১৪ জুলাই ২০১৯, রবিবার, ২:০৪

বন্যা মধ্যাঞ্চলে দিকে ধেয়ে আসছে

ইবরাহীম খলিল : অবিরাম বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে দেশের সব নদ-নদীর পানি বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে উত্তরবঙ্গের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। ছোট ছোট নদীসহ তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া প্রায় সব নদীতেই উজান থেকে আসা পানির প্রবাহ বাড়ছে। তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি স্লুইস গেটের সবকটি খুলে দিয়ে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতে নদীগুলোর উৎসের কাছে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় নদীর পানিও বেড়ে যাবে। রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। যতই সময় যাচ্ছে; ততই পানিবন্দী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। গেলো ক’দিন ধরে পানিবন্দী বহু গ্রামের মানুষ। ভিটেবাড়ি ছেড়ে লাখো পরিবার ঠাঁই নিয়েছেন সড়ক-মহাসড়ক ও আশ্রয়শিবিরে। খাবার পানি ও ত্রাণ সংকটে দুর্গতরা। বন্যার পানির স্রোতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামীণ সড়ক, কালভার্ট ও কৃষি জমি। নদ-নদীর তীরে দেখা দিয়েছে ব্যাপক ভাঙন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি সপ্তাহ জুড়ে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হবে, একইসঙ্গে বন্যা দেশের মধ্যাঞ্চলেও (ঢাকার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল) ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের গতকাল শনিবারের তথ্য অনুযায়ী, সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, ধলাই, খোয়াই, সোমেশ্বরী, কংস, হালদা, সাঙ্গু, মাতামুহুরী, ধরলা, তিস্তা, ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা নদীর পানি ২৩টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একদিন আগে শুক্রবার সাতটি নদীর পানি ১২টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সাঙ্গু নদীর পানি বান্দরবানে ১২১ সেন্টিমিটার ও দোহাজারীতে বিপদসীমার ১০৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলেও জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র।

বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ‘আগামী ৩/৪ দিন পানি ভালোই বাড়বে, উত্তরবঙ্গ থেকে বন্যাটা আস্তে আস্তে মধ্যাঞ্চলের দিকে আসবে। বন্যা যমুনা হয়ে পদ্মাতেও আসবে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানি বাড়তে পারে বলে মনে করছি, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর পানি কোনো কোনো পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতেও পারে।’ আগামী বুধ বা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হতে থাকবে জানিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ‘এরপর থেকে পানি কমতে শুরু করতে পারে। এরপরই বন্যা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে যাবে।’ নতুন করে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর অঞ্চলে বন্যা ছড়িয়ে পড়তে পারে বলেও জানান আরিফুজ্জামান।

খুলে দেওয়া হয়েছে তিস্তা ব্যারাজের সব গেট : একটানা ভারী বর্ষণ আর উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল শনিবার সকাল ৬ টায় ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক উপসহকারী প্রকৌশলী আমিনুর রশিদ বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, উজানের ঢল সামাল দিতে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি স্লুইস গেটের সবই খুলে রাখা হয়েছে। এছাড়া তিস্তা বিপদসীমার ওপরে চলে যাওয়ায় বিভিন্ন স্থানের বাঁধগুলো হুমকির মুখে পড়েছে।

এদিকে ঢলের পানিতে নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকার প্রায় ১৫টি চর ও চরগ্রাম হাঁটু থেকে কোমর সমান পানিতে তলিয়েছে। ১৫ হাজার পরিবারের ৭৫ হাজার মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছেন। 

তিস্তা ব্যারাজের সবকটি স্লুইস গেট খুলে দেওয়ায় নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার শৌলমারী বানপাড়ায় ডানতীর গ্রাম রক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এই বাঁধ ভেঙে শুধু বানপাড়ায় নয়, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের ২০ হাজারেরও বেশি পরিবারের ঘরবাড়ি তিস্তা নদীর পানিতে তলিয়ে যায়। অপরদিকে, ডিমলা উপজেলার চরখড়িবাড়ি এলাকায় স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বাঁধটি তিস্তার পানির তোড়ে ভেঙে গিয়ে এলাকার দুই হাজার পরিবার নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছে।

লালমনিরহাটে রেড অ্যালার্ট: লালমনিরহাটে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর দুই কূল ছাপিয়ে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে। গত দুই দিন ধরে তিস্তার পানি অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকায় হাতীবান্ধা উপজেলার গোড্ডিমারী ইউনিয়নে অবস্থিত তিস্তা ব্যারাজের উত্তর প্রান্তের ফ্লাড বাইপাস সড়কটি যে কোনও মুহূর্তে কেটে দেওয়া হতে পারে বলে জানান কর্মকর্তারা। এ কারণে তিস্তা ব্যারাজের আশপাশে এবং ফ্লাড বাইপাস সড়কটির উজানে ও ভাটিতে বসবাসকারী লোকজনসহ নদী তীরবর্তী লোকজনকে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে। একইসঙ্গে বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কায় এই এলাকায় রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে।

দহগ্রামে বাড়ছে পানি : তিস্তায় পানি পরিমাপের দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী আমিনুর রশীদ বলেন, ‘তিস্তার পানি আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন্যা ৪-৫ দিন স্থায়ী হতে পারে। পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনে ফ্লাড বাইপাসটি কেটে দিতে হতে পারে। এজন্য লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। প্রশাসন সমন্বিতভাবে সবকিছু নিরাপদ করার চেষ্টা করছে।

বিপদসীমার ওপরে ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র : উজানের ঢলে কুড়িগ্রামের সবকটি নদ-নদীর পানি বাড়ছে। ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে গত ২৪ ঘণ্টায় চর ও দ্বীপ চরসহ নদী তীরবর্তী নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে সাতটি উপজেলার ৫০টির বেশি গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া তিস্তা নদীর পানি বাড়লেও কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি : চিলমারীর প্রবেশ মুখে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে রমনা ইউনিয়নের হরিপুর এলাকার মহির প্রামাণিকের বাড়ির পাশের একটি সাব বাঁধ ভেঙে গিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আজগর আলী সরকার। তিনি জানান, তার ইউনিয়নের বাসন্তিপাড়া, মাঝিপাড়া, রায়পাড়া, টোন গ্রাম, উত্তর রমনা, খেউনিপাড়াসহ অন্তত ১৫টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় এসব গ্রামের বাসিন্দারা ইউনিয়নের ওয়াপদা বেরিবাঁধ, জোরগাছ ২নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং রিয়াজুল জান্নাত মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। কুড়িগ্রাম সদরের চর যাত্রাপুর, পোড়ারচর, কালির আলগাসহ যাত্রাপুর ইউনিয়নের অন্তত ২০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী সরকার। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উমর ফারুখ জানান, ধরলা নদীর পানি বেড়ে তার ইউনিয়নে ধরলার উত্তর তীরবর্তী অংশের গ্রামসহ সারডোব, সাত কালোয়া, খামার হলোখানা এলাকা প্লাবিত হয়ে প্রায় তিন হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন।

উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. বেলাল হোসেন জানান, তার ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডে পানি প্রবেশ করেছে। এসব এলাকার রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গিয়ে সড়ক যোগাযোগ ভেঙে পড়েছে। নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মজিবর রহমান জানান, তার ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে সাতটি ওয়ার্ডের সব গ্রাম পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এসব গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। তিনি নৌকায় করে তথ্য সংগ্রহ করছেন বলে জানান এই চেয়ারম্যান। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি বেড়ে কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের নদীগুলোর উৎসস্থলের ভারতীয় অংশে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় উজানের ঢলে আগামী দুই-তিন দিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। এতে করে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।’

বাড়ছে যমুনা, করতোয়া এবং ঘাঘট নদীর পানিও : গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র নদের তিস্তামুখ ঘাটে পানি বেড়ে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটারের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া তিস্তা, যমুনা, করতোয়া, ঘাঘট নদীর পানিও বেড়েছে। তিস্তা ও ঘাঘট নদীর শহর পয়েন্টে পানি বিপদসীমা ছুঁইছুঁই করছে। যেকোনও সময় কয়েকটি পয়েন্টে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে জানিয়েছে গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ড। বৃষ্টি আর উজানের ঢলে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর তীরবর্তী গাইবান্ধার চরসহ নিম্নাঞ্চলের অন্তত ২০টি গ্রাম ডুবে গেছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ। এসব এলাকার কাঁচা রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। পানিতে ডুবে গেছে ধানের বীজতলা, পাট, মরিচসহ বিভিন্ন ফসলের জমি। পানি বৃদ্ধি আর তীব্র স্রোতের কারণে নদীর তীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনে এরই মধ্যে চার উপজেলার অন্তত পাঁচ শতাধিক বসতভিটা ও আবাদি জমি নদীতে তলিয়ে গেছে।

পানি বেড়ে যাওয়ায় তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীতে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে সুন্দরগঞ্জ, সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার নদী তীরের অন্তত পাঁচ শতাধিক পরিবারের মানুষ ভিটেমাটি হারিয়েছেন। সবচেয়ে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে সুন্দরগঞ্জের হরিপুর, কাপাসিয়া, বেলকা, সদরের কামারজানি, গোঘাট, ফুলছড়ির ফজলুপুর, এরেন্ডাবাড়ি, উড়িয়া ও গজারিয়াতে। হুমকির মুখে রয়েছে শত শত বসতভিটা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, ফসলি জমিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। অনেকে তাদের সহায়-সম্পদ নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেছুর রহমান জানান, গত কয়েক দিন ধরে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনাসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি অল্প অল্প বাড়লেও বৃহস্পতিবার থেকে পানি বৃদ্ধির হার বেড়ে গেছে। শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের তিস্তামুখ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া তিস্তা ও ঘাঘটের শহর পয়েন্টে পানি বিপদসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে।

ঢল আসছে উত্তর-পূর্ব দিক থেকেও : দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদীগুলো দিয়ে পাহাড়ি ঢলের পানি আসছে এবং বৃষ্টির কারণেও পানি বাড়ছে। সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি শনিবার বিপদসীমার ৮৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রভাবিত হচ্ছে। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিক ভুইয়া জানান, শনিবার সকাল পর্যন্ত জেলার ১১টি উপজেলার ১৫ হাজার পরিবারের ৮০ হাজার লোক পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। জেলার বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার, সুনামগঞ্জ সদর, জামালগঞ্জ, ধরমপাশা উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড গত ২৪ ঘণ্টায় ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে।

গ্রামের রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় মানুষের চলাচলে খুব অসুবিধা হচ্ছে। এছাড়া প্রতিটি বাড়িতে পানি ঢোকায় গ্রামবাসী গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি নিয়ে বিপদে আছেন। পানির কারণে তারা রান্না করতে পারছেন না। মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী শনিবার দুপুরে বলেন, ‘টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে মনু ও ধলাই নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। তবে পানি নামতে শুরু করেছে। বন্যা মোকাবিলায় আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।’

রাঙামাটি জেলায় ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে রাঙামাটির দুর্গম বাঘাইছড়ি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে গৃহবন্দী হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার মানুষ। শুক্রবার দুপুর থেকে বাঘাইছড়িতে মুষলধারে বৃষ্টিপাতের কারণে ও পাহাড়ি ঢলে পানির উচ্চতা আরও বেড়েছে। উপজেলার ২৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া মানুষ এখনও আশ্রয়কেন্দ্রেই অবস্থান করছেন। শুক্রবার সকালে বাঘাইছড়ির প্লবিত এলাকা পরিদর্শনে যান রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা। এসময় তিনি এলাকাবাসী খোঁজখবর নেন এবং প্লাবিত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে নগদ টাকা বিতরণ করেন।

বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আহসান হাবিব জিতু জানান, যদি আরও বৃষ্টিপাত হয় তাহলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী আমরা ৩২৭ পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছি। খাবার পানির সংকট মোকাবিলায় প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও খাবার স্যালাইন বিতরণ করা হয়েছে।

বান্দরবান : আটদিনের অবিরাম বৃষ্টিতে বান্দরবানে বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে নিম্নাঞ্চলের প্রায় দশ হাজারেরও বেশি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অবিরাম বর্ষণ অব্যাহত থাকায় উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃষ্টির কারণে বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কের বাজালিয়ার বড়দুয়ারা এলাকার রাস্তা তলিয়ে যাওয়ায় ও বান্দরবান-রাঙামাটি সড়কের কয়েকটি স্থানে সড়ক ধসে গিয়ে জেলার সাথে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ গতকাল শনিবারও বন্ধ ছিল। অবিরাম বর্ষণ অব্যাহত থাকায় নদীর পানি প্রবেশ করে শহরের আর্মিপাড়া, ইসলামপুর, অফিসার্স ক্লাব, বনানী স মিল এলাকা, শেরেবাংলা নগর, বাস স্টেশন, সাঙ্গু নদীর তীরবর্তী এলাকাসহ কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া জেলার লামা, আলীকদম ও থানচি, রুমা উপজেলায় নিম্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিভিন্ন উপজেলায় ছোট ছোট পাহাড় ধস ও সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় জেলার সাথে সব উপজেলারও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এদিকে বন্যা ও পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে বসবাসকারী ১২০০টি পরিবারকে জেলার ১৩১টি আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে।

গত ৬ই জুলাই থেকে টানা বৃষ্টিতে খাগড়াছড়িতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পাহাড় ধস ও সড়কে পানি ওঠায় খাগড়াছড়ির সঙ্গে রাঙ্গামাটির সড়ক যোগাযোগ এখনও বিচ্ছিন রয়েছে। এদিকে পাহাড়ি ঢল ও উজান থেকে নেমে আসা বন্যার পানি কমে গিয়ে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও পাহাড় ধসের আশঙ্কায় কাটেনি আতঙ্ক। টানা ৮ দিনের বৃষ্টিতে পুরো জেলার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। প্রশাসনের সহযোগিতায় দূর্গতদের নেয়া হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্রে।

বন্যা পরবর্তী খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী, জেলা পরিষদ, পৌর প্রশাসন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে রান্না করা খাবার, শুকনা খাবার, বিভিন্ন ত্রাণ এবং ওষধ বিতরণ করা হচ্ছে। খাগড়াছড়ি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তর জেলায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে ৪৫ হাজার ট্যাবলেট ও পানির জার সরবরাহ করেছে।

নদী ভরাট হওয়ার কারণে একটানা কিছুক্ষণ বৃষ্টি হলেই খাগড়াছড়ির চেঙ্গী ও মাইনি নদী পানিতে তলিয়ে যায়। ফলে প্রতিবছর বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় খাগড়াছড়িবাসীর। এজন্য চেঙ্গী ও মাইনি নদী খননের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন তারা।

এই জেলায় বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শত শত পুকুর, মৎস্য খামার ও ক্রীক বাধ ভেঙে যাওয়ায় মাছ চাষীদের মাথায় হাত পড়েছে। খাগড়াছড়ি জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ কে এম মোখলেছুর রহমান জানান, বিভিন্ন উপজেলার তথ্যমতে আনুমানিক দেড় কোটি টাকার পোনা মাছের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দীঘিনালা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অবর্ণা চাকমা বলেন, কবাখালী, পাবলাখালী, মেরুং, বেতছড়ির বিভিন্ন এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় পুকুর ও ক্রীক ভেঙে প্রায় ৭০-৮০ লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর দফতর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কোনও অবস্থাতেই যেন বন্যায় কোনও লোক মারা না যান, খাদ্যে কষ্ট না পান বা কোনও দুর্ঘটনা যেন না ঘটে, সে বিষয়ে সার্বক্ষণিক নজর রাখতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন হলে বন্যাকবলিত এলাকায় প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বন্যা ও আবহাওয়ার পূর্বাভাস
গতকাল শনিবার নদ-নদীর পরিস্থিতি সম্পর্কে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, দেশের সব প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ৭২ ঘণ্টায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে এবং আগামী ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদী সারিয়াকান্দি এবং কাজিপুর পয়েন্টে বিপদসীমা অত্রিক্রম করতে পারে। এতে দেশের মধ্যাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

এছাড়া আগামী ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম, সিলেট ও রংপুর বিভাগের সুরমা, কুশিয়ারা, কংস, সোমেশ্বরী, ফেনী, হালদা, মাতামুহুরী, সাঙ্গু, ধরলাসহ প্রধান নদীগুলোর পানি সমতলে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। এছাড়াও আগামী ২৪ ঘণ্টায় নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণাধীন ৯৩টি পানি সমতল স্টেশনের মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ৭৯টিতে এবং কমেছে ১১টি পয়েন্টে। বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ২৩টি পয়েন্টে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ও ভারত আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য দিয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং সংলগ্ন ভারতের সিকিম, পশ্চিমবঙ্গের উওরাঞ্চল, আসাম ও মেঘালয় প্রদেশের বিস্তৃত এলাকায় আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় মাঝারি থেকে ভারি এবং কোথাও কোথাও অতিভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল সংলগ্ন ভারতের বিহার এবং নেপালে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।

https://www.dailysangram.com/post/382700