৪ আগস্ট ২০১৯, রবিবার, ১:০২

৬০০ কোটি টাকা খেলাপির ফাঁদে চামড়া ব্যবসা

ট্যানারি মালিকদের কাছে পোস্তার আড়তদাররা পাবেন ৩৫০ কোটি * আড়তদারদের কাছে ফরিয়ারা পাবেন ২৫০ কোটি টাকা

খেলাপির ফাঁদে পড়েছে চামড়া ব্যবসা। মাঠপর্যায়ের পুরো ব্যবসাটিই চলে বাকিতে। ফলে এক কোরবানির টাকা পেতে আরেক কোরবানির সময় চলে আসে। এভাবে বাকির ফাঁদে আটকা পড়ায় চামড়া ব্যবসা থেকে অনেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এ খাতে মাঠপর্যায়ের দুটি পক্ষের কাছে এখন প্রায় ৬০০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। আসন্ন কোরবানির ঈদ সামনে রেখে এই টাকা আদায়ে দু’পক্ষই তৎপর হয়ে উঠেছেন।

সারা দেশে কোরবানিদাতাদের কাছে থেকে চামড়া কেনেন শৌখিন ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। এগুলো তারা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এগুলো বিক্রি করে ফড়িয়াদের কাছে। ফড়িয়ারা কাঁচা চামড়া লবণ মিশিয়ে ঢাকা পোস্তাসহ দেশের বিভিন্ন আড়তে বিক্রি করেন। সেখান থেকে সেগুলো চলে যায় ট্যানারি মালিকদের কাছে। এই প্রক্রিয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চামড়া বেচাকেনা হয় বাকিতে। এমনকি কোরবানিদাতাদের কাছ থেকেও স্থানীয় প্রভাবশালীরা বাকিতে চামড়া কিনে আনেন। সে টাকা ঠিকমতো দেন না। এ প্রক্রিয়ায় পোস্তার আড়তদারদের কাছে ফড়িয়ারা পাবেন প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। এই টাকার জন্য এখন ফড়িয়ারা পোস্তায় এসে বসে থাকছেন। কিন্তু টাকা মিলছে না। আড়তদাররা বলছেন, ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে টাকা পেতে তারা টাকা দেবেন। এর আগে নয়।

এদিকে পোস্তার আড়তদাররা ট্যানারি মালিকদের কাছে পাবেন প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। এবার যখন ট্যানারি মালিকরা ব্যাংক থেকে চামড়া কেনার জন্য ঋণ পাবেন তখন এ টাকার একটি অংশ আড়তদারদের দেয়া হবে। তখন তারা ফড়িয়াদের টাকা দেবেন।

এদিকে গত বছর পর্যন্ত ট্যানারি মালিকদের কাছে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট হাজার ১০০ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো ঋণ দিচ্ছে ট্যানারি মালিকদের। আড়তদার বা ফড়িয়াদের কোনো ঋণ দিচ্ছে না।

বকেয়া টাকা না পাওয়ায় আসন্ন কোরবানি ঈদ সামনে রেখে পশুর চামড়া সংগ্রহে প্রস্তুতি শুরু করতে পারছে না পুরান ঢাকার লালবাগে পোস্তার চামড়া আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা। তারা জানিয়েছেন, ট্যানারি মালিকদের কাছে গত কোরবানির চামড়া বিক্রির সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা বকেয়া পাওনা আছে। পাশাপাশি ব্যাংক থেকে এখনও ঋণ পাওয়ার বিষয়ে আশ্বাস পাওয়া যায়নি। এর ফলে ঈদের আগে টাকা সংগ্রহ করতে না পারলে বিপর্যয়ের মুখে পড়বেন বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান হাজী মো. দেলোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, পোস্তার চামড়া ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতি নিতে পারছেন না। এখন পর্যন্ত ব্যাংক থেকে ব্যবসায়ীরা ঋণ পাননি। এখন পর্যন্ত তাদের বকেয়া টাকা পরিশোধ করেনি। তাই পোস্তার ব্যবসায়ীরা এ বছর চামড়া সংগ্রহ নিয়ে উদ্বিগ্ন।

তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা বর্তমানে নিজ উদ্যোগে ধার-দেনার মাধ্যমে মূলধন জোগাড় করে চামড়া সংগ্রহের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আশা করি, ঈদের আগে ব্যাংক থেকেও ঋণ পাওয়া যাবে। ট্যানারির মালিকরাও টাকা শোধ করবেন। সব মিলিয়ে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহে পোস্তার ব্যবসায়ীরা সক্রিয় হয়ে উঠবেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বছর সারা দেশের মধ্যে ৩০ শতাংশ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য রয়েছে রাজধানীর লালবাগের পোস্তার চামড়া আড়তদার ও ব্যবসায়ীদের। সে হিসেবে এখানকার ব্যবসায়ীরা প্রায় ৩০০ কোটি টাকার চামড়া সংগ্রহ করবেন। লেনদেন বেশি হলে তা প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তাই চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যে এখানকার আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা মূলধন জোগাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

আনোয়ার ট্যানারের মালিক দিলজাহান ভূঁইয়া বলেন, প্রতি বছরই ঈদের আগে অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে একটি দাম নির্ধারণ করা হতো। এবার তা হবে কিনা এখনও জানা যায়নি। তিনি আরও বলেন, কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সুযোগ খোঁজে। ওরা কম দামে চামড়া কিনলেও বিক্রি করতে এসে বলে নির্ধারিত দামেই কেনা। ফলে আমরা আর দরকষাকষি করতে পারি না। যে কারণে লোকসানের আশঙ্কা থেকেই যায়। এ প্রসঙ্গে হাজী মো. দেলোয়ার হোসেনও বলেন, চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হবে কিনা এখনও তা আলোচনা হয়নি।

উল্লেখ্য, রাজধানীর পুরান ঢাকার লালবাগে পোস্তা মোড় এমনিতেই ব্যস্ততম জায়গা। আর আসন্ন কোরবানি ঈদ ঘিরে এক মাস কাঁচা চামড়াবাহী ট্রাক, ভ্যান আর ঠেলাগাড়ির ভিড় থাকা নৈমিত্তিক চিত্র। এ সময়টাতে শ্রমিকরা লাইন ধরে চামড়া নিজেদের আড়তে তুলে নেয়। এখানকার প্রায় ৩০০ চামড়ার আড়ত মালিক নাওয়া-খাওয়া পর্যন্ত ভুলে যান। আর এই আড়ত মালিকদের বেশির ভাগই বংশানুক্রমে যুগ যুগ ধরে এ ব্যবসায় জড়িয়ে আছেন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/economics/206711/