৪ মার্চ ২০১৭, শনিবার, ১:০৭

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প

বর্জ্য নেওয়ার বিষয়ে চুক্তি সই আরও পিছিয়েছে

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপজ্জনক তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ফেরত নেওয়াসহ চারটি চুক্তি সই আরও পিছিয়ে গেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং পরমাণু শক্তি কমিশনের সূত্র জানায়, চুক্তিগুলো সইয়ের জন্য আসলে কোনো নির্দিষ্ট দিনক্ষণ এখনো ঠিক হয়নি। এই চুক্তিগুলো সই না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পের মূল চুক্তিও (জেনারেল কন্ট্রাক্ট) কার্যকর হবে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সূত্রগুলো জানায়, ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর প্রকল্পের মূল চুক্তি সই হওয়ার পর সম্পূরক চারটি চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করার জন্য ছয় মাসের একটি পথনকশা তৈরি করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী গত বছরের (২০১৬) জুন-জুলাই মাসে চুক্তিগুলো সই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত বছরের জুলাই মাসে সই হয় প্রকল্পের ঋণ চুক্তি। তখন এই চুক্তিগুলো ডিসেম্বরে সই হবে বলে জানা গিয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।

এই চারটি চুক্তির বিষয়বস্তু হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির আয়ুষ্কাল জুড়ে জ্বালানি (ইউরেনিয়াম) সরবরাহ নিশ্চিত করা; স্পেন্ট ফুয়েল (পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি বর্জ্য) ফেরত নেওয়া; যেকোনো বিষয়ে বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী নিশ্চিত সার্ভিস সরবরাহ এবং পারমাণবিক অবকাঠামো উন্নয়ন। এর মধ্যে স্পেন্ট ফুয়েল ফেরত নেওয়ার বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। কারণ এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে অতিমাত্রায় তেজস্ক্রিয় বিপজ্জনক পারমাণবিক বর্জ্য ফেরত নেওয়ার বিষয়ও।

তা ছাড়া এর প্রতিটি চুক্তির বিষয়বস্তুর সঙ্গে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি জড়িত রয়েছে, যা মূল চুক্তির অন্তর্ভুক্ত নয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পারমাণবিক জ্বালানি কিনতে যেমন অর্থ ব্যয় হবে, তেমনি স্পেন্ট ফুয়েল ফেরত পাঠানো, পরিশোধন করা প্রভৃতির জন্যও অর্থ ব্যয় করতে হবে। চাহিদা অনুযায়ী যেকোনো সার্ভিস অর্থ ছাড়া পাওয়া যাবে না। এসব বিষয় চূড়ান্ত করতে সময় লাগছে। এগুলো সবই চুক্তি সই পিছিয়ে যাওয়ার কারণ বলে মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়।

তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ফেরত নেওয়া প্রসঙ্গে পরমাণু শক্তি কমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তা (সাবেক ও বর্তমান) প্রথম আলোকে বলেন, রূপপুর কেন্দ্রটি স্থাপনের বিষয়ে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে ২০১১ সালে যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়, তাতে রাশিয়া স্পেন্ট ফুয়েল ফেরত নেবে বলে উল্লেখ আছে। কিন্তু স্পেন্ট ফুয়েল আর পারমাণবিক বর্জ্য যে এক নয়, বাংলাদেশের আসল চাওয়া যে পারমাণবিক বর্জ্য রাশিয়াকে ফিরিয়ে দেওয়া—এ বিষয়টির ফয়সালা করতে হবে আলাদা একটি চুক্তির মাধ্যমে।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্পেন্ট ফুয়েল পরিশোধন (রিসাইকেল) করে পুনর্ব্যবহারযোগ্য কিছু ইউরেনিয়াম, কিছু প্লুটোনিয়াম এবং অতিমাত্রায় তেজস্ক্রিয় কিছু বর্জ্য পাওয়া যায়। সাধারণভাবে স্পেন্ট ফুয়েল নেওয়ার অর্থ হলো ইউরেনিয়াম সরবরাহকারী দেশ এই ফুয়েল নিয়ে পরিশোধন করে ইউরেনিয়াম ও বর্জ্য সংশ্লিষ্ট দেশকে ফেরত দেবে। প্লুটোনিয়াম যেহেতু আণবিক অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, সেহেতু তা ফেরত দেওয়া হয় না। আর এক দেশের পারমাণবিক বর্জ্য সাধারণভাবে অন্য কোনো দেশ সংরক্ষণের জন্য নেয় না।

এই অবস্থায় উল্লিখিত চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে নিশ্চিত হতে হবে যে রাশিয়া স্পেন্ট ফুয়েল ফেরত নিয়ে শুধু পুনর্ব্যবহারযোগ্য ইউরেনিয়াম ফেরত দেবে। প্লুটোনিয়াম ও তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তারা রেখে দেবে। বাংলাদেশ এই চেষ্টাই করছে বলে পরমাণু শক্তি কমিশনের সূত্র জানায়। কারণ অতিমাত্রায় তেজস্ক্রিয় বর্জ্য বিশেষ ব্যবস্থায় শত শত বছর ধরে সংরক্ষণ করতে হয়, যা বাংলাদেশের পক্ষে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি কাজ।

চারটি চুক্তির অন্যগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা একটি। এই চুক্তির বিষয়বস্তু হচ্ছে, শুরুতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুল্লিতে (রিঅ্যাক্টর) পারমাণবিক জ্বালানি ভরা যে ১৬০টি রড (বান্ডেল) স্থাপন করা হবে, সেগুলোর এক-চতুর্থাংশ করে প্রতিবছর বদলাতে বা প্রতিস্থাপন করতে হবে। এভাবে তিনবার বদলানো, অর্থাৎ কেন্দ্রটির প্রায় চার বছর চলা পর্যন্ত যে জ্বালানি লাগবে, তার দাম মূল চুক্তিমূল্যের মধ্যে ধরা হয়েছে। তারপর থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পুরো আয়ুষ্কালে এই জ্বালানি প্রয়োজনীয় পরিমাণে (ইউরেনিয়াম) কিনতে হবে। চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়া এই জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করবে।

বিদ্যুৎকেন্দ্র-সংশ্লিষ্ট যেকোনো বিষয়ে বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী সার্ভিস নিশ্চিত করার চুক্তিতে থাকবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুল্লিতে জ্বালানি রড স্থাপন করা থেকে কেন্দ্রটি চালু করা এবং পরিচালনের যেকোনো পর্যায়ে সব বিষয়ে চাহিদা অনুযায়ী সার্ভিস সরবরাহ করা। আর পারমাণবিক অবকাঠামো উন্নয়ন চুক্তি করা হবে দেশে পারমাণবিক ল্যাবরেটরি স্থাপন ও উন্নয়ন, পারমাণবিক নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলা, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি প্রভৃতির লক্ষ্যে। এই চারটি চুক্তি সই না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পের মূল চুক্তি (জেনারেল কন্ট্রাক্ট) কার্যকর হবে না।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলেছে, এই চুক্তিগুলোর সই পিছিয়ে গেলেও তাতে বিদ্যুৎ প্রকল্পটির বাস্তবায়ন পেছাবে না। কারণ মাঠপর্যায়ে ও ল্যাবরেটরিতে এই প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সূচি অনুযায়ীই চলছে।

প্রকল্পের বাস্তবায়ন পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী অক্টোবরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল নির্মাণ পর্ব শুরু হবে। প্রতিটি ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিটের প্রথমটি ২০২৩ সালে এবং দ্বিতীয়টি ২০২৪ সালের শেষ ভাগে চালু হওয়ার কথা। 

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1096981