৩ মার্চ ২০১৭, শুক্রবার, ১১:৩০

বিমানের আন্তর্জাতিক ফ্লাইট সিডিউল লণ্ডভণ্ড

নেপথ্যে উড়োজাহাজ লিজ বাণিজ্য * ১০টি উড়োজাহাজের ৪টি বিকল * প্রতিটি ফ্লাইট ১৫ থেকে ১৮ ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ছে

লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়েছে বিমানের আন্তর্জাতিক রুটের সব ফ্লাইট সিডিউল। গত ৬ দিন ধরে লন্ডনসহ সব আন্তর্জাতিক স্টেশনের ফ্লাইট গড়ে ১৫ থেকে ১৮ ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ছে। একইভাবে আন্তর্জাতিক স্টেশন থেকেও দেরিতে ফ্লাইট দেশে ফিরছে। বুধবারের বেশিরভাগ ফ্লাইট ছেড়ে গেছে বৃহস্পতিবার। খোদ বিমান পরিচালনা পর্ষদ চেয়ারম্যানের আবুধাবিগামী ফ্লাইটটিও বৃহস্পতিবার ৫ ঘণ্টা বিলম্বে ঢাকা ছেড়েছে। এ অবস্থায় যাত্রী ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করেছে। ফ্লাইট বিলম্ব হওয়ায় বিমানের উত্তরার আবাসিক হোটেলগুলোর কোনো রুমই খালি নেই। খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে বিমানবন্দরের হোটেলগুলোতে। বৃহস্পতিবার একটি ফ্লাইটের সিডিউল চারবার পরিবর্তন করা হয়েছে। বিক্ষুব্ধ যাত্রীরা একপর্যায়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মিছিল করেছেন। তারা বিমানের বুকিং কাউন্টার ভাংচুর ও লিফলেট ছিঁড়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এর আগেও মঙ্গলবার একটি ফ্লাইট পাঁচবার পরিবর্তন করে পরে বাতিল করা হয়।

বিমানের ফ্লাইট অপারেশন শাখা বলছে, উড়োজাহাজ সংকটের কারণে গত ৬ দিন ধরে আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট সিডিউলের এই লণ্ডভণ্ড অবস্থা। ১০টি উড়োজাহাজের ৪টিই বিকল। ইঞ্জিনে পাখি ঢুকে দাম্মাম বিমানবন্দরে ৬ দিন ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে ৪১৯ আসনের ব্র্যান্ড নিউ এয়ারক্রাফট বোয়িং ৭৭৭-৩০০ইআর। মিসর থেকে ভাড়ায় আনা দুটি উড়োজাহাজের একটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ এয়ারক্রাফট গত এক মাস ধরে শাহজালালে বিকল হয়ে পড়ে আছে। অপরটিও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। মাসে ১৫ দিনের বেশি ওই উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করা যাচ্ছে না। একইভাবে নষ্ট হয়ে আছে একটি নতুন বোয়িং ৭৩৭ এয়ারক্রাফট। যার কারণে ফ্লাইট সিডিউল ঠিক রাখা যাচ্ছে না।

কিন্তু এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিমানের এই উড়োজাহাজ সংকটের পুরোটাই কৃত্রিম। এর নেপথ্যে কাজ করছে উড়োজাহাজ লিজ বাণিজ্য। এ কারণে পাখির আঘাত দেখিয়ে গত ৬ দিন ধরে একটি নতুন বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজ দাম্মামে ফেলে রাখা হয়েছে। সাতজন দক্ষ প্রকৌশলী দাম্মাম গিয়েও উড়োজাহাজটি মেরামত করতে পারেননি। তারা ইতিমধ্যে অপারগতা প্রকাশ করে জানিয়েছে, বোয়িংয়ের প্রকৌশলী ছাড়া উড়োজাহাজ মেরামত করা সম্ভব হবে না। যে পাখির আঘাতে ওই উড়োজাহাজ বিকল হয়েছিল, ওই পাখির ওজন নাকি ৩৪ কেজি। একইভাবে একটি বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজও ঠিক না করে ঢাকার হ্যাঙ্গারে ফেলে রাখা হয়েছে। দুই মাসের বেশি সময় একটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ হ্যাঙ্গারে ফেলে রাখা হয়েছে।

জানা গেছে, পরিচালনা পর্ষদের সর্বশেষ সভায় বিমানের জন্য একটি উড়োজাহাজ লিজ নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ওই উড়োজাহাজ লিজ নিলে বিমান ১২ কোটি টাকার বেশি লোকসানে পড়বে। সর্বনিন্ম দরদাতাকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় সর্বনিন্ম দরদাতার কাছ থেকে ওই উড়োজাহাজ লিজ নেয়ায় এ টাকা লোকসান হবে বলে এক পর্ষদ সদস্য অভিযোগ করেছেন। এ অবস্থায় যাতে লিজ বাণিজ্য বন্ধ না হয় সে জন্য এ সংকট তৈরি করা হতে পারে।

বিমানের কাস্টমার সার্ভিস শাখা সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার ঢাকা-সিলেট-রিয়াদের একটি ফ্লাইট বিজি-৬০৩ ছাড়ার কথা ছিল বেলা পৌনে ১১টায়। এ অবস্থায় সব যাত্রীর বোডিং সম্পন্ন হয়। কিন্তু উড়োজাহাজ না থাকার কারণ দেখিয়ে দুপুর দেড়টায় যাত্রীদের জানানো হয় ওই ফ্লাইটটি ছেড়ে যাবে বিকাল ৩টায়। এরপর ৩টায় ফ্লাইট দিতে না পেরে ওই ফ্লাইট রিসিডিউল করে বিকাল ৫টায় ছাড়বে বলে জানানো হয়। বিকাল ৫টায়ও ফ্লাইটটি ছাড়তে না পেরে আবার রিসিডিউল করে বলা হয়, ফ্লাইট যাবে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়। এ অবস্থায় বিকালে ওই ফ্লাইটের ক্ষুব্ধ যাত্রীরা শাহজালালে বিমানের কাউন্টার ভাংচুর ও মিছিল করে প্রতিবাদ জানান। একইভাবে বুধবার কুয়েতের একটি ফ্লাইট রিসিডিউল করে ছাড়া হয় বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটায়। বুধবারের দাম্মামগামী একটি ফ্লাইটও ১৮ ঘণ্টা দেরি করে বৃহস্পতিবার ঢাকা ত্যাগ করে। একইদিন বিজি ০৪৩ দাম্মামগামী একটি ফ্লাইট যাওয়ার কথা ছিল ভোর ৫টায়। পরে রিসিডিউল করে বলা হয় পৌনে ২টায় ছাড়বে। এরপর আবার রিসিডিউল করে বলা হয়, বিকাল ৪টায় ছাড়বে। একপর্যায়ে বিকালে বলা হয়, ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে।

এদিকে বিমানের পরিকল্পনা শাখার একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, একটি নতুন বোয়িং ৭৭৭ ও একটি বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ বিকলের ঘটনা পুরোটাই সাজানো। আট মাসের জন্য ২২০ থেকে ৩০০ আসনের একটি উড়োজাহাজ ভাড়া করার (ক্রু, রক্ষণাবেক্ষণ, বিমানসহ) জন্য এই কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে এ উড়োজাহাজটির জন্য দরপত্র বা ‘রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল’ আহ্বান করে বিমান কর্তৃপক্ষ। ২৮ ডিসেম্বর ছিল প্রস্তাব বা দর জমা দেয়ার শেষ তারিখ। এতে মোট ১৪টি প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব দেয়।

জানা গেছে, এসব প্রস্তাবের মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে বিমানের মূল্যায়ন কমিটি ডাকে এবং তাদের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চায়। এই পাঁচটির মধ্যে সর্বনিন্ম দরদাতা হল : মিসরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এয়ার লেইজার, যারা এমিরেটস এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ ভাড়া দিয়ে থাকে। এদের প্রতি উড্ডয়ন ঘণ্টা ভাড়ার প্রস্তাব করা হয় ৬ হাজার মার্কিন ডলার। পরে আলোচনার পর্যায়ে তারা ৫ হাজার ৪০০ ডলার ভাড়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু বিমানের মূল্যায়ন কমিটি প্রথম গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে চূড়ান্ত করে জর্ডানের জেএভি কমার্শিয়ালকে। এদের দরপ্রতি উড্ডয়ন ঘণ্টা ৬ হাজার ১৫০ ডলার। দ্বিতীয় গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছে এভিকো এশিয়া-প্যাসিফিককে। যাদের দর প্রথম তিন মাস প্রতি ঘণ্টা ৬ হাজার ৩৬৫ ও পরের পাঁচ মাস ৬ হাজার ৯৬৯ ডলার।

বিমানের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, এতে ফ্লাইট পরিচালনার আগেই ১২ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়বে বিমান।
এ ব্যাপারে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এএম মোসাদ্দিক আহমেদ বলেন, ফ্লাইট সিডিউল লণ্ডভণ্ডের সঙ্গে উড়োজাহাজ ভাড়ার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, জ্বালানি খরচ ও আসনপ্রতি খরচ হিসাব করে উড়োজাহাজ ভাড়া করার বিষয়ে মূল্যায়ন কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। তবে তিনি বলেন, ১২ কোটি টাকা ক্ষতির বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন। ফ্লাইট সিডিউল কতদিনের মধ্যে ঠিক হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিগগরি ঠিক হয়ে যাবে।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/03/03/105599