেসপন্সিভ হবে।

এ ক্ষেত্রে কাউকে ডাকা না-ও হতে পারে। তিনি বলেন, পুরো প্রক্রিয়াটি কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। এরপর সেটি ডিপিডিসির পরিচালনা পর্ষদে যাবে।

দরপত্রে অংশ নেয়া কোম্পানিগুলোর অভিযোগ- একটি পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দেয়ার জন্য ডিপিডিসির একটি সিন্ডেকেট শুরুতেই নীলনকশা তৈরি করেছে। এরই অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মানের দরদাতাগুলোকে কারিগরিভাবে অযোগ্য করার পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। দরপত্রের শর্তানুযায়ী ডিপিডিসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি (টিইসি) সংশ্লিষ্ট দরদাতাদের কাছ থেকে যথাযথ কারিগরি ব্যাখ্যা চেয়েছিল এবং দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ডিপিডিসির সব ধরনের কারিগরি ব্যাখ্যার জবাব দিলেও রহস্যজনক কারণে তাদের ডেমনেস্ট্রেশনে ডাকা হয়নি।

যেসব কারণে বিশ্বের নামকরা ৩টি প্রতিষ্ঠানকে বাদ দেয়া হয়েছে, কারিগরি ব্যাখ্যায় সে সম্পর্কে দরদাতার কাছে কোনো ব্যাখ্যা চাওয়া হয়নি। এতে স্পষ্ট হয় যে, শুধু পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দেয়ার জন্যই এ ক্রয় প্রক্রিয়াটির দরপত্র আহ্বান এবং মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

জানা গেছে, এ প্রকল্পে মোট ৪টি কোম্পানি দর দেয়। তারা হল: টেকনো ইলেকট্রিক্যাল লিমিটেড জেভি আইট্রোন আইএনসি, অকলিন টেক বিডি লিমিটেড, পেন্টাসল্যুশনস লিমিটেড জেভি ও কেটিওভি জেভি কনসোর্টিয়াম।

দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎসেবা পৌঁছে দিতে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের অংশ হিসেবে ‘অ্যাডভান্সড মিটারিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার (এএমআই) প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।

ভিশন-২০২১-এর আওতায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন এবং সরবরাহকৃত বিদ্যুতের সঠিক ব্যবহার ও ব্যবহৃত বিদ্যুতের প্রকৃত বিলের অর্থ আদায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সরকার প্রতিটি গ্রাহকের জন্য ‘স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার’ সংস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।

কিন্তু বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ সরকারের এ উদ্যোগ সূচনালগ্নেই এক শ্রেণির অসাধু ও স্বার্থান্বেষী মহলের অশুভ চক্রান্তে বন্ধ হয়ে যাবে। স্মার্ট মিটার সংযোগ হলে যেসব সুবিধা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে রেভিনিউ মিসিং রোধ করা, অবৈধ সংযোগ চিহ্নিত করা এবং বিদ্যুতের অপব্যয় রোধ করা।

উল্লেখ্য, প্রতিটি উন্নত দেশে আগে থেকেই স্মার্ট মিটার প্রযুক্তির সংযোগ রয়েছে। প্রিপেইড মিটারের অব্যবস্থাপনার জন্য এরই মধ্যে দেশে আন্দোলন হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ক্ষেত্রে এই সল্যুশন স্মার্ট মিটার বিদ্যুৎ সেক্টরে শৃঙ্খলা আনয়নে বড় ধরনের কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

জানা গেছে, স্মার্ট প্রিপেইড মিটারের সঙ্গে এমডিএমএস (মিটার ডাটা ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার), এইচএসএস (হেড অ্যান্ড সিস্টেম সফটওয়্যার), আরএফ (রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি নেটওয়ার্ক) ইত্যাদি রয়েছে। এ কারণে এ প্রকল্পটি সফলভাবে বাস্তবায়নের পর কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সারা দেশে এ সল্যুশনটি ব্যবহার করা যাবে।

জানা গেছে, দুটি প্যাকেজে এ প্রকল্প একনেকে অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের প্রাক্কলিত মূল্য প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। প্রথম প্যাকেজটি পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে সফলভাবে সংযোজন ও কার্যক্রম পরিচালনার পর দ্বিতীয় প্যাকেজটি টেন্ডার হিসেবে আহ্বান করা হবে।

এ প্রকল্পের অধীন প্রথমে ঢাকা শহরের ডিপিডিসি এরিয়ায় প্রতিটি বৈদ্যুতিক মিটার পরিবর্তন করে স্মার্ট মিটার সংযোগ করা হবে।

এরই ধারাবাহিকতায় ৩ জানুয়ারি ডিজাইন, সাপ্লাই, ইনস্টলেশন, টেস্টিং ও কমিশনিং অব অ্যাডভান্সড মিটারিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার (এএমআই) এবং স্মার্ট মিটারিং সিস্টেম টার্নকি বেসিসে একটি এক স্তরবিশিষ্ট দুই খামের দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর কারিগরি দরপত্র ২ মে খোলা হয়। দুই খামের মধ্যে রয়েছে টেকনিক্যাল ও ফিন্যান্সিয়াল দরপত্র।

দরপত্রের নিয়মানুযায়ী প্রাথমিক কাগজপত্র বাছাইয়ের পরে ডেমনেস্ট্রেশন করে প্রত্যেককে তাদের প্রস্তাবিত সিস্টেমটি ক্রয়কারীকে (ডিপিডিসি) দেখাতে হবে। টিইসি (টেকনিক্যাল ইভলুশন কমিটি) পরীক্ষা ও নিরীক্ষায় সন্তোষ প্রকাশ করলে টেকনিক্যালি পাস বলে বিবেচিত হবে।

দ্বিতীয়ত, টেকনিক্যালি পাস করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের জমাকৃত আর্থিক প্রস্তাব খোলার চিঠি পাঠানোর পর নির্বাচিত দরদাতাদের (সিলেকটিভ বিডার) সম্মুখে আর্থিক দর খুলতে হবে।

জানা গেছে, উন্নত বিশ্বে এ ধরনের দরপত্র আহ্বানের আগে কনসালট্যান্ট নিয়োগ করে কারিগরি স্পেসিফিকেশন ও অন্যান্য নীতিমালা তৈরি করে ইওআইয়ের (এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট) মাধ্যমে যোগ্য দরদাতা নির্ধারণের পর অর্থনৈতিক দরপত্র চাওয়া হয়।

কিন্তু অভিযোগ উঠেছে- ডিপিডিসি এ ধাপগুলো অনুসরণ না করে পছন্দের কোম্পানির স্পেসিফিকেশন অনুয়ায়ী দরপত্র আহ্বান করেছে। খোদ ডিপিডিসির একজন প্রকৌশলী যুগান্তরকে বলেন, এই দরপত্রে ৩টি অন্যতম শর্ত দেয়া হয়েছে।

এর মধ্যে অন্যতম হল প্রস্তাবিত আরএফ নেটওয়ার্ক ইউনাইটেড নেশনস (ইউএন) সার্টিফাইড হতে হবে। যে কোনো পার্টনারের গত ৫ বছরে একাধিক দেশে ন্যূনতম ৩টি ভিন্ন নির্মাতার মিটারে ইন্টারফেজ (আরএফ) নেটওয়ার্ক কার্ড স্থাপনের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

তৃতীয়ত, প্রস্তাবিত ইন্টারফেজ মডিউল কার্ড ন্যূনতম ১৫ জন মিটার সরবরাহকারীর মিটারে সমন্বয় থাকতে হবে। যাতে পরবর্তী সময়ে কেনা সিস্টেমের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন মিটার সরবরাহকারীর মিটার ইন্টারফেজ করা সম্ভব হয়।

কিন্তু অভিযোগ উঠেছে- যে কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেয়া হচ্ছে তাদের এ ৩টির একটি অভিজ্ঞতাও নেই।

এ অবস্থায় যদি ওই কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেয়া হয় তাহলে ডিপিডিসিকে আগামীতে যে কোনো কাজে শুধু ওই কোম্পানির মিটার ও স্পেয়ার্স পার্টস স্থাপন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মনোপলি বাণিজ্যের কারণে বড় ধরনের রাজস্ব ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

এইভাবে ওই কোম্পানির কাছে ডিপিডিসিকে জিম্মি হয়ে পড়তে হতে পারে। দরপত্রের শর্তানুযায়ী, প্রথম ১০ হাজার মিটার ৩টি ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানির স্থাপনের শর্ত থাকলেও ওই দরদাতা শুধু একটি কোম্পানির মিটার স্থাপন করে পাইলট প্রজেক্ট করবে বলে শোনা যাচ্ছে।

এ বিষয়ে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেন, যেসব অত্যাবশ্যকীয় কাগজপত্র ও ডকুমেন্ট দরপত্রে দেয়ার কথা, যদি তারা সেগুলো না দেয় তাহলে পরবর্তী সময়ে ডাকার কোনো সুযোগ নেই।

যদি ছোটখাটো কোনো ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে সেসব ভুল-ত্রুটি শোধরানোর সুযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যাখ্যা দেয়ারও সুযোগ নেই। এ কারণে হয়তো তাদের ব্যাখ্যার জন্য ডাকা হয়নি।

তিনি বলেন, প্রকল্পটি সম্পর্কে আমরা সবই জানি। এ কারণে কোনো কনসালট্যান্ট নিয়োগ দেয়া হয়নি। যেসব প্রকল্প নতুন সেসব প্রকল্পের জন্য কনসালট্যান্ট নিয়োগ দেয়া হয়। স্মার্ট প্রিপেইড মিটার একটি পুরনো প্রকল্প।

এর আগে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা ডেসকোও (ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি) উচ্চমূল্যে মিটার কিনে বড় ধরনের অর্থ গচ্চা দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সরকারি ক্রয়-প্রক্রিয়ার বিধান অপব্যবহার করে টেলিফোন শিল্প সংস্থার মাধ্যমে চীন থেকে সরাসরি ৯৫ হাজার সিঙ্গেল ফেজ স্মার্টকার্ড মিটার ও ৫ হাজার থ্রি-ফেজ স্মার্ট কার্ড মিটার সরবরাহের কার্যাদেশ দেয়।

টিএসএসের মাধ্যমে ক্রয় করা এসব সিঙ্গেল ফেজ ও থ্রি-ফেজ মিটারের দর পড়ে যথাক্রমে ৭৬ হাজার ৫০০ ও ১৫ হাজার ৩১৯ টাকা। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে এ দর আরও ২-৩ গুণ কম। এ অবস্থায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে ডেসকো সরাসরি মিটার কেনা থেকে সরে আসে।

এরপর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ২ লাখ স্মার্ট মিটার কেনার জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে। ১৭ জুন এ দরপত্র খোলা হয়। ডেসকোর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, জানতে পেরেছি এই দর সরাসরি কেনার চেয়ে অনেক কম হবে।

তিনি বলেন, এখানেও টিএসএস সরাসরি মিটার সরবরাহ করতে চেয়েছিল। তার ধারণা, এ দরপত্র খোলা হলে সরাসরি কেনার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। অভিযোগ আছে, এ কারণে সংস্থার একটি চক্র এই দরপত্র বাতিলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/207453/