জোড়াতালির মেরামতের দু’সপ্তাহ না যেতেই আগের অবস্থায় এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের কাছের অংশ -সংগৃহীত
৪ আগস্ট ২০১৯, রবিবার, ১:০৫

ঈদযাত্রায় স্বস্তি-ভোগান্তি

চাপ বাড়বে সড়কে : ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়ের শঙ্কা

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের আবদুল্লাহপুর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার দীর্ঘদিন ধরেই বেহাল। মহাসড়কের এই অংশে বিআরটির লেন নির্মাণের কাজ চলছে। একই প্রকল্পের অধীনে সড়কের দুই পাশেই নালা নির্মাণ চলছে। এতে মহাসড়কের এক-তৃতীয়াংশই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে আছে। বৃষ্টি হলেই টঙ্গী স্টেশন রোড, সাইনবোর্ড, চান্দনা চৌরাস্তা, বাসন ও ভোগড়া এলাকায় পানি জমে থাকে। তখন যানবাহনের গতি শ্লথ হয়ে দেখা দেয় যানজট। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুন্ডু অংশে ছোট বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে জোড়াতালি দিয়ে সেগুলো মেরামত করার পর বৃষ্টিতে মহাসড়কটি আবারও বেহাল হয়ে পড়েছে।

ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের যশোর অংশের ৩৮ কিলোমিটার এবং যশোর-বেনাপোল অংশের ৩৮ কিলোমিটার সড়ক মেরামত করার পর আবারও ভেঙে গেছে। এক প্রান্ত মেরামত করতে না করতে আরেক প্রান্ত ভেঙে যাচ্ছে। যশোর-খুলনা মহাসড়কের যশোরের চাঁচড়া থেকে অভয়নগর উপজেলার রাজঘাট পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার সড়কটি সময়মতো মেরামত না করায় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেটের ১২টি স্থানে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জের সৈয়দপুর, আউশকান্দি, রুস্তমপুর, সদরঘাট, দেবপাড়া, পানিউমদা, বড়চর এবং বাহুবলের আবদানাড়াউল ও মিরপুর উল্লেখযোগ্য। সিলেটের লালাবাজার ও বাহাপুর এবং মৌলভীবাজারের শেরপুরের অবস্থাও ভালো নয়। এই স্থানগুলোও মেরামতের পর আবার ভেঙে গেছে।

ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের বগুড়া জেলার অধীনে আছে ৬৫ কিলোমিটার। ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই সড়ক মেরামতে প্রায় ১০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এরপর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয় হয় মেরামতে। চলতি অর্থবছরে মেরামতে বরাদ্দ ১৮ কোটি টাকা। এরপরও সড়কের বেহাল দশা কাটেনি। এই মহাসড়কের সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ অংশের প্রায় ১৮ কিলোমিটার মহাসড়ক আবারও বেহাল হয়ে পড়েছে। অথচ গত ঈদুল ফিতরের আগেই সড়কটি মেরামত করা হয়। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা অংশের প্রায় ২০০ মিটার এলাকাজুড়ে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতেই এসব গর্তে পানি জমছে। এরই মধ্যে এই মহাসড়ক জোড়াতালি দিয়ে মেরামত করা হয়েছে। তবে বৃষ্টিতে আবার বেহাল হয়ে পড়েছে সড়কটি।

সারা দেশে প্রায় সোয়া চার হাজার কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক ভাঙাচোরা। এর মধ্যে বন্যায় তলিয়ে গেছে কমপক্ষে ১৮ জেলার সড়ক-মহাসড়ক। ভালো সড়কও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে এবার ঈদযাত্রায় দুর্ভোগের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ঈদুল আজহার সাত দিন আগে এসব সড়ক-মহাসড়ক মেরামতের নির্দেশনা জারি করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা বিভাগের (এইচডিএম) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ২৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ সড়ক-মহাসড়ক ভাঙাচোরা। আর ২৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ মোটামুটি চলনসই। বাকিগুলো ভালো অবস্থায় আছে। ভাঙাচোরা সড়কের কিছু অংশে হালকা বা ভারী মেরামত প্রয়োজন। বাকি সড়ক পুননির্মাণ করতে হবে।

সওজ সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ি ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি এলাকায় ভাঙাচোরা সড়ক মহাসড়ক মেরামতের কাজ চলছে। জোড়াতালি দিয়ে মেরামতের কারণে এরই মধ্যে সেগুলো আবার ভেঙে একাকার হয়ে গেছে। আসন্ন ঈদুল আজহায় যানবাহনের চাপ বেড়ে গেলে এই জোড়াতালির সড়ক ঘরমুখী মানুষকে কতটা স্বস্তি দিতে পারবে, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে, বন্যায় রেলপথের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় কমপক্ষে ১১টি রুটে ট্রেন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারবে না। তাতে ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়ের আশঙ্কাও রয়েছে। এ কারণে সড়কপথে এবার যাত্রীদের চাপ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাড়তি এই চাপ ঘরমুখি যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়াতে পারে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। চার লেনের এই মহাসড়কের কিছু কিছু অংশে ভাঙাচোরা থাকায় যানবাহনের ধীর গতি হলেও এ মহাসড়কে যানজটের ভোগান্তির শঙ্কা নেই। বিশেষ করে দ্বিতীয় মেঘনা, গোমতী ও কাঁচপুর সেতু চালু হওয়ার পর থেকে এ মহাসড়কে আর কোনো যানজট নেই। সেতুগুলোর টোলপ্লাজার টোলগ্রহণ পদ্ধতি আধুনিকায়ন করায় সময় খুবই কম লাগছে।

সওজের একজন কর্মকর্তা বলেন, সব সময় সড়কের দুরবস্থার জন্যই যানজট বা দুর্ভোগ হয়, এমন নয়। কিছু কিছু স্থানে অব্যবস্থাপনার কারণে দুর্ভোগ হয়। গত ঈদুল ফিতরের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, গতবার ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেতুর টোলপ্লাজার অব্যবস্থাপনার কারণে ঈদের আগের দিন কয়েক হাজার গাড়ি যানজটে আটকে পড়ে। বিক্ষুদ্ধ যাত্রীরা গাড়িতে আগুনও দিয়েছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, স্বয়ক্রিয় সিস্টেম যে কোনো মুহূর্তে বিকল হতে পারে। এজন্য বিকল্প ব্যবস্থা রাখা উচিত। বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল প্লাজায় তা ছিল না বলেই যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, সিরাজগঞ্জে নলকা ও ধোপাকান্দি সেতু দুটি সরু। জরাজীর্ণ হওয়ায় যানবাহনের গতি কমে যাচ্ছে। এবার এলেঙ্গার আগে কিছু অংশ বেশ ভাঙাচোরা। ধোপাকান্দি ও নলকা সেতুও আগের মতোই নাজুক। এতে যানবাহনের চাপ পড়লে এবারও যানজটের আশঙ্কা আছে।

অন্যদিকে, মহাসড়কে অবৈধ যানের দখল এবারও দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের ভোগান্তিতে ফেলবে। ভুক্তভোগিরা জানান, ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নয়নকাজের পাশাপাশি তাদের জন্য নতুন বিড়ম্বনা হয়ে দেখা দিয়েছে অবৈধ যানবাহন। এসব যানবাহনের কারণে যানজট দেখা দেয়ার পাশাপাশি বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।

ঢাকা থেকে সড়কপথে দক্ষিণাঞ্চলে যাওয়ার অন্যতম মাধ্যম ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক। এ মহাসড়কের ঢাকার বাবুবাজার থেকে মাদারীপুরের শিবচরের কাঁঠালবাড়ী ঘাট হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৬ কিলোমিটার পর্যন্ত ছয় লেনে উন্নীতকরণের কাজ চলমান রয়েছে। মহাসড়কের কাজে বিপুল সংখ্যক গাড়ি মালামাল লোড-আনলোড করার সময় সিগনাল দিয়ে সাধারণ পরিবহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়। এ মহাসড়কের সেতু ও কালভার্টগুলো ভেঙে ডাইভারসন তৈরি করা হয়েছে। আসন্ন ঈদ যাত্রায় এসব কারণে এ মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়ে ভোগান্তি বাড়তে পারে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে নসিমন, করিমন, থ্রি-হুইলার মাহিন্দ্রা ও ইজিবাইকসহ বিভিন্ন ধরনের অবৈধ যানবাহনের স্ট্যান্ড রয়েছে। মালিগ্রাম, বড়ইতলা, ভুরঘাটা, বার্থী, মাহিলাড়া, বাটাজোরসহ কয়েকটি স্থানে রয়েছে অস্থায়ী হাট ও বাজার। এসব কারণে ঈদ যাত্রায় সাধারণ পরিবহনের গতি কমে আসার পাশাপাশি মহাসড়কে যানজট দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে ভোগান্তি পোহাতে হতে পারে ঘরমুখী মানুষকে।

অন্যদিকে, এবারের ঈদেও রেলপথেও ঝামেলাহীন ঘরে ফেরা হচ্ছে না। বন্যার তোড়ে দেশের কয়েকটি স্থানে রেল লাইনে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেগুলো দিয়ে কোনমতে জোড়াতালি দিয়ে ট্রেন চলাচল করছে। ঈদের আগে ওইসব পথ সম্পূর্ণ মেরামত করার সম্ভাবনাও কম। তার কারণ বন্যার পানি পুরোপুরি না নামলে সংস্কার কাজ সম্পন্ন করতে পারবে না কর্তৃপক্ষ। তাই এবার ঈদযাত্রা স্বাভাবিক গতি হারাবে রেলপথে। বাড়বে ভোগান্তি। তাতে চাপ পড়বে সড়ক পথে। এমনটাই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন যোগাযোগ খাতের বিশেষজ্ঞরা। গাইবান্ধার বদিয়াখালী রেলপথ ধসে গেছে এবারের বন্যায়। ঢাকা-গাইবান্ধা-লালমনিরহাটের ট্রেন চলাচল এখনও বিচ্ছিন্ন। বন্যায় রেলপথ ধসের কারণে সান্তাহার থেকে বগুড়া হয়ে বোনারপাড়া পর্যন্ত ট্রেন আসা-যাওয়া করছে। ঢাকা থেকে সরাসরি বগুড়া অথবা গাইবান্ধা যাওয়ার কোনো ট্রেন নেই। এ কারণে এবার বগুড়া, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রামের যাত্রীদের ট্রেন যাত্রা স্বস্তিদায়ক হবে না। অবশ্য রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, ঈদের আগে ১০ আগস্ট থেকে গাইবান্ধা হয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হবে। সে লক্ষ্যে দ্রুত গতিতে রেললাইন স্থাপনের কাজ চলছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/225040/