৩ মার্চ ২০১৭, শুক্রবার, ১০:১৭

ইসলাম ও জননিরাপত্তা

শাহ্ আব্দুল হান্নান

রাষ্ট্র ও সমাজের অস্তিত্বের মূল কারণই হচ্ছে, জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এক সময় রাষ্ট্র ছিল না। তখন বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করাই স্বাভাবিক ছিল। এ বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে বের হয়ে এসে সমাজে নিরাপত্তা বিধান করার জন্য রাষ্ট্র গঠন করা হয়।

ইসলাম রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা: মদিনাতে পৌঁছেই একটি সঙ্ঘবদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এ রাষ্ট্র গঠন ও প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল, অবশ্যই ইসলামি আইনকানুন ও আদর্শ কার্যকর করা। সেই সাথে এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

জননিরাপত্তা বিনষ্ট করাকে ইসলাম একটি বড় অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। ইসলামের পরিভাষায় ‘ফাসাদ ফিল আরদ’ (পৃথিবীতে বিপর্যয়) সৃষ্টি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং এ জন্য মৃত্যুদণ্ড হতে পারে (সূরা মায়িদা, আয়াত ৩২)।

জননিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য ইসলাম জীবন, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তাসহ সব ধরনের প্রয়োজনীয় মৌলিক অধিকার দিয়েছে। বিদায় হজের বাণীতে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, হে লোকসকল! তোমাদের পরস্পরের জান, মাল ও সম্মান পরস্পরের জন্য কিয়ামত পর্যন্ত এই নগরী, এই মাস, এই দিনের মতো হারাম সাব্যস্ত করা হলো (সকল হাদিসগ্রন্থ)।

জীবন, মাল ও সম্মানের ওপর হস্তক্ষেপের নিষেধাজ্ঞা জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মদিনার ইসলামি রাষ্ট্রের শুরুতে এবং মদিনার সনদে একই অধিকার দেয়া হয়েছিল। সে সনদের কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা হলো।

‘খোদাভীরু মুমিনগণ তাদের মধ্যকার বিদ্রোহী, ঘোরতর নির্যাতনকারী, অপরাধী, মুসলিম সমাজের স্বার্থের ক্ষতিকারী ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে এবং এ ধরনের অপরাধীদের বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে পদক্ষেপ নেবে। চাই সে তাদের কারো ছেলেই হোক বা অন্য কেউ হোক। মুসলিম রাষ্ট্রে অনুগত অমুসলিমদের অধিকার সমান। একজন সাধারণ অমুসলমানকেও মুসলমানরা পূর্ণ নিরাপত্তাসহ আশ্রয় দেবে। (সিরাতে ইবনে হিশাম, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত পৃ.১৪৭)।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ইসলাম অনেক সময় একের ‘অধিকারকে’ অন্যের ‘দায়িত্ব’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। যেমন সূরা নিসায় আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা একে অপরের মাল অবৈধভাবে ভোগ করো না।’ এখানে অবৈধ সম্পত্তি বা সম্পদ ভোগ না করার দায়িত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য মানুষের অধিকার আদায় সুনিশ্চিত করাই এর লক্ষ্য। প্রত্যেকে যদি তার দায়িত্ব পালন করে তাহলে অন্যের অধিকার রক্ষিত হয়।

জননিরাপত্তা শুধু আইন দ্বারা অর্জন করা সম্ভব হয় না। এ জন্য প্রয়োজন নাগরিকদের নৈতিকতাবোধে উদ্বুদ্ধ করা। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইসলাম কেবল শিক্ষাকে সবার জন্য ফরজ ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হয়নি, শিক্ষা যাতে সুশিক্ষা হয় তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। সাধ্যমতো কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব। ইসলামের প্রথম যুগে যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল তাতে কুরআন ও হাদিস শিক্ষার বিশেষ স্থান ছিল। কেননা কুরআন ও হাদিসের জ্ঞানই মানুষকে নৈতিকতাবোধে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। অবশ্য সব প্রয়োজনীয় জ্ঞানই মুসলানদের অর্জন করতে হবে।

জননিরাপত্তা রক্ষিত হতে পারে, যদি সঠিক বিচারব্যবস্থা কায়েম থাকে। এ জন্য ইসলাম ন্যায়বিচার কায়েম করার চেষ্টা করে। ইসলাম সব মানুষের মধ্যে ন্যায্যভাবে বিচার করার কথা বলেছে।

তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচার করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে। (সূরা নিসা, আয়াত ৫৮)। ইসলাম সবাইকে যথাযথ সাক্ষ্য দিতে বলেছে এবং সাক্ষ্য গোপন করতে নিষেধ করেছে (সূরা বাকারা, আয়াত ২৮২-২৮৩)।

প্রাথমিক যুুগে ইসলামের বিচারব্যবস্থা অত্যন্ত সহজ ছিল। বিচার পেতে কারো পয়সা খরচ করতে হতো না। বর্তমানেও ইসলামি রাষ্ট্রের লক্ষ্য হতে হবে, যেন বিনা খরচে অথবা সামান্য খরচেই বিচার পাওয়া যায় তার ব্যবস্থা করা।

ইসলাম নারীর নিরাপত্তাকে পুরুষের চেয়েও অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলাম নারীর প্রতি লালসার নজরে তাকানো নিষিদ্ধ করেছে। রাসূল সা: বলেছেন : যে ব্যক্তি অন্য নারীর সৌন্দর্যের দিকে লালসার নজরে তাকাবে, কিয়ামতের দিনে তার চোখে গলিত লোহা ঢেলে দেয়া হবে (তাফসিরে ফাতহুল কাদির)। ইসলাম প্রমাণ ছাড়া কোনো নারীকে অসতী বলাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করেছে।

যারা সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে এবং সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদেরকে ৮০টি কশাঘাত করো এবং আর কখনো তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না, তারা তো ফাসেক (সূরা নূর, আয়াত ৪)।

এসব কার্যকর করা আমাদের দায়িত্ব। এসবকে কার্যকর না করে ইসলামি সমাজের বর্তমান অবস্থার জন্য আমরা ইসলামকে দোষারোপ করতে পারি না।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/200308