৪ মার্চ ২০১৭, শনিবার, ১:২৮

মিটফোর্ডে অন্যরকম ভোগান্তি

হাসপাতালের মেঝেতে প্রচণ্ড ধুলোর মধ্যেই দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের ঠাণ্ডার ডাক্তার দেখানোর জন্য অপেক্ষা মায়েদের। বেলা সাড়ে ১১টা। হাসপাতালের মেঝেতে প্রায় এক ইঞ্চি পুরো ধুলা। ডাক্তারের রুমের সামনেই পড়ে আছে নোংরা ময়লার একটি প্লাস্টিকের পাত্র। ২০৯ নম্বর কক্ষের সামনে রোগীর দীর্ঘ লাইন। লাইনে ছোট ছোট শিশুদের কোলে নিয়ে মায়েরা অপেক্ষা করছেন। এসব শিশু কিছুক্ষণ পরপরই হাই তুলছে। কোনো কোনো শিশুকে প্রচণ্ড কাশতেও দেখা গেছে। কেউবা জোরে জোরে কান্নাকাটি করছে। আবার মায়েরা কোনো কোনো শিশুর মুখ হাত, কেউবা কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছেন। আট মাসের শিশু ফাতেমাকে নিয়ে অপেক্ষা করছেন এক মা। শিশু ঠাণ্ডায় ভুগছে। কিছুই মুখে নিচ্ছে না।

ফলে ডাক্তার দেখানোর জন্য তার মা স্যার সলিমুল্লাহ মডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে আসেন। বহির্বিভাগে টিকিট কেটে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করছেন তিনি। ২৩শে ফেব্রুয়ারি সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালটির বহির্বিভাগের মেডিসিন ১১৮ নম্বর কক্ষের সামনে ব্যাপক জটলা। বিশৃঙ্খলা। দুপুর তখন সাড়ে ১২টা। রোগীরা কেউ সকাল ৯টা, কেউবা সকাল ১০টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। ডাক্তারের অপেক্ষা করছেন অর্ধশত রোগী। কিন্তু মহিলা দালালরা কিছুক্ষণ পর পরই ডাক্তারের রুমে অন্য রোগী নিয়ে দেখিয়ে আনছেন। রোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালের মহিলা দালালরা টাকার বিনিময়ে এসব কাজ করছে। আর এজন্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে।

বয়স্ক আবদুল হাকিম। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য টাকা জমা দিতে সকাল ৯টা থেকে লম্বা লাইনে অপেক্ষা করছেন। ১২টার দিকে তিনি অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতালের কর্মচারীরা ঘুষের বিনিময়ে অনেককে আগেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার টাকা লাইন ছাড়া জমা দেয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন। অথচ আমরা লাইনে দাঁড়িয়ে কষ্ট করছি। তখনো তার সামনে ৩০-৪০ জন রোগী বা রোগীর স্বজনরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি জমা দেয়ার অপেক্ষায় আছেন। আবদুল হাই। কোস্টারের কর্মচারী। তার একটি পা ভেঙে গেছে। তার এক আত্মীয় তাকে কোলে নিয়ে অর্থোপেডিক রুমের সামনে ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করছেন।

আত্মীয়ের কাছে জানতে চাইলাম ট্রলি পেয়েছেন কিনা? উত্তরে একজন বললেন, না। দালালরা টাকা দাবি করেছে। এজন্য কোলে করে নিয়ে এসেছি। শুধু শিশু ফাতেমা বা আবদুল হাকিম নন, প্রতিদিন শত শত লোক স্বাস্থ্যসেবা নিতে এসে এভাবে পদে পদে ভোগান্তিতে পড়েন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত দেড়শ বছরেরও অধিক প্রাচীনতম স্বাস্থ্যসেবার এ হাসপাতালটিতে। পুরনো ঢাকার অধিকাংশ রাস্তা এমনিতেই সরু। এতে প্রায়ই দীর্ঘ যানজট লেগে থাকে। ফলে যেকোনা রোগীকে প্রচণ্ড যানজট ঠেলে আসতে হয় এ হাসপাতালে। এখানে এসেই রোগী ও তার আত্মীয়স্বজনকে আরো বেশি যন্ত্রণায় পড়তে হয়। চিকিৎসা নিতে এসে চরম হয়রানির শিকার হন তারা। প্রাইভেট প্যাথলজিক্যাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রতিনিধিরা এই হাসপাতালে সারা দিন ঘোরাফেরা করেন। তারা ডাক্তারদের সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকেন হাসপাতালে।

সুযোগ বুঝেই প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলোর প্রতিনিধিরা রোগীদের বাগিয়ে নেন। আর তাতে কিছু ডাক্তার তাদের থেকে কমিশন নেন বলে হাসপাতালটিতে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতালটিতে আগত রোগীকে জিম্মি করে দালালরা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তারা গ্রামের সহজ-সরল মানুষকে মুহূর্তের মধ্যে কবজা করে ফেলে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তারা তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

সরজমিন দেখা যায়, হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে সব সময়ই জটলা পাকিয়ে থাকে তারা। কোনো রোগী এলেই সক্রিয় হয়ে ওঠে এ চক্র। জরুরি বিভাগের সামনে থেকে টাকার বিনিময়ে রোগী ভর্তি থেকে শুরু করে সব বিষয়ে হাত বাড়াতে ওরা সদা প্রস্তুত। এ হাসপাতালে ভাসমান দালাল হিসেবে কাজ করছে মিটফোর্ড রোডস্থ ‘বাঁধন’ ক্লিনিকের ওয়াসিম, আলমগীর, হেনা আর ‘ডক্টরস’ ক্লিনিকের রুরেল, মোস্তফাসহ কয়েকজন। তারা সবসময় হাসপাতালে ঘোরাফেরা করে। ডাক্তাররা তাদের সহকারীদের মাধ্যমে বহির্বিভাগে দালালদের সঙ্গে রোগীদের দরকষাকষি করে।

এখানে ডাক্তারদের কক্ষের সামনেই তারা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় থাকে ডাক্তারা রোগীকে কোন ধরনের প্যাথলজিকাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধ দিচ্ছেন তা দেখতে। রোগী ডাক্তারদের কক্ষ থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্লিপ দেখার জন্য দালালরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এরকম এক রোগীর স্লিপ নিয়ে কয়েকজন দালালকে টানাহেঁচড়া করতেও দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, এ নিয়ে কয়েকজন ডাক্তারের সহকারীকে দালালদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে নিচতলায়। রোগীরা অভিযোগ করেন, কোম্পানির প্রতিনিধিরা অনেক সময় রোগীকে দেখার সময়ই চিকিৎসকদের কক্ষে ঢুকে পড়েন।

এ সময় তারা চিকিৎসকদের মনোযোগ কেড়ে নেন। ফলে ডাক্তাররা কখনো কখনো মনোযোগ হারিয়ে ফেলেন। তখন ডাক্তাররা কোনো রকমে রোগী দেখেই বিদায় করেন। সকাল থেকেই হাসপাতালের বহির্বিভাগে কোম্পানির লোকেরা বড় বড় ব্যাগ নিয়ে ঘুর ঘুর করে। অথচ সপ্তাহে দুদিন ডাক্তার ভিজিট করার নিয়ম থাকলেও তারা শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিনই আসছেন হাসপাতালে। রোগীকে জরুরি বিভাগের সামনে থাকা ট্রলি দিয়ে ওয়ার্ডে পৌঁছানোর জন্য গুনতে হয় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে সব সময়ই চাপ থাকে। তবে, টাকা দিলে সহজেই দ্রুত কাজ সমাধা করা যায়।

এক্সরের জন্য ওয়ার্ড বয়দের ২০-৩০ টাকা দিতে হয়। টাকা ছাড়া ঠিকমতো এসব সেবা পাওয়া দুরূহ। প্রসঙ্গত, ঘুষ নেয়ার অভিযোগে গত দু’বছরে সোহরাব নামের এক কর্মচারীকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বদলি করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক কর্মচারী বলেছেন, আগে তারা বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে স্যালাইনসহ রোগীর ওষুধ চুরি করলেও এখন আর করছেন না। প্রসূতি বিভাগ (লেবার ওয়ার্ডে) বিকাল ৪টার পর প্রায় সময় রোগী ভর্তি না করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এখানে এলে রোগীদের অন্যত্র চলে যেতে বলেন চিকিৎসকরা। এতে অনেক সময় গর্ভবতী মায়েদের রাস্তায় বাচ্চা প্রসব হয়ে যায়। অভিযোগ আছে, সিজার ওটিতে আগে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার ওষুধ লাগলে এখন সেখানে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে। জরুরি ওটিতে গজ-ব্যান্ডেজও কিনতে হয় রোগীদের।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=55910