তিন পার্বত্য জেলায় সশস্ত্র সংগঠনগুলোর চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ। খোলা বাজারে পাহাড় থেকে আনা কলা বিক্রেতা থেকে শুরু করে চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী সবার কাছ থেকেই আদায় করা হয় চাঁদা। কার কাছ থেকে কত টাকা চাঁদা নেয়া হবে সে রেটও নির্দিষ্ট করা আছে। বিভিন্ন মাধ্যমে তা ব্যাপকভাবে প্রচারও করেছে সশস্ত্র সংগঠনগুলো। এর মধ্যে রয়েছে- জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (সংস্কার) ও ইউপিডিএফ। সবমিলিয়ে এ তিন এলাকার বাসিন্দাদের কাছে চাঁদার এ রেট মুখস্ত। সেনাবাহিনী ও পুলিশ মাঝে-মধ্যে চাঁদাবাজদের আটক করলেও এটা রোধ করা সম্ভব হয়নি। নিত্য-নতুন উপায়ে অত্যন্ত কঠোরতার সঙ্গে এসব চাঁদা আদায় করা হয়। এদিকে চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি করলে কিংবা না দিলে তাদের প্রাণ নাশের পাশাপাশি নানাভাবে হয়রানি করা হয়। এ কারণে পার্বত্য এলাকার মানুষের মাঝে এখন বিরাজ করছে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর চাঁদা আতঙ্ক। বেশির ভাগ ভুক্তভোগী চাঁদার বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে স্বীকার করেন না। কারণ দুর্গম এলাকা হওয়ায় পুলিশ বা অন্যান্য বাহিনীর পক্ষে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালিদের পাশাপাশি উপজাতিদের কাছেও এখন আতঙ্কের নাম চাঁদাবাজি। পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে নিয়মিত কাজ করেন এমন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টেও চাঁদাবাজির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। এ নিয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারক মহলকেও জানানো হয়েছে। সেখানে চাঁদার সুনির্দিষ্ট হিসাবও তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বছরে এ তিন জেলায় শুধু চাঁদা তোলা হয় ৪০ কোটি ২৯ লাখ ১৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাঁদা তোলা হয় খাগড়াছড়িতে। সেখানে বছরে চাঁদা ওঠে ১৯ কোটি ৫৩ লাখ ৮৮ হাজার ১শ’ টাকা। এ টাকার ১১ ভাগ অর্থাৎ ২ কোটি ১২ লাখ ৯৭ হাজার ৩০৩ টাকা তোলে জেএসএস। ৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫২ হাজার ৫৪৩ টাকা আদায় করে ইউপিডিএফ। যা মোট চাঁদার ৫১ ভাগ। অন্যদিকে জেএসএস (সংস্কার) চাঁদা তোলে ৭ কোটি ৪৬ লাখ ৩৮ হাজার ২৫৪ টাকা। এরপরই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চাঁদা আদায় হয় বান্দরবানে। সেখানকার পরিমাণ ১৩ কোটি ২৮ লাখ ৮২ হাজার টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৮৮ ভাগ অর্থাৎ ১১ কোটি ৬৪ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৫ টাকায় যায় জেএসএস এর তহবিলে। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সবচেয়ে কম চাঁদা তোলা হয় রাঙ্গামাটিতে। ৭ কোটি ৪৬ লাখ ৪৫ হাজার ৯শ’। এর মধ্যে জেএসএস আদায় করে ৫ কোটি ৭৪ লাখ ৫ হাজার ৯শ’ ৫ টাকা। ইউপিডিএফ ২ কোটি ২১ লাখ ৯৮ হাজার ৯৫ টাকা ও জেএসএস (সংস্কার) ১৭ লাখ এক হাজার ৯শ’ টাকা। এ প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মজিদ আলী মানবজমিনকে বলেন, বিষয়টি অনেকটা ওপেন-সিক্রেটে পরিণত হয়েছে। আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর নাম করে বিপুল পরিমাণ টাকা তোলা হয। এ সবের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের নিয়মিত গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তাদের বেশির ভাগই উঠতি বয়সের। পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাও চাঁদাবাজিদের রুখতে একযোগে কাজ করছে। গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন খাত ছাড়াও বছরের বিভিন্ন সময়ে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, জুম্ম জাতীয় নেতার মৃত্যু দিবস, মাতৃভাষা দিবস, দলের কাউন্সিল, বৈসাবি/বিজু/সাংগ্রাই,পূজা, বৌদ্ধ পুর্ণিমা, বৌদ্ধ বিহার/মন্দির, কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান ইত্যাদির নামে বিভিন্ন ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান, কাঠ ব্যবসায়ী সমিতি, যানবাহন মালিক সমিতি, ব্রিকফিল্ড সমিতি, জেলা পরিষদ, উন্নয়ন বোর্ড, ব্যাংক, এনজিও, সরকারি/বেসরকারি অফিস ইত্যাদি থেকে চিঠি দিয়ে রশিদের মাধ্যমে চাঁদা আদায় করে থাকে।
যেভাবে চাঁদা চাওয়া হয়
সম্মানীত, পার্টির পক্ষ থেকে আপনাকে/আপনাদেরকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও সংগ্রামী অভিবাদন জানাচ্ছি। আমাদের পার্টি গত ১৮ বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম সরকারের নির্যাতন-নিপীড়ন ও ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে গণ-আন্দোলন করে আসছে। আমরা এ সময় অসংখ্য সভা-সমাবেশ ও মিছিল মিটিংয়ের আয়োজন করেছি। ভূমি বেদখল ও বাঙালি সেটলার হামলার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্ব দিয়েছি। হামলার ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছি। ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি এবং ভূমিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আইনগতভাবে লড়াই পরিচালনা করেছি। আমাদের এই সর্বব্যপী আন্দোলন এখনও অব্যাহত রয়েছে। এবং ভবিষ্যতে আরও জোরদার করা হবে। আপনারা জানেন জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে আন্দোলন পরিচালনার জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন। অথচ আমাদের পার্টির নিয়মিত কোনো আর্থিক উৎস নেই। এ কারণে আমাদের পক্ষে অনেক সময় আন্দোলন পরিচালনা করতে হিমশিম খেতে হয়। এ অবস্থায় সুষ্ঠুভাবে আন্দোলন পরিচালনার স্বার্থে একটি স্থায়ী তহবিল গড়ে তোলার জন্য আপনাদের তথা সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আমরা সকল স্তরের চাকরিজীবীদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পার্টি ও তহবিল নিম্নোক্ত হারে নিয়মিত বাৎসরিক এককালীন বিশেষ আর্থিক অনুদান প্রদানের জন্য আপনাদের কাছে প্রস্তাব করছি।
প্রস্তাবনা-প্রত্যেক চাকরিজীবী (যে স্তরের হোন না কেন) তার মাসিক মূল বেতনের ২% হারে বছর শেষে পুরো ১২ (বার) মাসের টাকা একসাথে প্রদান করে পার্টিকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করবেন। যারা ১ম শ্রেণির চাকরিজীবী অথবা যারা বেতন ছাড়াও যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেন তারা মাসিক মূল বেতনের ৩% হারে পুরো ১২ (বার মাসের টাকা একসঙ্গে প্রদান করে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করবেন। অথবা-প্রত্যেক চাকরিজীবূ প্রতি মাসের ১ বা ২ দিনের বেতনের টাকা (মাসিক মূল বেতনের) একসঙ্গে সুবিধাজনক সময়ে প্রদান করে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করবেন। অর্থাৎ প্রতিমাসে ১ দিন হিসাবে ১ দিন বেতনের টাকা অথবা প্রতি মাসে ২ দিন হিসেবে ১২ মাসের ২৪ দিনের বেতনের টাকা এককালীন সহযোগিতা প্রদান করবেন। এ প্রস্তাবনা আপনাদের সাথে পুনরায় আলোচনা সাপেক্ষে চূড়ান্ত হতে পারে। ২০১৬ সাল প্রায় শেষ হতে চলছে। তাই এ বছর আর্থিক সহায়তা উক্ত নিয়মে অর্থাৎ মূল বেতনের ১২ মাসের বা বাৎসরিক এককালীন সহযোগিতা আগামী ২/১/১৭ ইং এর মধ্যে প্রদানের জন্য সকল চাকরিজীবীদের প্রতি বিশেষ অনুরোধ করা গেল। এই সহযোগিতা অর্থ নিম্নে ০১৮৬৯-০৯২৬৫৮ ফোন নম্বরে সরাসরি যোগাযোগ করে জমা দিতে পারবেন। আমরা আশা করি দলমত নির্বিশেষ আপনারা জুম্ম জাতির বৃহত্তর স্বার্থে পার্টিকে নিয়মিত বিশেষ আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে আন্তরিকভাবে শরিক হবেন। কোন চাকরিজীবী চলতি বছরের বাৎসরিক আর্থিক অনুদান ইতিমধ্যে পার্টির কোনো ইউনিটে প্রদান করে থাকলে তাকে আর দ্বিতীয়বার দিতে হবে না। তবে কারোর একাধিকবার অথবা নির্ধারিত হারের টাকা ও বেশি সহযোগিতা প্রদানের আগ্রহ থাকলে দিতে পারবেন। আমাদের প্রত্যাশা খাগড়াছড়ি পানছড়ি উপজেলা সদরে সবাই পার্টির আহ্বানে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসবেন। সকলের আন্তরিক সহযোগিতা ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে জুম্ম জনগণের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন অর্জন সম্ভব বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বিজয় আমাদের অনিবার্য। অর্থ বিভাগ, পানছড়ি ইউনিট। তারিখ-১২/১২/২০১৬, পার্বত্য চট্টগ্রাম (খাগড়াছড়ি)।
http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=46749&cat=2/%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A7%87-%E0%A6%B8%E0%A6%B6%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%97%E0%A6%A0%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%81%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%A4%E0%A7%8D