২৩ মে ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১২:৫৮

বিদেশে 'প্রশিক্ষণেই' ১৩১ কোটি টাকা!

জ্বালানি তেলের চাহিদা মেটাতে সরকারি তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির (ইআরএল) দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নকালে চার বছরে ৮৭৩ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের বিদেশে প্রশিক্ষণ ও স্টাডি ট্যুরের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ জনপ্রতি গড়ে ব্যয় হবে প্রায় ১৬ লাখ টাকা। তিন দিন থেকে শুরু করে ১৮০ দিনের এসব বিদেশ 'ট্যুর' ও 'প্রশিক্ষণে' অংশগ্রহণকারী প্রতিজন সর্বনিম্ন ৮০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ সাতাশ লাখ টাকা ভাতা পাবেন। মোট প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবনা (ডিপিপি) বিশ্নেষণ করে এ তথ্য জানা গেছে। শিগগিরই এই ডিপিপি জ্বালানি বিভাগ থেকে পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন, জ্বালানি বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ও ইআরএলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এসব 'ট্যুর' ও 'প্রশিক্ষণে' অংশ নেবেন। তবে ৩০ দিন ও ১৮০ দিনের প্রশিক্ষণে মূলত ইআরএলের জনবল থাকবে। কর্মীদের জন্য এত ব্যয়বহুল প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই ডিপিপি তৈরিতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লি. এর সহযোগিতা নিয়েছে ইআরএল।

শুধু প্রশিক্ষণেই শতাধিক কোটি টাকা ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, সরকারি প্রকল্পে প্রশিক্ষণের নামে প্রহসন চলে। প্রতিযোগিতাহীন প্রকল্পে কিছু খাতে বেশি বেশি বরাদ্দ রাখা হয়। আর এই প্রকল্প প্রস্তাবগুলো যেসব কর্মকর্তা প্রস্তুত করেন, তারাই প্রশিক্ষণে অংশ নেন। এতে জনস্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হয় তা ভাবার বিষয়। এসব ডিপিপি মন্ত্রণালয়গুলো নামেমাত্র যাচাই-বাছাই করে। পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্প ব্যয় কমাতে তেমন ভূমিকা রাখে না। তিনি বলেন, স্টাডি ট্যুরের নামে বিদেশ গমনে অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশনসহ সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি থাকেন। ফলে তাদের প্রকল্প ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখা যায় না। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি প্রকল্পে এ ধরনের প্রশিক্ষণের নামে প্রচুর জনবল বিদেশে ঘুরে এসেছেন; কিন্তু খনি নিয়ে তারা কতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছেন তা বড়পুকুরিয়ার বর্তমান চিত্র দেখলে স্পষ্ট হয়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, একটি প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন ও পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত জনবল জরুরি। কিন্তু দেশের প্রকল্পগুলোতে দেখা যায় যাদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, তারা সুযোগ পান না। তদবির ও দুর্নীতির মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় লোকজন প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নেন। যা প্রকল্পের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে। তাই যাদের দরকার, তারাই যেন প্রশিক্ষণে সুযোগ পান সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

ইআরএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আখতারুল হক বলেন, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদারের সুপারিশ ও চাহিদা অনুসারে ডিপিপি প্রস্তুত করা হয়েছে। খাত অনুসারে যৌক্তিক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, এই প্রকল্প অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর হবে। যা পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ খাতের ব্যয় যৌক্তিক বলে মন্তব্য করেন তিনি। এর পরও জ্বালানি বিভাগ ও পরিকল্পনা কমিশন যাচাই করে দেখবে অর্থ বরাদ্দ ঠিক আছে কি-না।

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। এটি যাচাই করে প্রয়োজনে তা পুনর্বিবেচনা করা হবে।

দেশে জ্বালানি পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে জ্বালানি পণ্যের চাহিদা ছিল ৬৯.৮ লাখ মেট্রিক টন। যা ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে হবে ৭৮.৫ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ইআরএলের উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ১২ লাখ মেট্রিক টন। বাকি চাহিদা আমদানির মাধ্যমে মেটাতে হয়। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়। এ জন্য সরকার ইআরএলের শোধনক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়। ২০১০ সালেই ৩০ লাখ মেট্রিক টন পরিশোধন ক্ষমতার ইআরএল দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এরপর প্রায় নয় বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়নি। এখন পর্যন্ত শুধু নকশা প্রণয়ন, ঠিকাদার নিয়োগ আর ডিপিপি প্রস্তুত হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বিশেষ আইনের আওতায় প্রতিযোগিতাহীনভাবে বাস্তবায়িত এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে চার হাজার ৪৭২ কোটি টাকা ঋণ, দুই হাজার ৯৮১ কোটি টাকা সরকারি অর্থ এবং বিপিসির নিজস্ব অর্থায়ন ১১ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। ইউনিটির লাইফটাইম ধরা হয়েছে ২০ বছর।

এই ইউনিট থেকে বছরে ১১ লাখ মেট্রিক টন ডিজেল, ৫ লাখ মেট্রিক টন জেট ফুয়েল, চার লাখ মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল, দুই লাখ মেট্রিক টন লুববেজ অয়েল ও ছয় লাখ মেট্রিক টন গ্যাসোলিনসহ অন্যান্য পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য পাওয়া যাবে। দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের পর দেশের পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম পণ্যের আমদানি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ হ্রাস পাবে।

প্রকল্পের মেয়াদকাল ধরা হয়েছে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে ফরাসি কোম্পানি টেকনিপ। ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর কোম্পানিটির সঙ্গে এমওইউ সই হয়। স্বাধীনতার আগে ১৯৬৮ সালে টেকনিপই ইআরএল শোধনাগার নির্মাণ করে দেয়।

প্রশিক্ষণ ও ট্যুরে ১৩১ কোটি টাকা :প্রকল্প প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নের বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনে অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন ও এনবিআরের একজন করে, বিপিসির দু'জন এবং জ্বালানি বিভাগ ও ইআরএলের তিনজন করে ১১ জন প্রতিনিধি বিদেশে তিন দিনের স্টাডি ট্যুরে অংশ নেবেন। ২০২০ সালে জুলাই অথবা আগস্ট মাসে বাস্তবায়নের সম্ভাব্য সময় ধরে এই ট্যুরে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫ লাখ ২৯ হাজার টাকা। এই ট্যুরের সব খরচ প্রকল্প ব্যয় থেকে মেটানো হবে। পাশাপাশি প্রতিজন দৈনিক ১৮ হাজার ৩০০ টাকা করে ভাতা পাবেন। এ ছাড়া অন্যান্য ভাতা হিসেবে একবারে আরও ২৫ হাজার টাকা পাবেন। অর্থাৎ তিন দিনের এই বিদেশ ট্যুর শেষে প্রতিজন প্রায় ৮০ হাজার টাকা ভাতা পাবেন। এই প্রকল্প চলাকালে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিদেশে তিন দিন থেকে শুরু করে ৩০ দিনের এমন ট্যুর বা প্রশিক্ষণের সংখ্যা ১৪টি। এর মধ্যে তিন থেকে ১০ দিনের তিনটি স্টাডি ট্যুরে মোট ৩২ জন অংশ নেবেন। যারা মূলত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি। তারা বিভিন্ন দেশে এ ধরনের রিফাইনারি দেখতে যাবেন। এসব ট্যুরে ব্যয় হবে ২৫ লাখ থেকে ৩৫ লাখ টাকা। ৩০ দিনের প্রশিক্ষণ রয়েছে ৯টি। প্রতি দলে ৩১ থেকে ৬০ জন প্রতিনিধি থাকবেন। মোট অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা হবে ৪৪১ জন। তারা হবেন ইআরএলের কর্মী। দলের আকার অনুসারে এই প্রশিক্ষণে দুই কোটি ২৫ লাখ থেকে সর্বোচ্চ চার কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। ত্রিশ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে একজন কর্মকর্তা প্রায় পৌন ছয় লাখ টাকা ভাতা পাবেন। এ ছাড়া সাত দিনের দুটি প্রশিক্ষণ ট্যুরে যাবেন ২০ জন। এ ছাড়া বিদেশে ঠিকাদারের কার্যালয়ে ১৮ মাসের নকশা-সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের সুযোগ রয়েছে। যাতে চার ভাগে পাঁচজন করে মোট ২০ জন অংশ নেবেন। যেখানে প্রতিজন ভাতা হিসেবে পাবেন প্রায় ২৭ লাখ টাকা। এসব প্রশিক্ষণে কর্মকর্তারা রিফাইনারি ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ, পণ্য পরীক্ষণ ও প্রযুক্তিগত বিষয়ে শিক্ষা লাভ করবেন বলে ডিপিপিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশে ঠিকাদারের অফিস ও যন্ত্রপাতি পরিদর্শন এবং বিদেশে সভার সুযোগ পাবেন সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা। ১৫ জনের একটি দল ঠিকাদারের সঙ্গে ১০ দিনের সভায় অংশ নিতে বিদেশ গমন করবে। এমন সভা হবে ২৪টি। এতে মোট খরচ হবে ১৬ কোটি টাকা।

সব মিলিয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় বিদেশে প্রশিক্ষণ ও ট্যুরে ৮৭৩ জনের জন্য ১৩১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয় হবে বলে ডিপিপিতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ মাথাপ্রতি ব্যয় হবে প্রায় ১৬ লাখ টাকা। চার বছর মেয়াদি এই প্রকল্পে প্রতিবছরের জন্য বিদেশে ট্যুর ও প্রশিক্ষণ খাতে খরচ ধরা হয়েছে ৩২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।

অন্যান্য ব্যয় :এই প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভবন, সড়ক, ভূমি উন্নয়নসহ অবকাঠামো নির্মাণের জন্য রাখা হয়েছে সাত হাজার ১৯০ কোটি টাকা। কাস্টমস শুল্ক্ক খাতে দিতে হবে ৬৬০ কোটি টাকা। ভ্যাটে যাবে এক হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। বিভিন্ন রাসায়নিক পণ্য কিনতে খরচ হবে ২২৫ কোটি টাকা। যানবাহন ও জমি নিবন্ধনে ২৭ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয় হবে। ব্যাংকের বিভিন্ন চার্জ বাবদ খরচ হতে পারে ৩৭৮ কোটি টাকা। যানবাহন কেনার খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে এক কোটি ৮৭ লাখ টাকা। টেলিযোগাযোগ সরঞ্জাম কিনতে লাগবে ৮৩১ কোটি টাকা। বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬১৮ কোটি টাকা। প্রকৌশল খাতের পণ্যসেবার জন্য খরচ হবে তিন হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। গবেষণাগারের জন্য রাখা হয়েছে ১৬৭ কোটি টাকা। যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কিনতে ব্যয় হবে ৬০০ কোটি টাকা। ভূমি লিজে ২৪৫ কোটি টাকা দিতে হবে। ঠিকাদারের জন্য খরচ হবে এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ফিজিক্যাল কন্টিনজেন্সি খাতে ২৭২ কোটি টাকা এবং প্রাইস কন্টিনজেন্সি খাতে ৭৫৭ কোটি টাকা রাখা হয়েছে ডিপিপিতে।

https://samakal.com/economics/article/19051695