১২ মে ২০১৯, রবিবার, ১০:২৫

গ্যাসের আগুন এক মাসে কেড়ে নিলো ৮ জনের প্রাণ

রাকিব, শামীম, তরিকুল, আরিফ। কারো বাড়ি মেহেরপুর কারো ঝালকাঠি। আবার কেউ এসেছে পিরোজপুর আর মানিকগঞ্জ থেকে। সংসারের হাল ধরা এসব তরুণ জীবন সংগ্রামের তাগিদে কাজ নিয়েছে নারায়ণগঞ্জে রুপগঞ্জের ভুলতা সাওঘাট এলাকায় নেক্সট এক্সোসরিস লিমিটেড নামের একটি নামকরা টেক্সটাইল মিলে। কর্মস্থলের কাছেই রাবেয়া আক্তার মিলি নামের এক মহিলার দুই তলা বিল্ডিংয়ের নিচতলা ভাড়া নেন। সেখানেই থাকাতো এ চার শ্রমিকসহ আরো কয়েকজন।
প্রতিদিনে মতো গত ২১ এপ্রিল কাজ শেষে বাসায় ফিরে গভীর ঘুম। পরের দিন সকাল ৮টার দিকে আবার যাবে তাদের কর্মস্থলে। কিন্ত ২২ এপ্রিল ভোর রাতে হঠাৎ বিকট শব্দ। চারদিকে আগুন। দেয়ালের ইটগুলো টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। বিস্ফোরণে বিল্ডিংয়ের পুরো দেয়াল ভেঙে প্রায় ৫০ থেকে ৩০০ ফুট দূরে গিয়ে পড়েছে।

এ সময় কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। পরে স্থানীয়রা ঘটনাস্থলে এসে গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় ছয়জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করেন এবং তিনজনকে স্থানীয় ক্লিনিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। ২২ এপ্রিল সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে মারা যায় রাকিব, শামীম, তরিকুল আর ২৪ এপ্রিল মারা যায় আরিফুর রহমান। গ্যাসের আগুনে পুড়ে গেলো এসব শ্রমিকদের পরিবারের স্বপ্ন।

নিহতরা হলেন, মেহেরপুর জেলার মজিবনগর থানার কোমরপুর এলাকার দুদু মিয়ার ছেলে শামিম (৩০), ঝালকাঠি জেলার নলছিটি থানার কয়া এলাকার রহিম বিশ্বাসের ছেলে হেলাল বিশ্বাস ওরফে রাকিব (২৫) ও পিরোজপুর জেলার শরুফকাটি থানার শারেংকাঠি এলাকার মোশারফ হোসেনের ছেলে তরিকুল ইসলাম।

স্থানীয়রা জানান, তিতাস গ্যাসের হাই-প্রেসার পাইপ লাইন থেকে নেয়া অবৈধ গ্যাস সংযোগের কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। শবেবরাতের কারণে সমস্ত মিল-কারখানা বন্ধ থাকায় গ্যাসের প্রেসার ছিলো অধিক। ভোর সোয়া ৩টার দিকে হঠাৎ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ঢাকা সিলেট মহাসড়কের পাশ দিয়ে স্থাপিত তিতাস গ্যাসের হাই-প্রেসারের পাইপ লাইন থেকে অবৈধভাবে ওই বিল্ডিংটিতে গ্যাসের সংযোগ নেয়া হয়।

তিতাস গ্যাসের সোনারগাঁও জোনের সুপারভাইজার ইসমাইল হোসেন বলেন, এর আগেও এ ধরনের আরো বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। গ্যাসের প্রেসার অধিক ছিল। হয়তো বিল্ডিংয়ের ভেতরে গ্যাস ছড়িয়ে ছিল। আগুনের সংস্পর্শে গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে।

রুপগঞ্জের ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন ইনচার্জ আব্দুল মানান জানান, ২১ এপ্রিল রাতে গ্যাস সিলিন্ডারের লিকেজ থেকে গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে ওই ফ্ল্যাটে। ভোরে চুলা জ্বালাতে গেলে পুরো ফ্ল্যাটে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, গ্যাসের আগুনে জলজ্যন্ত চারজন গার্মেন্ট শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হলেও মনে হচ্ছে এ মৃত্যুর জন্য নিহতরাই দায়ী। কেন তারা ঐ বাসা ভাড়া নিয়েছিল। কেন তারা জানেনি ঐ বাসায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ নেয়া হয়েছিল।
মর্মান্তিক এদুর্ঘটনার মামলার খোঁজ নিয়ে স্থানীয়দের ক্ষোভের সত্যতা মিলেছে। চারজন শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় দুই মামলা হয় একটি দায়ের করেন রুপগঞ্জ থানার দারোগা রোকনুজ্জামান অন্যটি দায়ের করেন তিতাসের উপ-মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মিজবাহ উর রহমান। দুইটি মামলার এজহারই খুব দুর্বল।

৩০৪/৩৩৮ পেনাল কোড ১৮৬০ অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ নিয়ে অবহেলা ও তাচ্ছিন্নপূর্ণভাবে ব্যবহারের ফলে গ্যাস বিস্ফোরিত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ও গুরুতর জখমের অপরাধে পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করেন রূপগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক রোকনুজ্জামান।

১২ (১) ২০১০ সালের বাংলাদেশ গ্যাস আইন, অবৈধভাবে গ্যাস লাইন স্থাপন করে গ্যাস চুরি করার অপরাধে তিতাস গ্যাস কোম্পানির পক্ষ থেকে মামলা করেন তিতাস গ্যাস কোম্পানির আবিবি সোনারগাঁও (জোবিঅ-সোনারগাঁও) এর উপ-মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মিজবাহ উর রহমান।

এই দুই মামলাই প্রধান আসামী করা হয় বাড়ির মালিক রাবেয়া আক্তার মিলিকে। পুলিশ এই দুই মামলায় মিলিকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানোর পরের দিনই জামিনে বেরিয়ে আসে মিলি। এমনকি পুলিশ ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। কিন্তু আদালত তা মঞ্জুর করেনি। স্থানীয়রা বলছে, মূলত দুর্বল এজহারের কারনে অভিযুক্ত মিলি একদিনেই জামিন পেয়ে গেছে।
দুটি মামলাই তদন্ত করেছেন রূপগঞ্জ থানার এস আই নাজিম উদ্দিন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রূপগঞ্জ থানার এস আই নাজিম উদ্দিন জানান, মামলা দুুইটির তদন্ত অনেক দূর এগিয়েছে। আপতত বিস্ফোরক মামলা হয়েছে। ময়না তদন্তের রিপোর্ট আসার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। ময়নাতদন্তে হত্যা প্রমানিত হলে মামলায় ৩০২ ধারা যোগ করা হবে।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এত বড় ঘটনা। অথচ আসামী গ্রেফতার করে কোর্টে চালান দেয়ার পরের দিনই জামিনে বেরিয়ে এসেছে। আদালতে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করলেও তা মঞ্জুর করেনি আদালত।

নেক্সট এক্সোসরিস লিমিটেড ম্যানেজার (বিজনেস ডেভলপমেন্ট) মোহাম্মদ সাদিকুল্লাহ জানান জানান, ৪জন শ্রমিকের অশাল মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। কোম্পানীর নিয়ম অনুযায়ী নিহতদের ক্ষতিপূরণ ও ইন্সুরেন্স সুবিধা পাবে। এছাড়া আগামী ঈদে মালিক ও শ্রমিকদের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবার আর্থিক সহয়তা পাবে।

আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে রাজধানীর নিকটেই ফতুল্লার গিরিধারা আবাসিক এলাকায় ৬ এপ্রিল রাত আনুমানিক ৮টা। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মারা যায় আব্দুর রহিমের স্ত্রী দুই পুত্র কন্যা সন্তানসহ ৪ জন। গ্যাসের আগুন কেড়ে নিলো আব্দুর রহিম পুরো পরিবার।

গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরনের বর্ণনা দিতে গিয়ে ঐ ফ্লাটের ম্যানেজার বেলাল হোসেন জানান, ঐ দিন রাত ৮টার দিকে হঠাৎ বিকট শব্দ। কিছু বুঝে উঠার আগেই মেয়ে মানুষের আর্তনাদ। তাকিয়ে দেখি শিশু দুই বাচ্চাকে নিয়ে সিড়ি বেড়ে নিচে নামছেন অগ্নিদ্বগ্ধ ফাতেমা। তার শরীরে তখন আগুন। শরীর থেকে মাংস খসে পড়ছে। দুই শিশুর করুন আত্মনাদ। মানুষ ছুটে এসে তাদের নিয়ে রওনা দেয় মেডিক্যালে দিকে। সিড়ি বেড়ে চার তলায় গিয়ে দেখি শরীরের বেশীর ভাগ ঝলসানো রাফি (১১) পড়ে আছে ডাইনিং টেবিলের কাছে। তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য মেডিক্যালের দিকে রওনা হই। এ ঘটনায় অগ্নিদ্বগ্ধ মা ছেলে মেয়েসহ চারজনই মারা গেছেন।

মো: বেলাল হোসেন জানান, সে কি বিভীষিকাময় মুহূর্ত। বলে শেষে করা যাবে না। অগ্নিদ্বগ্ধ মানুষের করুন আর্তনাদ আমাদের নাড়িয়ে দিয়ে গেলো। চোখের সামনে এত্তগুলো মানুষের করুন মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারিছনা।

জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার গিরিধারা আবাসিক এলাকার সদ্য নির্মিত বিসমিল্লাহ টুইনটাওয়ারের ছয়তলা ভবনের চারতলা ফ্ল্যাটটি ক্রয় করেন বেকারী ও মুদিমাল ব্যবসায়ি আব্দুর রহিম। টাকা জমিয়ে সমিতির মাধ্যমে কয়েকজন মিলে জমি কিনেন আব্দুর রহিম। ঐ জমিতে ফ্ল্যাট নিমানের কাজ এখনো চলছে। মাত্র কয়েক মাস আগে আব্দুর রহিমসহ আরো ৬ জন তাদের তৈরি করা ফ্ল্যাটে পরিবার পরিজন নিয়ে উঠেন। স্ত্রী ফাতেমা এবং দুই পুত্র এক কন্যা সন্তান নিয়ে ঐ ভবনের ৪র্থ তলার নিজ ফ্ল্যাটে উঠেন ব্যবসায়ি আব্দুর রহিম।

গত ৬ এপ্রিল রাত ৮দিকে হঠাৎ গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে পুরো ঘরে আগুন ধরে যায়। অগ্নিদ্বগ্ধ হন আব্দুর রহিমের স্ত্রী ফাতেমা (৩৫) তাঁর তিন সন্তান সাফওয়ান (৫), ফারিয়া (৯) ও রাফি (১১) গুরুতর আহত হন। তাদের শরীরের ৯৫ ভাগ পুড়ে যায় বলে জানান (ঢামেক) হাসপাতাল বার্ন ইউনিটের ডাক্তারা। সবশেষ ১২ এপ্রিল রাতে মারা যায় আব্দুর রহিমের কন্যা অগ্নিদ্বগ্ধ ফারিয়া (৯) সে গিরিধারা ডি-লাইট স্কুলের ৪র্থ শ্রেণির ছাত্রী ছিল। এর আগে ১০ এপ্রিল মারা গেছে পুত্র রাফি (১১) সে ঐ স্কুলের ৫ম শ্রেণীর ছাত্র ছিল। গত ৭ এপ্রিল রোববার রাতে অগি¦দগ্ধ সাফওয়ান (৫) ও তার পরের দিন ৮ এপ্রিল আব্দুর রহিমের স্ত্রী অগ্নিদ্বগ্ধ ফতেমা আক্তার মারা যান। এক সাথে স্ত্রী পুত্র কন্যা সন্তানসহ ৪জনকে অকালে হারিয়ে পাগল প্রায় ব্যবসায়ি আব্দুর রহিম।

ফাতেমার স্বামী আবদুর রহিম জানান, গ্যাসের আগুন কেড়ে নিলো আমার পুরো পরিবার। একটি ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন। পাশাপাশি ব্যবসা করেন বলে জানান তিনি। ঘটনার সময় তিনি বাসায় ছিলেন না।

http://www.dailysangram.com/post/375233