১২ মে ২০১৯, রবিবার, ১০:২২

আল-কুরআনের দৃষ্টিতে ইসলামী আন্দোলন

মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন : ॥৩॥
‘নিজের দোষত্রুটি স্বীকার ও অন্যের গুণাবলীর কদর করবে। অন্যের দুর্বলতার প্রতি নজর না দেয়ার মতো বিরাট হৃদয়পটের অধিকারী হবে। অন্যের দোষত্রুটি ও বাড়াবাড়ি মাফ করে দেবে। নিজের জন্য কারো উপর প্রতিশোধ নেবে না। অন্যের সেবা গ্রহণ করে নয় অন্যকে সেবা দিয়ে আনন্দিত হবে। নিজের স্বার্থে নয় অন্যের ভালোর জন্য কাজ করবে। কোন প্রকার প্রশংসার অপেক্ষা কিংবা নিন্দাবাদের তোয়াক্কা না করে নিজের দায়িত্ব পালন করে যাবে। খোদা ছাড়া কারো পুরস্কারের প্রতি দৃষ্টি দেবে না।’

‘বল প্রয়োগ করে তাদের দমন করা যাবে না, ধন-সম্পদের বিনিময়ে ক্রয় করা যাবে না। কিন্তু সত্য ও ন্যায়ের সামনে নির্দিধায় ঝুঁকে পড়বে। তাদের শত্রুরাও তাদের ওপরে বিশ্বাস রাখবে যে, কোন অবস্থায়ই তারা ভদ্রতা ও ন্যায়নীতি বিরোধী কোন কাজ করবে না। এগুলো তলোয়ারের চাইতেও ধারালো এবং হীরা, মনি-মুক্তার চাইতে মূল্যবান। এ চারিত্রিক গুণাবলী মানুষের মন জয় করে নেয়। এ ধরনের গুণাবলী অর্জনকারীরা চারপাশের জনবসতির উপর বিজয় লাভ করে।”

এছাড়া মাওলানা মওদূদীর মতে এ বিজয়ের জন্য ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে নিম্নোক্ত মৌলিক মানবীয় গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে।

ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ শক্তি, প্রবল বাসনা, উচ্ছাসা ও নির্ভীক সাহস, সহিষ্ণুতা ও দৃঢ়তা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, সহনশীলতা ও পরিশ্রমপ্রিয়তা, উদ্দেশ্যের প্রতি প্রবল আকর্ষণ এবং সেজন্য সব কিছুরই উৎসর্গ করার প্রবণতা, সতর্কতা, দূরদৃষ্টি ও অন্তরদৃষ্টি, বোধশক্তি ও বিচার ক্ষমতা, পরিস্থিতি যাচাই করা ও তদানুযায়ী নিজেকে ঢেলে গঠন করা, অনুকূল কর্মনীতি গ্রহণ করার যোগ্যতা, নিজের হৃদয়াবেগ, ইচ্ছা-বাসনা, স্বপ্নসাধ ও উত্তেজনার সংযমশক্তি, অন্য মানুষকে আকৃষ্ট করা ও তাদেরকে কাজে লাগানোর বিচক্ষণতা কারো মধ্যে পুরোপুরি বর্তমান থাকলে তবে এ দুনিয়ায় তার জয় সুনিশ্চিত।

ইসলামী আন্দোলনের সফলতার জন্য আরেকটি মৌলিক বিষয় হচ্ছে- ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। এটা আল্লাহ তা’য়ালার আরেকটি বড় কৌশল। এ পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি সত্য, সঠিক পথ, সবল ও মজবুত ঈমানদারদেরকে মিথ্যা, বাতিল, কৃত্রিম, মেকি, মোনাফিক ও ভেজাল থেকে আলাদা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। যা সত্য পথের পথিক ঈমানদার মুজাহিদদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশাল উপহার। এর মাধ্যমে দুর্বলচিত্ত, ভিতু, কাপুরুষ ও কপট ব্যক্তিরা শতই বাঁচাই ও ছাঁটাই হয়ে যায়।

এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-
‘লোকেরা কি মনে করে রেখেছে, “আমরা ঈমান এনেছি” কেবলমাত্র একথাটুকু বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে, আর পরীক্ষা করা হবে না? অথচ আমি তাদের পূর্ববর্তীদের সবাইকে পরীক্ষা করে নিয়েছি। আল্লাহ অবশ্যই দেখবেনকে সত্যবাদী এবং কে মিথ্যুক।’ (সূরা আনকাবূত: ২-৩)

‘তোমরা কি মনে করেছো, এমনিতেই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করে যাবে? অথচ তোমাদের আগে যারা ঈমান এনেছিল তাদের ওপর যা কিছু নেমে এসেছিল এখনও তোমাদের ওপর সেসব নেমে আসেনি। তাদের ওপর নেমে এসেছিল কষ্ট-ক্লেশ ও বিপদ-মুসিবত, তাদেরকে প্রকম্পিত করা হয়েছিল। এমনকি সমকালীন রসূল এবং তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছিল তারা চিৎকার করে বলে উঠেছিল, অবশ্যিই আল্লাহর সাহায্য নিকটেই।’ (সূরা বাকারা: ২১৪)

‘আর নিশ্চয়ই আমরা ভীতি, অনাহার, প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতির মাধ্যমে এবং উপার্জন ও আমদানী হ্রাস করে তোমাদের পরীক্ষা করবো। এ অবস্থায় যারা সবর করে এবং যখনই কোন বিপদ আসে বলে, আমরা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর দিকে আমাদের ফিরে যেতে হবে। তাদেরকে সুসংবাদ দাও। তাদের রবের পক্ষ থেকে তাদের ওপর বিপুল অনুগ্রহ বর্ষিত হবে, তাঁর রহমত তাদেরকে ছায়াদান করবে এবং এই ধরণের লোকরাই হয় সত্যানুসারী।’ (সুরা বাকারা: ১৫৫-১৫৭)

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর প্রিয় হাবিব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উদ্দেশ্য করে বলেন-
৩৩) হে মুহাম্মাদ ! একথা অবশ্যি জানি, এরা যেসব কথা তৈরী করে, তা তোমাকে কষ্ট দেয় কিন্তু এরা তোমাকে মিথ্যা বলে না বরং এ জালেমরা আসলে আল্লাহর আয়াতকেই অস্বীকার করছে।
৩৪) তোমাদের পূর্বেও অনেক রসূলকে মিথ্যা বলা হয়েছে কিন্তু তাদের ওপর যে মিথ্যা আরোপ করা হয়েছে এবং যে কষ্ট দেয়া হয়েছে, তাতে তারা সবর করেছে। শেষ পর্যন্ত তদের কাছে আমার সাহায্য পৌঁছে গেছে। আল্লাহর কথাগুলো পরিবর্তন করার ক্ষমতা কারোর নেই এবং আগের রসূলদের সাথে যা কিছু ঘটে গেছে তার খবর তো তোমার কাছে পৌঁছে গেছে।
৩৫) তবুও যদি তাদের উপেক্ষা তোমার কাছে অসহনীয় হয়ে থাকে তাহলে তোমার মধ্যে কিছু শক্তি থাকলে তুমি ভূগর্ভে কোন সুড়ঙ্গ খুঁজে নাও অথবা আকাশে সিড়িঁ লাগাও এবং তাদের কাছে কোন নিদর্শন আনার চেষ্টা করো। আল্লাহ চাইলে এদের সবাইকে হেদায়াতের ওপর একত্র করতে পারতেন। কাজেই মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। (সূরা আনআম: ৩৩-৩৫)
সুতরাং যেখানে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘আমি অবশ্যই অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু বিষয়ে পরীক্ষা করবো।’ সেখানে ইসলামী আন্দোলনের এ পথে পরীক্ষা আসাটাই স্বাভাবিক। না আসাটা বরঞ্চ অস্বাভাবিক।

মহান আল্লাহ তা’য়ালা কর্তৃক নির্ধারিত এ পরীক্ষা পদ্ধতিকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে না পেরে কোন কোন ব্যক্তি প্রশ্ন উত্থাপনের চেষ্টা করেন যে, এতগুলো মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি না করে কি পারা যেতো না? কিংবা ইসলামী আন্দোলনের সাফল্যের জন্য এত কুরবানীর কি দরকার ছিলো? অথবা এগুলো সংগঠিত হতে পেরেছে কোন রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের কারনে।

এ ধরনের বক্তব্য শুধু তারাই দিতে পারে যাদের কাছে কুরআনী দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার না। কোন বিশেষ সালকে সামনে এনে যারা এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করেন তাদের যদি পাল্টা প্রশ্ন করা হয় ১৯৭০ সালে পল্টনে জামায়াতে ইসলামীর জনসভায় হামলা করে যে ২ জনকে শহীদ করা হলো, সে ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী? কারণ তখন তো ৭১ সাল ছিল না। তারও আগে জামায়াত ইসলামীর প্রথম দিকে লাহোর সম্মেলনে সরকারী গুন্ডাবাহিনী সশস্ত্র হামলা চালিয়ে একজনকে শহীদ করাসহ অসংখ্য আন্দোলনের কর্মীদেরকে আহত করেছিলো। সে ব্যাপারে কি বক্তব্য? তখন তো ৭১ আসেনি।

মিশর ও তুরস্কে ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীগণ তাদের স্ব স্ব দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে আমরা জানি। কিন্তু তাদের ওপরে জুলুম-নির্যাতনের কারন কী? এরকম মতলবী কথাবার্তা বলে মূলত ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের মাঝে সংশয় সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। যারা ইসলামী আন্দোলনের বিরোধীতা করে তারা মূলত আল্লাহরই বিরোধীতা করে। তাদের ব্যাপারে ফায়সালার ভার আল্লাহর হাতেই রয়েছে। প্রকৃত ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা এসব বিরোধীতা-নির্যাতন দেখে ঘাবড়ে যায় না। এদিক ওদিক ছুটাছুটি এবং পালিয়ে বেড়ায় না। বরং তারা নির্যাতনের সম্মুখীন হয়ে খাঁটি সোনায় পরিণত হয়। ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্বকে আরো বেশী ভালোবাসতে এমনকি নিজের জীবনের চাইতেও ভালোবাসতে শেখে। সব ধরনের নগদ পাওয়ার হাতছানি ভয়ভীতি ও লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে দীনকে বিজয়ী করার জন্য তারা আরো দৃঢ়তার সহিত নিরলসভাবে কাজ করে যায়।
আর যারা দুর্বলচেতা ও নেফাক্বের রোগে আক্রান্ত তারা এসব পরীক্ষাকে আল্লাহর আযাব মনে করে। এর থেকে নিরাপদ দূরে থাকার চেষ্টা করে। ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী নেতৃত্ব এমনকি ইসলামী আন্দোলনের শহীদ নেতৃবৃন্দের ব্যাপারেও কুৎসা রটনা করতে তারা লজ্জাবোধ করে না। তাদের পরিচয় সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন-
‘লোকদের মধ্যে এমন কেউ আছে যে বলে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি। কিন্তু যখন সে আল্লাহর ব্যাপারে নিগৃহীত হয়েছে তখন লোকদের চাপিয়ে দেয়া পরীক্ষাকে আল্লাহর আযাবের মতো মনে করে নিয়েছে। এখন যদি তোমার রবের পক্ষ থেকে বিজয় ও সাহায্য এসে যায়, তাহলে এ ব্যক্তিই বলবে, “আমরা তো তোমাদের সাথে ছিলাম”। বিশ্ববাসীদের মনের অবস্থা কি আল্লাহ ভালোভাবে জানেন না? আর আল্লাহতো অবশ্যই দেখবেন কারা ঈমান এনেছে এবং কারা মুনাফিক। (সূরা আনকাবূত: ১০-১১)
মুনাফিকদের পরিচয় সম্পর্কে পবিত্র আল-কুরআনের সূরা বাকারার কয়েকটি আয়াত উল্লেখযোগ্য-
৮) কিছু লোক এমনও আছে যারা বলে, আমরা আল্লাহর ওপর ও আখেরাতের দিনের ওপর ঈমান এনেছি, অথচ আসলে তারা মু’মিন নয়।
৯) তারা আল্লাহর সাথে ও যারা ঈমান এনেছে তাদের সাথে ধোঁকাবাজি করেছে। কিন্তু আসলে তারা নিজেদেরকেই প্রতারণা করছে, তবে তারা এ ব্যাপারে সচেতন নয়।
১০) তাদের হৃদয়ে আছে একটি রোগ, আল্লাহ সে রোগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন, আর যে মিথ্যা তারা বলে তার বিনিময়ে তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
১১) যখনই তাদের বলা হয়েছে, যমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করো না, তারা একথাই বলেছে, আমরা তো সংশোধনকারী।
১২) সাবধান! এরাই ফাসাদ সৃষ্টিকারী, তবে তারা এ ব্যাপারে সচেতন নয়।
১৩) আর যখন তাদের বলা হয়েছে, অন্য লোকেরা যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সেভাবে ঈমান আনো তখন তারা এ জবাবই দিয়েছে- আমরা কি ঈমান আনবো নির্বোধদের মতো? সাবধান!আসলে এরাই নির্বোধ, কিন্তু এরা জানে না।
১৪) যখন এরা মু’মিনদের সাথে মিলিত হয়, বলেঃ “আমরা ঈমান এনেছি,” আবার যখন নিরিবিলিতে নিজেদের শয়তানদের সাথে মিলিত হয় তখন বলেঃ “আমরা তো আসলে তোমাদের সাথেই আছি আর ওদের সাথে তো নিছক তামাশা করছি।” (সূরা বাকারা: ৮-১৪)

মুনাফিকের বৈশিষ্ট সম্বলিত উপরের আয়াতগুলো পাঠ করলেই প্রকৃত মুমিনের হৃদয় আঁতকে উঠার কথা। আজকে আমাদের প্রত্যেকের বিবেককে প্রশ্ন করতে হবে। আমরা তো সকলেই নিজেদেরকে মুমিন দাবি করে আসছি। কিন্তু আমরা কি আল্লাহর দেয়া ফরমান অনুযায়ী তাগুতকে বাস্তবে অস্বীকার করতে পেরেছি? আমরা কি ঈমানের পরিবর্তে কুফরীর পথকে যারা প্রাধান্য দেয় তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে পেরেছি? আমরা কি আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামের পথে জুলুম-নির্যাতনকে সহজভাবে মেনে নিতে পেরেছি? আমরা কি সব ধরনের ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি থেকে বিরত থাকতে পারছি?
যদি পেরে থাকি তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা সাচ্চা মুমিন। মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের ঈমানের শক্তিকে আরো বাড়িয়ে দিন, আমীন। কিন্তু কারো মাঝে যদি উপরোক্ত মুনাফিকী বৈশিষ্ট্যের বিন্দু বিসর্গ থেকে থাকে, আন্তরিকভাবে আতœপর্যালোচনা করে তা থেকে বেরিয়ে এসে খাঁটি মুমিন হওয়ার প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। কারণ মুনাফিকের শাস্তি সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, মুনাফিকের অবস্থান হবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে। মহান আল্লাহ তা’য়ালা লেখকসহ সকল মুমিন-মুমিনাকে আদনা নেফাক থেকে হেফাজত করুন এবং আমাদের সকলের জন্য জান্নাতের ফায়সালা করুন, আমীন।

ইসলামী আন্দোলনের সাফল্যের জন্য আরো দরকার- আন্তরিকতা, সবর ও ইস্তেকামাত। সবর ও সালাত সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-

হে ঈমানদারগণ! সবর ও নামাযের দ্বারা সাহায্য গ্রহণ করো, আল্লাহ সবরকারীদের সাথে আছেন। (সূরা বাকারা: ১৫৩)

http://www.dailysangram.com/post/375229