১৭ জুলাই ২০১৯, বুধবার, ১:১০

ডুয়েলগেজ উন্নয়ন ঝিমিয়ে পড়েছে

পাঁচ বছরে অগ্রগতি ২০ শতাংশ পিছিয়ে ; ব্যয় বেড়েছে ৬৭১ কোটি টাকা ; চুক্তির ২ বছর পরও স্টেশনের কাজ শুরু হয়নি

ঝিমিয়ে পড়েছে রেলের আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত লাইনকে ডুয়েলগেজে উন্নয়নকার্যক্রম। ছয় বছরের প্রকল্পের পাঁচ বছরে অগ্রগতি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২০ শতাংশ পিছিয়ে আছে। প্রকল্পের অনেক অংশের কাজ আজো শুরু করা সম্ভব হয়নি। ব্যয় বেড়েছে ৬৭১ কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশন এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন গতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। কাজের বর্তমান গতিতে এই প্রকল্প ২০২০ সালের জুনে সমাপ্ত হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

রেল মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ে লাইন বাংলাদেশ রেলের নেটওয়ার্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই অংশটি ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে এবং উপ-আঞ্চলিক রেলওয়ে করিডোরের একটি বড় অংশ। এ উপ-অঞ্চলের পরিবহন ও ট্রান্স-শিপমেন্টের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের সীমান্তে রয়েছে ভারত ও মিয়ানমার এবং ল্যান্ডলকড দেশ ভুটান ও নেপাল। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ে করিডোর দিয়ে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী দেশগুলোকে চট্টগ্রাম পোর্টের মাধ্যমে মালামাল পরিবহনসুবিধা প্রদান করতে পারে। এতে করে এদেশে দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ বৃহৎ আন্তর্জাতিক ট্রেড করিডোরে অবস্থিত। এ করিডোরে রয়েছে সাসেক, সার্ক ও বিমসটেক ইত্যাদি। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ে করিডোরে আখাউড়া-লাকসাম সেকশনটিই একমাত্র সিঙ্গেল লাইন, যা রেলওয়ে করিডোরে অভ্যন্তরীণ, উপ-আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রেল যোগাযোগের একমাত্র সীমাবদ্ধতা হয়ে দাঁড়াবে। বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের চাহিদা মেটানোর জন্য অবিচ্ছিন্ন ডাবল লাইন স্থাপন জরুরি। টঙ্গী-ভৈরব বাজার এবং লাকসাম-চিনকি আস্তানা সেকশনে
ডাবল লাইন নির্মাণকাজ চলমান আছে। রেলকরিডোর করতে হলে লাইনটি দিয়ে দীর্ঘতর ট্রেন দ্রুতগতিতে চলাচল করার সক্ষম হতে হবে।

আখাউড়া-লাকসাম মিটারগেজ লাইন নির্মাণের জন্য ৫ হাজার ৮৩৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে অনুমোদন দেয়া হয়। এর তিন মাস পরই প্রকল্পের কার্যক্রমে পরিবর্তন এনে ব্যয় বাড়িয়ে ৬ হাজার ৫০৪ কোটি ৫৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা করা হয়। প্রকল্পটি মিটারগেজ থেকে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন করার সিদ্ধান্ত হয়। এই প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। প্রকল্পের আওতায় প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে, ১৪৪ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ মেইন লাইন ট্রাকের জন্য ২৬ হাজার ৫২৬ টন রেল সংগ্রহ, ৪০ দশমিক ৬০ কিলোমিটার লুপ ও সাইডিং লাইনের জন্য পাঁচ হাজার ২০ টন রেল সংগ্রহ, দুই লাখ ৯১ হাজার ২৫৪টি ডুয়েলগেজ প্রি-স্ট্রেসড কনক্রিট সিøপার সংগ্রহ, ১১টি স্টেশনের সিগন্যালিং ব্যবস্থা আধুনিকায়ন, একশ একর জমি অধিগ্রহণ, ৫৯টি ছোট-বড় ব্রিজ ও ১১টি স্টেশন ভবন নির্মাণ এবং ওয়েলডিং রেল জয়েন্ট, সাধারণ ফিস প্লেট, রাভার প্যাড, ইঞ্জিনিয়ার্স মেইন অফিস ভবন নির্মাণ ও ব্যালাস্ট ক্রয়সহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম।

পাঁচ বছর পর বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সরেজমিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। অনেক অঙ্গের কাজ এখনো শুরুই হয়নি। গত মার্চ পর্যন্ত অগ্রগতি ৭৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রকৃত অর্জন হলো ৫৮ শতাংশ। এখানে ২০ শতাংশ পিছিয়ে আছে প্রকল্পটি। প্রকল্পের কাজের প্যাকেজ তিনটি। ডব্লিউ-১ প্যাকেজের আওতায় আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত নতুন ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ, বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইন ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা। চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড, ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড এবং তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড এই প্যাকেজে কাজ পেয়েছে। ৩ হাজার ৪৭৩ কোটি ৪৮ লাখ ২২ হাজার ২৭২ টাকায় চুক্তি হয়েছে। ২০১৬ সালের জুনে চুক্তি হয়। ২০২০ সালের ২৬ অক্টোবর কাজ শেষ করার কথা। ঠিকাদার ২০১৬ সালের ১ নভেম্বর কাজ শুরু করে। আর গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত এই ঠিকাদারের এই প্যাকেজের ভৌত কাজের অগ্রগতি হলো ৪৯ শতাংশ এবং আর্থিক ৪৮.৫০ শতাংশ। প্যাকেজ-২ এর আওতায় অস্থায়ী বাউন্ডারি পিলার নির্মাণ করা হয়েছে। প্যাকেজ-৩ এর আওতায় গত ৫ বছরেও স্থায়ী বাউন্ডারি পিলার নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। ডিপিপির সেবার পাঁচটি প্যাকেজের মধ্যে ৪ নম্বর
প্যাকেজের দরপত্র আজও আহ্বান করা হয়নি। পণ্যক্রয় খাতের ৯টি প্যাকেজের মধ্যে ৭টিতে ক্রয়কাজ সম্পন্ন করা হয়নি। আর এক শ’ একর জমি অধিগ্রহণের মধ্যে ৭০.৫২৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।

আইএমইডির পরিদর্শনকালে দেখেছে, আপলাইনের মোট ১৩টি স্টিল গার্ডার ব্রিজের মধ্যে ১২টির নির্মাণকাজ চলমান আছে। এখানে অগ্রগতি ৭৫ থেকে ৯৫ শতাংশ। মোট ৪৬টি আরসিসি বক্স কালভার্ট নির্মাণের মধ্যে ২৮টির স্ট্রাকচারাল ওয়ার্কস সম্পন্ন হয়েছে। ৮টি বক্স কালভার্টের কাজ চলমান আছে। ৯টি আরসিসি বক্স কালভার্টের কাজ পরিদর্শনকালে গত মার্চ পর্যন্ত শুরু করা হয়নি। বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইন স্টিল গার্ডার ব্রিজ ও আরসিসি বক্স কালভার্টের কাজ এখনো শুরু হয়নি। অন্যদিকে লাকসাম থেকে আখাউড়া পর্যন্ত চুক্তিপত্রে অন্তর্ভুক্ত স্টেশনগুলোয় চলমান নির্মাণাধীন ১১টি স্টেশনের মধ্যে ৯টি স্টেশনভবন ও অন্যান্য স্থাপনার কাজ শুরু করা হয়েছে। ঠিকাদারকে সাইট হস্তান্তর করা হয়নি বিধায় চুক্তিপত্র অনুমোদনের ২ বছর পরও আখাউড়া স্টেশনের অধিকাংশ কাজ শুরু করা হয়নি। আপ ও ডাউন লাইনের ১৪৪ কিলোমিটারের মধ্যে শুধুমাত্র আপলাইনের ২৫.৭৭৫ কিলোমিটার ট্র্যাক লিংকিংয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স প্ল্যান অনুযায়ী কাজগুলো পরীক্ষা করার জন্য চেকলিস্ট ফরমসের আংশিক পরিপালন করা হচ্ছে। এ ছাড়া সাইটে সাইট ডায়েরি ও পরিদর্শন রেজিস্ট্রার সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। সম্ভাব্যতা যাচাই, ডিটেইল ডিজাইন ও ড্রইং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সম্পন্ন করার পরও চুক্তিপত্রে অন্তর্ভুক্ত মাটির কাজ ও অন্যান্য কাজের পরিমাণ অত্যধিক বৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয়। ডিপিপিতে সংস্থান থাকা সত্ত্বেও কয়েকটি প্যাকেজে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ না দেয়ায় প্রকল্প কর্তৃপক্ষ কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালন করতে পারছে না। প্রকল্প অনুমোদনের পর বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ করার কারণে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি হচ্ছে না।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/425885