৪ মার্চ ২০১৭, শনিবার, ১২:২৯

আবারও ভারতের ডাম্পিংয়ের শিকার পেঁয়াজ চাষীরা!

বাংলাদেশে বিভিন্ন পণ্যের ডাম্পিং করছে ভারত। এবার ডাম্পিং এর শিকার দেশের পেঁয়াজ চাষীরা। প্রতি কেজি পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ ১৬ টাকা। আর ইন্ডিয়ান পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে ১২ টাকায়। এতে করে দেশীয় পেঁয়াজ ক্রয় না করে বাধ্য হয়ে ইন্ডিয়ান পেঁয়াজ ক্রয় করছে। পচনের হাত থেকে রক্ষা পেতে বাধ্য হয়ে ১১/১২ টাকা পেঁয়াজ বিক্রি করছে সাধারণ কৃষক। এতে করে প্রতি কেজি পেঁয়াজে কৃষকের লোকসান হচ্ছে ৫ টাকা। অবস্থার উন্নতি না হলে আগামীতে পেঁয়াজ চাষে আগ্রহ হারাবে কৃষকরা। ফলে শত ভাগ বাজার চলে যাবে ভারতের দখলে। তারপরেও ডাম্পিং-এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না সরকার।

প্রতিবেশি দেশ ভারত থেকে ব্যাপকহারে পেঁয়াজ আমদানির কারণে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন দেশের কৃষকরা। দেশীয় পেঁয়াজের ভরা মওসুমে ভারতীয় পেঁয়াজে বাজার সয়লাব হওয়ায় দামও নেমে এসেছে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। পাইকারি বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি দেশীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৯ থেকে ১০ টাকা দরে।

পচনশীল পণ্য হওয়ায়, গুদামজাতের সুযোগ না থাকায় কম দামেই পেঁয়াজ বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। কৃষকের দাবি প্রতি কেজি পেঁয়াজ উৎপাদনে ব্যয় হয় ১৫/১৬ টাকা। অথচ প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১০/১১ টাকায়। এতে করে প্রতি কেজি পেঁয়াজে লোকসান হচ্ছে ৫/৬ টাকা।

উল্লেখ্য, এসব কৃষক বিভিন্ন এনজিও থেকে মওসুমি ঋণ নিয়ে চাষ করে থাকেন। ফসল বিক্রি করে তারা সে ঋণ পরিশোধ করে থাকেন। চাষে লোকসান হওয়াতে ঋণের জালে আটকে পড়ছে প্রান্তিক এসব কৃষক। সরকার যদি ইন্ডিয়া থেকে ডাম্পিং বন্ধ না করে তাহলে পাবনা, নাটর, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া এবং ফরিদপুর এলাকার কৃষকরা ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

দেশে প্রতি বছর ১৮ থেকে ২০ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজের চাহিদা থাকলেও এ বাজার অনেকাংশে আমদানি নির্ভর। বিশেষ করে ভারত থেকেই আসে চাহিদার অন্তত ৮০ শতাংশ পেঁয়াজ। ফালগুন এবং চৈত্র মাসের পুরোটাই দেশীয় পেঁয়াজে বাজার সয়লাব থাকে। এরমধ্যে আবার পেঁয়াজ আমদানি করায় মার খেয়ে যাচ্ছে দেশীয় পেঁয়াজের বাজার। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন দেশের কৃষক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পেঁয়াজের দাম কম হওয়াতে লেবার মূল্য দিয়ে পেঁয়াজ ঘরে তুলতে নারাজ কৃষকরা। তারা বলছেন, এক বিঘা জমি থেকে পেঁয়াজ ঘরে তুলতে খরচ হয় প্রায় ৫ হাজার টাকা। কৃষানের মূল্য আর এনজিও ঋণ পরিশোধ করতে নতুন করে আরও ঋণ করতে হচ্ছে তাদের। অনেকে আবার পেঁয়াজ তুলে রাস্তার পাশে বস্তা করে ফেলে রেখেছেন।

এসময় পেঁয়াজ আমদানি করে কৃষকের ক্ষতি করে পুরো পেঁয়াজের বাজার ভারতের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। দেশীয় পেঁয়াজ বিক্রি শেষ হলে সারা বছর নিজেদের ইচ্ছামত মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি করবে এসব উন্ডিয়ান পেঁয়াজ। বাংলাদেশের এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী এ পেঁয়াজ আমদানি করে থাকেন। কিন্তু ডাম্পিং-এর অভিযোগ থাকলেও সরকার কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

এমনিতেই গত এক মাসের বেশি সময় ধরে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম তুলনামূলক কম ছিলো। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে এসে দাম আরো পড়তির দিকে। এ অবস্থায় বর্তমানে পাইকারি বাজারে আমদানি মূল্যের চেয়ে কেজি প্রতি এক থেকে দুই টাকা কমে পেঁয়াজ বিক্রি করতে হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরাও।

জানা গেছে, বাংলাদেশে বিভিন্ন পণ্যের ডাম্পিং করছে ভারত। অথচ ডাম্পিংয়ের দায়ে বেআইনিভাবে উল্টো বাংলাদেশের পাটজাত পণ্যের উপর শুল্কারোপ করছে দেশটি। ভারতের আমদানিকারকরা বলছে বাংলাদেশ থেকে পাটপণ্য রফতানিতে কোন ডাম্পিং হয় না। ডাম্পিং মামলায় বাংলাদেশ আইনি লড়াই না করার কারণেই এন্টি ডাম্পিং শুল্কারোপ করা সহজ হয়েছে। এতে করে আমাদের উদ্যোক্তারা নানাভাবে লোকসানের শিকার হচ্ছে।

শুধু তাই নয়, প্রতিনিয়তই আদাসহ ক্ষুদ্র অনেক পণ্যে ডাম্পিং করছে ভারত। এতে আমাদের কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ডাম্পিং-এর মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে ক্ষতি অব্যাহত থাকলেও বাংলাদেশ তার কোন প্রতিবাদ করতে পারেনি।

জানা গেছে, বাংলাদেশের রফতানি করা পাটপণ্যে এন্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে ভারত। এন্টি ডাম্পিং রোধ করতে বাংলাদেশ কয়েক দফায় কথা বললেও তাতে কোন সমাধান হয়নি। ডাম্পিং না করেও ডাম্পিংয়ের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে ব্যবসা হারাচ্ছে বাংলাদেশ। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ভারত নিজেদের বাজার সুরক্ষার অজুহাতে আন্তর্জাতিক নিয়ম লঙ্ঘন করে এ ধরনের এন্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করছে। অথচ পেঁয়াজসহ বেশ কয়েকটি পণ্যেই ডাম্পিং করছে উন্ডিয়া। এতে করে আমাদের কৃষকরা পণ্য উৎপাদনে উৎসাহ হারাচ্ছে। অথচ আমাদের সরকার ডাম্পিং-এর কোন অভিযোগই আনছে না ভারতের বিরুদ্ধে। এতে করে আমাদের কৃষকরা লোকসানের মুখে পড়ে পেঁয়াজ চাষ ছেড়ে দিয়েছেন। আর এ কারণেই এখন ৮০ ভাগ পেঁয়াজ উন্ডিয়া থেকে আমদানি হয়ে থাকে। বাকি ২০ ভাগ পণ্য উৎপাদন বন্ধ করতেও ডাম্পিং করছে ভারত। আর এ কাজে সহায়তা করছে দেশীয় কিছু আমদানিকারক।

নিয়মানুসারে, এ সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) এন্টি-ডাম্পিং এগ্রিমেন্ট (১৯৯৪) অনুসরণ করতে হয়। বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েই এই চুক্তির স্বাক্ষরকারী। ওই চুক্তি অনুযায়ী, ডাম্পিংয়ের অভিযোগ তদন্তের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে। সে অনুযায়ী, অভিযুক্ত দেশ সত্যিই কম দামে পণ্য পাঠাচ্ছে কি না, তা প্রমাণের পাশাপাশি আমদানিকারক দেশের স্থানীয় শিল্পের ওপর এর প্রভাব কী, তা স্পষ্ট হতে হয়। তদন্তাধীন সময়ে আমদানিকারক দেশের স্থানীয় শিল্পের ক্ষতির প্রমাণ পাওয়া গেলেও তদন্তের অপর একটি ধাপ বাকি থাকে। তা হলো, কম দামে রফতানির সঙ্গে স্থানীয় পণ্যের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি সরাসরি সংযোগ প্রমাণিত হতে হবে।

প্রকাশ্যে আমাদের কৃষকরা ক্ষতির অভিযোগ জানালেও সরকার ভারতের বিরুদ্ধে কোন ডাম্পিং-এর অভিযোগ আনছে না। এমনকি দেশের স্বার্থে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধও করছে না। এতে করে কৃষকরা পেঁয়াজ চাষ বন্ধ করে দিয়েছে। জানা গেছে, ১০ বছর আগেও পেঁয়াজ আমদানি করতে হতো মাত্র ২০ ভাগ। আর ডাম্পিং-এর কারণেই এখন ৮০ ভাগ পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে। অবস্থা পরিবর্তন না হলে আগামী পাঁচ বছরে পেঁয়াজ শতভাগ আমদানি নির্ভর হয়ে পড়বে।

http://www.dailysangram.com/post/274126