পানিহীন গড়াই নদে প্রবাহ ফেরাতে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে চলছে খননকাজ। কিন্তু তেমন কাজ হয় না, তারই প্রমাণ শিশুদের এই ফুটবল খেলা। ছবিটি গত সোমবার কুমারখালীর লাহিনীপাড়া এলাকা থেকে তোলা
৩ মার্চ ২০১৭, শুক্রবার, ১১:৩৬

গড়াই নদ

কোটি কোটি টাকার খননেও পানির প্রবাহ নেই

গড়াই নদ এখন যেন বালুমহাল। কুষ্টিয়া ও আশপাশের দু-একটি জেলার বালুর চাহিদা পূরণ করছে এই নদ। নদে পানির প্রবাহ অব্যাহত রাখার জন্য সরকারি প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের খননকাজ শেষ হচ্ছে আগামী জুনে। নদের দুই পারের মানুষ বলছেন, কোটি কোটি টাকা গেল ড্রেজারের পেছনে। নদ দিয়ে পানি গড়াল না।

রাজ্জাক ব্যাপারীর বাড়ি গড়াইয়ের তীরে রেন উইক বাঁধের পাশে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ফি বছর নদী কেটে বালু রাখছে পাড়ে। সেই বালু বর্ষায় আবার নদীতে পড়ছে। বছরের পর বছর ধরে এটা চলছে। সরকার খালি খালি টাকা দিয়ে ড্রেজার চালাচ্ছে।’

এটা শুধু রাজ্জাক ব্যাপারীর একার কথা নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন হোটেলমালিক বলেন, খননে নদের কোনো লাভ হচ্ছে কি না, তা কেউ জানে না। নদের দুই পারের মানুষের লাভ হচ্ছে না। তবে প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের লাভ হচ্ছে।

‘গড়াই নদ দিয়ে পানির প্রবাহ সব সময় অব্যাহত রাখা সম্ভব হচ্ছে না।’ এমনই বললেন কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী জাহেদুল ইসলাম। তবে তিনি বলেন, ফোঁটা ফোঁটা করেও যদি পানি যেতে থাকে, তাহলে প্রকল্পের উদ্দেশ্য সফল বলে ধরে নিতে হবে।

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার তালবাড়িয়া নামের একটি জায়গায় গড়াই জন্ম নিয়েছে পদ্মা থেকে। উৎসমুখের নাম মহানগরট্যাগ। ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ গড়াই কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার শেষ সীমানায় গিয়ে মিশেছে মধুমতীতে।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সকালে তালবাড়িয়ায় গিয়ে দেখা যায়, দুপারের চর নদের প্রায় মাঝে চলে এসেছে। দুই পারের জেলেরা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলছেন। সেখানে চরে মাটি কাটছেন কয়েকজন শ্রমিক। তাঁরা বললেন, পদ্মা ছোট হয়ে গেছে। বালু পড়ে গড়াইমুখ উঁচু হয়ে গেছে। সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি হয়, কোনো কাজে আসে না। খোলা চোখে ক্ষীণ পদ্মায় স্রোত¯আছে কি না, বোঝা ভার।

মহানগরট্যাগে গড়াইয়ের উৎসমুখেই একটি নৌকা আটকে আছে। মাঝিরা বুকসমান পানিতে নেমে পাথরবোঝাই নৌকাটি ছাড়ানোর জোর চেষ্টা করছেন। বললেন, তালবাড়িয়ার পদ্মা নদী দিয়ে গড়াই হয়ে কুষ্টিয়ার হরিপুরে পাথর নিয়ে যাচ্ছেন। গড়াইয়ে পানি না থাকায় নৌকা নিয়ে যেতে তাঁদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

একই দিন দুপুরে কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী আঞ্চলিক মহাসড়কের মাস-উদ রুমি সেতুর ওপর উঠলে নদের অবস্থা বোঝা যায়। নদের মাঝে ছেলেদের ফুটবল খেলতে দেখা গেল। সেতুর দুপাশে দুটি ড্রেজার, তবে বন্ধ ছিল। নদের মাঝে সরু হয়ে বয়ে যাওয়া কিছু পানিতে জাল ফেলে মাছ ধরার বৃথা চেষ্টা করছেন দুজন জেলে। তাঁদের মতে, একসময় গড়াইয়ে প্রচুর মাছ ধরা পড়ত। পানি কমে যাওয়ায় এখন আর তেমন মাছ পাওয়া যায় না।

গ্রীষ্মকাল শুরুর আগেই গড়াই এখন ধু ধু বালুচর। নদের উৎসমুখ তালবাড়িয়া থেকে কুমারখালীর চাপড়া পর্যন্ত চর পড়ে পানির প্রবাহ তার স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে। মাঝেমধ্যে কিছু গর্তে আটকে আছে সামান্য পানি।

ঘট্টিয়াঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে মানুষ হেঁটেই নদ পারাপার হচ্ছে। নদে বালুচর। সামান্য কিছু অংশে বাঁশের সাঁকো আছে।

একসময় এই প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এমন দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল গড়াই নদের প্রবাহ অব্যাহত রেখে দক্ষিণাঞ্চলের, বিশেষ করে সুন্দরবন এলাকার লবণাক্ততা কমানো। পদ্মা নদী গড়াই হয়ে মধুমতী দিয়ে সুন্দরবনে মিঠা পানির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখে। প্রথম দিকে সেই উদ্দেশ্য কিছুটা সফল হলেও এখন আর হচ্ছে না। গড়াই খনন ভেস্তে যেতে বসেছে। শুষ্ক মৌসুমে ১০০ কিউসেক পানি যাওয়ার কথা। কত যাচ্ছে কেউ বলতে চান না।

প্রকল্পের এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা খননকৃত বালু ব্যবস্থাপনা। নদের পারে বালু ফেলার মতো খাসজমি নেই। প্রকল্পের লোকজন খনন করে পাড়েই রাখছেন বালু। সেই বালু ফের নদীতেই চলে আসছে। এখন সেই বালু এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যে যাঁর মতো বিক্রি করে টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন।

পাউবো সূত্র বলছে, ২০০৯-১০ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত আট বছরে প্রকল্পে খরচ হয়েছে ৬৫৪ কোটি টাকা। চলবে আগামী জুন পর্যন্ত। নদ গড়ে ৩০০ মিটার প্রস্থ। এখন ৩০ মিটার প্রস্থ করে খনন করার কথা। চারটি ড্রেজার দিয়ে খননকাজ চলছে। এখন মূলত রক্ষণাবেক্ষণ খনন (মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং) চলছে।

নদের তীরবর্তী মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, একদিকে খনন করে সামনের দিকে চলে যায় ড্রেজার, অন্যদিকে পেছন থেকে ভরাট হয়ে যায়। গড়ে ৩০ মিটার প্রস্থে খনন করার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। হরিপুর, ঘট্টিয়াঘাট ও কুমারখালী ঘুরে তেমন প্রমাণও পাওয়া গেছে। ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি ড্রেজারও চলতে দেখা যায়নি।

কুষ্টিয়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী জাহেদুল ইসলাম ৩০ কিলোমিটারের কয়েক জায়গায় বালু পড়ে নদের স্রোত আটকে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, প্রতিবছর খনন না করলে সমস্যা হবে। মাঝে মাঝে খননযন্ত্র নষ্ট থাকায় দু-তিন দিন কাজ বন্ধ থাকে।

পাউবো বলছে, একনেকে অনুমোদনের পর ২০০৯ সালে গড়াই খনন দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। প্রথম পর্যায়ে উৎসমুখ তালবাড়িয়া থেকে খোকসা পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার খনন করা হয়। এর আগে ১৯৯৬ সালে গড়াই খননকাজ শুরু হয়।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1096201