৩ মার্চ ২০১৭, শুক্রবার, ১১:৫১

মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার দুর্ভোগের শেষ নেই

দফায় দফায় সময় ও নির্মাণ ব্যয় বাড়ানোর পরও রাজধানীর মগবাজার- মৌচাক ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ শেষ হচ্ছে না। এতে করে নগরবাসীকে পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ। ধীরগতিতে কাজ চলার কারণে রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী, স্থানীয় এলাকাবাসী, এবং ফ্লাইওভারের আশপাশের ব্যবসায়ীরা অতিষ্ঠ।

রাজধানীর যানজট নিরসনে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার প্রকল্পটি ২০১১ সালের ৮ই মার্চ একনেকে অনুমোদন লাভ করে। চারলেন বিশিষ্ট ৮ দশমিক ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৭৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি এ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। চুক্তি অনুযায়ী দুই বছরের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্পের নকশা সংশোধন এবং নির্মাণ কাজের সময়সীমা ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। কাজ শেষ না হওয়ার কারণে আবার জুন ২০১৭ পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছিল। প্রথমে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১১ থেকে ডিসেম্বর ২০১৩ পর্যন্ত।

পরে প্রকল্পের মেয়াদ ডিসেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। প্রথম ধাপে প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ছিল ৩৪৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। দ্বিতীয় ধাপে তা ৭৭২ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। এখন প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ালো ১ হাজার ২১৮ দশমিক ৮৯ কোটি টাকা। মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের দুই অংশ খুলে দেয়া হয়েছে আগেই। রমনা থেকে তেজগাঁও সাতরাস্তা পর্যন্ত দুই কিলোমিটার অংশ ও ইস্কাটন থেকে ওয়্যারলেস (মৌচাক ক্রসিং) পর্যন্ত ফ্লাইওভার এক কিলোমিটার অংশে যানবাহন চলছে আগে থেকেই। সবমিলে প্রায় ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভারটির এখনো কাজ বাকি ছয় কিলোমিটারের।

সরজমিন রাজারবাগ, মালিবাগ মোড়, শান্তিনগর, মৌচাক, মালিবাগ রেলগেট, এফডিসি মোড় ঘুরে দেখা গেছে তুলনামূলক কম শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। একদিকে চলছে ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ অন্যদিকে চলছে সিটি করপোরেশনের ড্রেন নির্মাণের কাজ। ফলে রাস্তা দিয়ে মানুষ চলাচলের উপায় নেই। কোথাও চলছে ফ্লাইওভারের স্লোবের কাজ আবার কোথাও আই গ্রাডার, ভিম, ঢালাইয়ের কাজ। ফ্লাইওভারের নির্মাণ শ্রমিক মো. বকুল মিয়া জানান, যেভাবে কাজ চলছে আরো কয়েক মাস সময় লাগতে পারে।

এদিকে ফ্লাইওভারের নির্মাণ সামগ্রী সড়ক ও পার্শ্ববর্তী ফুটপাথে রাখার কারণে সরু হয়ে গেছে রাস্তা। রড, ভিম, ঢালাই বোর্ড, লোহার এঙ্গেল, খুঁটি রাখার কারণে রাস্তার একপাশ থেকে আরেক পাশে পথচারীরা চলাফেরা করতে পারে না। সরু রাস্তার কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে থাকে যানজট। খোঁড়াখুঁড়ির কারণে কিছু রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নির্মাণ কাজের জন্য রাস্তায় সৃষ্টি হয়েছে ছোট বড় অনেক গর্ত। গর্তগুলোতে সব সময় পানি জমে থাকে। নোংরা কাদা থাকার কারণে পায়ে হাঁটা পথচারীরা এমনকি রিকশা গাড়ি চলাচল করতে পারছে না। ঘটছে অহরহ দুর্ঘটনা।

স্থানীয়রা জানান, গর্তের মধ্যে পানি জমে থাকার কারণে গর্তের গভীরতা বোঝা যায় না। আবার কিছু কিছু জায়গায় এলোপাতাড়ি রড থাকার কারণে রিকশায় চলাচলকারী অনেক মানুষ উল্টে পড়ে হাত পা ভেঙেছে। রাস্তা পারাপারের সুযোগ না থাকার কারণে গাড়ি চাপায় অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মালিবাগ মোড়ের আলিপ ওয়াচ কালেকশনের মালিক, মো. সুলতান আলী জানান, মালিবাগ-মৌচাকের নাম শুনলে মানুষ এখন ভয় পায়। আমাদের ক্রেতারা এখন আর এদিকে আসে না। তাই আমাদের বিক্রি এখন অনেক কমে গেছে। অনেক কষ্ট করে চলতে হচ্ছে। ফরচুন মার্কেটের আসসামী কসমেটিকসের মো. রাজীব খান বলেন, মানুষের জন্য আতঙ্কের এক নাম হচ্ছে মালিবাগ-মৌচাক।

বিশেষ করে শিশুদের জন্য এই এলাকা এখন হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে এখন আর কেউ এই এলাকায় আসেন না। আর রিকশা গাড়ি ঠিকমতো চলে না। ধুলা-বালুর কারণে এই রাস্তা দিয়ে নিয়মিত চলাচলকারী অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আশপাশের সবকটি মার্কেট এখন ক্রেতা শূন্যতায় ভুগছে। তাই বিক্রি অনেক কমে গেছে। আমাদের এই মার্কেটেতো এখন দিনে এক দেড় হাজার টাকার বেশি বিক্রি হয় না। খুব কষ্ট করে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। মৌচাক মোড়ের ঢাকা বিরিয়ানির ম্যানেজার মারফত উল্লাহ কবির বলেন, জনগণের সুবিধার জন্য যে কাজ করা হচ্ছে সেই কাজ এখন অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলাচলের রাস্তার উপর ঢালাই করার কারণে কত মানুষ যে আহত হয়েছে তার ঠিক নাই। এসব ভয়ে এখন এই রাস্তা ভুলেই গেছে মানুষ। অন্য জায়গা থেকে তাদের সব ধরনের কেনা কাটা সেরে নেয়। ফুটপাথের এক ব্যবসায়ী সাদ্দাম হোসেন বলেন, এটাতো উন্নয়নের কাজ হচ্ছে না। এটা আমাদের পেটে লাথি দেয়ার কাজ চলছে।

গত কয়েক মাস ধরে ক্রেতা নেই। অনেক কষ্ট করে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে আছি। ব্যবসার পুঁজি ভেঙে ভেঙে এখন চলছি। এভাবে আর কিছুদিন চলতে থাকলে আর ঢাকায় থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে। বাড়ি চলে যেতে হবে। রিকশাচালক আবদুল লতিফ বলেন, মৌচাক শান্তিনগর মালিবাগ রেলগেটের রাস্তার অবস্থা এতো খারাপ আমরা অনেক কষ্ট করে চলাচল করি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের মধ্যে বসে থাকি। আগের তুলনায় অনেক কম আয় হয় এখন। অভাবের সংসার আমার আয়ের উপর চলে। কিন্তু এখন মালিককে জমা দিয়ে ২শ’ টাকার বেশি থাকে না। রাস্তায় বড় গর্ত থাকার কারণে দুদিন পরপর আমার রিকশা নষ্ট হয়। মেরামতের জন্য বাড়তি টাকা লাগে।

এ বিষয়ে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা গ্রুপের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (ফ্লাইওভার সংশ্লিষ্ট) হাতেম আলী বলেন, কাজ শেষ হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তবে আমরা অক্টোবরে শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছি। নির্মাণ কাজের জন্য বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। সিটি করপোরেশন ও ডিপিডিসির কাজ চলছে। যার কারণে সমস্যা একটু বেশি হচ্ছে। নির্মাণ সামগ্রী সড়কের মধ্যে ফেলে রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, এখন উপরের কাজ চলছে। উপরের কাজ শেষ হলেই নিচের নির্মাণ সামগ্রী আর থাকবে না। ধুলা-বালুর জন্য নিয়মিত পানি দেয়া হয় কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন নিয়মিত দেয়া হয়। কয়েকদিন পরপর দেয়া হয়।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=55781