২৪ জুলাই ২০১৯, বুধবার, ২:০৭

বহুসংখ্যক কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ার কোনো বাখ্যাই মিলছে না

সরদার আবদুর রহমান : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের সুরতহাল রিপোর্টে দেখা যায়, বহুসংখ্যক কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ার বিষয়টি একটি ‘অতি-অস্বাভাবিক’ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু কোনো সন্তোষজনক বাখ্যাই মিলছে না দায়িত্বশীল কোনো তরফে।

নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী সংসদ নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে দেখা যায়, অন্তত ২২৭টি কেন্দ্রে ১০০% ভাগ ভোট পড়েছে। এ ছাড়াও ৯০ শতাংশ থেকে ৯৯.৯৯ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়েছে অন্তত সাড়ে ৭ হাজারের বেশি কেন্দ্রে। কিন্তু এই গুরুতর বিষয়ে দায়িত্বশীল মহলের পক্ষ থেকে সন্তোষজনক কোন বাখ্যার পরিবর্তে গেজেট প্রকাশের কথা বলে বিষয়টি তারা এড়িয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

শতভাগ ভোট পড়া কেন্দ্রগুলোর মধ্যে আছে দিনাজপুর-১ আসনে চারটি, দিনাজপুর-২ আসনে তিনটি, দিনাজপুর-৪ আসনে দুটি, দিনাজপুর-৬ আসনে একটি, নীলফামারী-৩ আসনে একটি, লালমনিরহাট-১ আসনে দুটি, লালমনিরহাট-৩ আসনে ছয়টি, রংপুর-১ আসনে দুটি, রংপুর-২ আসনে সাতটি, রংপুর-৪ আসনে তিনটি, রংপুর-৫ আসনে নয়টি, রংপুর-৬ আসনে ছয়টি, কুড়িগ্রাম-৩ আসনে দুটি, গাইবান্ধা-৪ আসনে চারটি, বগুড়া-১ আসনে দুটি, বগুড়া-২ আসনে একটি, বগুড়া-৫ আসনে দুটি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনে তিনটি, নওগাঁ-২ আসনে দুটি, নওগাঁ-৩ আসনে চারটি, নওগাঁ-৪ আসনে তিনটি, রাজশাহী-৬ আসনে দুটি, নাটোর-১ আসনে একটি, সিরাজগঞ্জ-১-এ একটি, সিরাজগঞ্জ-২-এ একটি, সিরাজগঞ্জ-৩-এ তিনটি, সিরাজগঞ্জ-৪-এ একটি, সিরাজগঞ্জ-৫-এ একটি, সিরাজগঞ্জ-৬-এ তিনটি, মেহেরপুর-২-এ একটি, যশোর-৩-এ একটি, বাগেরহাট-২-এ একটি, খুলনা-৬-এ একটি, বরিশাল-১-এ দুটি, বরিশাল-৩-এ একটি, টাঙ্গাইল-৫-এ একটি, টাঙ্গাইল-৬-এ একটি, জামালপুর-৪-এ তিনটি, শেরপুর-১-এ দুটি, ময়মনসিংহ-১-এ একটি, ময়মনসিংহ-২-এ চারটি, ময়মনসিংহ-৪-এ একটি, ময়মনসিংহ-৬-এ দুটি, ময়মনসিংহ-৭-এ একটি, ময়মনসিংহ-৮-এ দুটি, ময়মনসিংহ-৯-এ একটি, ময়মনসিংহ-১০-এ চারটি, ময়মনসিংহ-১১-এ একটি, নেত্রকোনা-৫-এ একটি, মানিকগঞ্জে-১-এ একটি, মানিকগঞ্জ-২-এ তিনটি, মুন্সীগঞ্জ-১-এ দুটি, মুন্সীগঞ্জ-২-এ দুটি, মুন্সীগঞ্জ-৩-এ তিনটি, ঢাকা-১, ঢাকা-৪, ঢাকা-১২ ঢাকা-১৮ ঢাকা-১৯ ও ঢাকা ২০ আসনে একটি করে, গাজীপুর-১-এ তিনটি, গাজীপুর-২-এ একটি, গাজীপুর-৩-এ একটি, নরসিংদী-৩-এ তিনটি, নারায়ণগঞ্জ-১-এ একটি, ফরিদপুর-২-এ দুটি, মাদারীপুর-১-এ একটি, মাদারীপুর-২-এ একটি, সুনামগঞ্জ-২-এ একটি, সুনামগঞ্জ-৫-এ দুটি, সিলেট-১-এ দুটি, সিলেট-৩-এ দুটি, সিলেট-৪-এ চারটি, সিলেট-৫-এ একটি, সিলেট-৬-এ একটি, মৌলভীবাজার-৩-এ দুটি, হবিগঞ্জ-৩-এ একটি, হবিগঞ্জ-৪-এ একটি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২-এ ৮টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩-এ দুটি, কুমিল্লা-১, কুমিল্লা-৭ ও কুমিল্লা-১০ আসনে একটি, চাঁদপুর-৩-এ তিনটি, ফেনী-১-এ একটি, ফেনী-২-এ একটি ও ফেনী-৩-এ দুটি, নোয়াখালী-২-এ একটি, নোয়াখালী-৬-এ একটি, লক্ষ্মীপুর-১-এ একটি, চট্টগ্রাম-৫-এ চারটি, চট্টগ্রাম-৮-এ সাতটি, চট্টগ্রাম-১০-এ দুটি, চট্টগ্রাম-১১তে একটি, চট্টগ্রাম-১২তে একটি, চট্টগ্রাম-১৪তে দুটি, চট্টগ্রাম-১৫তে একটি, কক্সবাজার-১-এ তিনটি, কক্সবাজার-২-এ দুটি, কক্সবাজার-৩-এ চারটি, কক্সবাজার-৪-এ একটি, খাগড়াছড়িতে একটি ও বান্দরবানে একটি কেন্দ্রে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাংলাদেশে যেখানে ভোট পড়ার হার ৩০/৪০ ভাগে নেমে এসেছে সেখানে এতোগুলো কেন্দ্রে একবারে একশত ভাগ ভোট পড়া কখনোই স্বাভাবিক বিষয় হতে পারে না। এটা আইনের চোখে দোষণীয় হতো না যদি ঐ কেন্দ্রগুলোর মৃত, প্রবাসী, কারাবন্দী প্রভৃতি ভোটার না থাকতো। এই শতভাগ ভোট পড়ার ঘটনা পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকেই পচিয়ে দিয়েছে।

এবিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) স্বীকার করেন, জাতীয় নির্বাচনে শতভাগ ভোট পড়া ‘স্বাভাবিক’ নয়। তবে নির্বাচনের ফল গেজেট আকারে প্রকাশ হওয়ায় তা খতিয়ে দেখার বিষয়ে ইসির করণীয় কিছু নেই। তবে কেউ ক্ষুব্ধ হলে আদালতে যেতে পারেন। গত ১ জুলাই রাজধানীতে একটি প্রশিক্ষণের উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এই তথ্য প্রমাণ করে, বাংলাদেশের জনগণ ভোট দিতে পারেনি। আমি মনে করি তারা চার বার ভোট চুরি করেছে। একবার হলো, বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের এলাকায় মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার ও জেলে পাঠানো। দ্বিতীয়বার হলো, ভোটের আগের রাতে ভোটের বাক্স ভরে দেয়া। তৃতীয়বার হলো, ভোটের দিন ভোট বাক্স ভর্তি ও আবার কেন্দ্র দখল। আর চতুর্থ চুরি হলো, ভোটের হিসাব মেলাতে গিয়ে গরমিল করা।’ তিনি এই নির্বাচন বাতিল করে দ্রুত নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন দেয়ার দাবি করেন। অপরদিকে, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমরা শতভাগ ভোট পড়ার অভিযোগ খতিয়ে দেখছি। কোথাও শতভাগ ভোট পড়েছে কিনা আমার জানা নেই। এনিয়ে আমার কোনো কথা থাকতে পারে না।’ অতীতে বাংলাদেশে এরকম শতভাগ ভোট পড়ার নজির আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অতীতে কোনো নির্বাচনে শতভাগ ভোট পড়েছে এমন আমি শুনিনি, আমার জানা নেই।’

সিইসি ও ক্ষমতাসীন আ’লীগের দায়িত্বশীলদের নিকট থেকে পাওয়া বক্তব্য নিছক গা-ছাড়া বলে পর্যবেক্ষকদের অভিমত। গেজেট হওয়ার পর আর কিছু করার না থাকলে তাদের বক্তব্য ‘গোঁজামিল’ ছাড়া আর কিছুই নয় বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

https://www.dailysangram.com/post/383932