২ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:১৩

দুর্ভোগের দায় শাজাহান খানের

শপথ লংঘন ছাড়াও আদালতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন নৌমন্ত্রী * পুরো ঘটনায় সরকার বিব্রত আ’লীগেও অস্বস্তি

আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সারা দেশে পরিবহন ধর্মঘট আহবান ও নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য বেশির ভাগ মানুষ দায়ী করেছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানকে। ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ ছাড়াও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বিশিষ্ট আইনজীবীরা যুগান্তরকে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেন, কোনোভাবেই শাজাহান খান চরম এ জনদুর্ভোগের দায় এড়াতে পারেন না। কেউ কেউ এও বলেন, মন্ত্রী হয়ে তিনি শপথ লংঘন করেছেন। নৈতিকভাবে তিনি এ পদে বহাল থাকার অধিকার হারিয়েছেন। সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ বুধবার রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়া স্মারকলিপিতে সংবিধানের অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে বলেছেন, নৌমন্ত্রীর উস্কানি আদালত অবমাননার শামিল এবং তিনি মন্ত্রীর শপথ ভঙ্গ করেছেন। এছাড়া মন্ত্রীর পাশাপাশি তিনি সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। এটি অবৈধ।

এদিকে তার এহেন কর্মকাণ্ডে সরকারি দলের মধ্যেও ক্ষোভ-অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ না করে বুধবার যুগান্তরকে বলেন, মন্ত্রী শাজাহান খান শুরুতেই বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি নিজের বিশাল ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে পানি ঘোলা করেছেন। এভাবে ধর্মঘট ডাকার ফলে সাধারণ মানুষ সরকারের প্রতি চরম ক্ষুব্ধ হয়েছে। পুরো ঘটনায় সরকার বিব্রত, আওয়ামী লীগেও অস্বস্তি।

জানা গেছে, পৃথক আদালতে দু’জন চালকের সাজার রায়ের বিরুদ্ধে পরিবহন ধর্মঘট আহ্বানের নেপথ্যে প্রধান ভূমিকা পালন করেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। ২৭ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে তার বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠক থেকে ধর্মঘটের কর্মসূচি দেয়া হয়। পরদিন মঙ্গলবার সারা দেশে একযোগে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আবার বুধবার তার ঘোষণার পরই সারা দেশে গাড়ি চলাচল শুরু হয়। এর আগমুহূর্ত পর্যন্ত সারা দেশের মানুষ পরিবহন শ্রমিকদের কাছে জিম্মি ছিল। গাড়ি চলাচল না করায় পথে-ঘাটে চরম ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। শত শত কোটি টাকার লোকসানের মুখে পড়েন ব্যবসায়ীরা। সাধারণ মানুষের মতে, এতে মন্ত্রীর পুরো ভূমিকা জাতির সামনে স্পষ্ট হয়েছে। তিনিই যে এই ধর্মঘট আহবানের নেপথ্যে ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, সড়ক অবরোধ করে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়ার লক্ষ্য হচ্ছে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। কিন্তু সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা মন্ত্রীর (শাজাহান খান) কাজ নয়। অথচ এক্ষেত্রে তার আচরণ ছিল বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতার মতো। এতে সংশয় হয় তিনি সরকারের পক্ষের লোক নাকি সরকারের বিপক্ষের লোক। তিনি আরও বলেন, আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল ডাকার অপসংস্কৃতি জামায়াত শুরু করেছিল। এখন মন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সংগঠন জামায়াতের ওই অপসংস্কৃতির অনুসরণ করছে। জামায়াতের হরতালে মানুষকে যতটা না দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে, সরকারের একজন মন্ত্রীর কারণে তার চেয়ে অনেক বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।

সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য ও সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ যুগান্তরকে বলেন, দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণ উপায় আছে। কিন্তু পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা দাবি আদায়ের নামে গত দুই দিন নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছেন। এজন্য মূলত মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বে থাকা দুই মন্ত্রী (শাজাহান খান ও মশিউর রহমান রাঙ্গা) দায়ী। তারা সরকারে থেকেও জনগণের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

বিশিষ্ট আইনজীবী মনজিল মোরসেদ যুগান্তরকে বলেন, রাষ্ট্রের মন্ত্রী (শাজাহান খান) হিসেবে তার দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের ভোগান্তি দূর করা। এক্ষেত্রে তিনি সাংঘর্ষিক ভূমিকা পালন করেছেন। অর্থাৎ সরকারের মন্ত্রী হিসেবে তিনি জনগণের ভোগান্তি দূর করার পক্ষে দায়িত্ব পালন না করে তিনি শ্রমিক সংগঠনে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পক্ষে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন জনগণের জন্য কাজ করার, জনগণের স্বার্থ রক্ষা করার এবং আইন সমুন্নত রাখার জন্য। কিন্তু তিনি তা করেননি। মনজিল মোরসেদ বলেন, আইন অনুযায়ী, দুর্ঘটনার জন্য সাজা হবে। অথচ তিনি ওই আইন ও রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তার এ ভূমিকা মন্ত্রী হিসেবে শপথ ও আইনের বিপরীতে অবস্থানের শামিল।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান যুগান্তরকে বলেন, আদালতের রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়ে শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন করেছে। তারা কর্মবিরতি পালন করলে আমার কী করণীয় আছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর নিহত হওয়ার ঘটনায় আদালতের রায়ের প্রতিবাদে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় শ্রমিকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহারের জন্য মালিক ও শ্রমিক নেতাদের নিয়ে ২৭ ফেব্রুয়ারি আমার বাসায় বৈঠক করি। ওই বৈঠক চলাকালে খবর আসে ঢাকার আদালতে সড়ক দুর্ঘটনায় একজন ট্রাক ড্রাইভারকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। ওই খবরের পরই শ্রমিক নেতারা উত্তেজিত হয়ে যান। সারা দেশ থেকে খবর আসতে থাকে শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন শুরু করেছে। ওই সময়ে আমার করণীয় কিছু ছিল না। আমি না থাকলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হতো। অপর এক প্রশ্নের জবাবে শাজাহান খান বলেন, আমাকে নিয়ে কে কী বলল, তাতে কিছু যায় আসে না।

শ্রমিক ফেডারেশনের সিনিয়র সহসভাপতি আবদুর রহিম বক্স দুদু যুগান্তরকে বলেন, ‘শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অসুস্থ রয়েছেন। তাই কার্যকরী সভাপতি মন্ত্রী শাজাহান খান এবং আমি মিলতাল করে সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।’

পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, শ্রমিক ফেডারেশন ও অধীনস্থ ইউনিয়নগুলোর বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে শাজাহান খানের সঙ্গে আলোচনা করে থাকেন। তার সিগন্যাল ছাড়া এত বড় কর্মসূচি পালন করতে পারে না শ্রমিকরা। একজন মন্ত্রী হিসেবে শাজাহান খানের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের ভোগান্তি থেকে রক্ষা করা এবং আইনের শাসন সমুন্নত রাখা। অথচ তার নেতৃত্বে থাকা শ্রমিক ফেডারেশন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ধর্মঘট পালন করেছে। জনগণকে চরম দুর্ভোগের দিকে ঠেলে দিয়েছে। যদিও এটিকে ধর্মঘট মানতে নারাজ শ্রমিক ফেডারেশন। সংগঠনের নেতাদের দাবি, রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়ে শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন করেছেন। আর এ কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ করা নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের ক্ষমতার বাইরে ছিল।

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, যারা সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন, জনগণের জানমাল রক্ষাসহ নির্বিঘœ যাতায়াতের শপথ নিয়েছেন তারাই যদি জনগণের যাতায়াতের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান, তাহলে শপথ ভঙ্গের প্রশ্ন উঠে আসে। তিনি বলেন, এ পরিবহন ধর্মঘটে পর্দার আড়াল থেকে শ্রমিক ফেডারেশনের শীর্ষ নেতারা যে খেলা খেলেছেন তা আজ সবার কাছে প্রকাশ্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এতে বোঝা যায়, সরকার যখন অনেক ভালো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে উদ্যোগ নেয় তখনই সরকারের ভেতরে থাকা লোকজন তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ান। সরকার যখন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়, তখন পরিবহন ধর্মঘটের এ কর্মসূচি নিশ্চয় আইনের পরিপন্থী কাজ। আসলে এ কর্মসূচির মাধ্যমে তারা প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইন দুর্বল করার বার্তা দিচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, আলোচিত এ পরিবহন ধর্মঘট ছাড়াও নৌমন্ত্রী শাজাহান খান পরিবহন সেক্টরে বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত। তিনি একই সঙ্গে নৌমন্ত্রী, শ্রমিক নেতা এবং বাসেরও মালিক। তার পরিবারের অধীনে ‘সার্বিক ও কনক পরিবহন’ নামে দুটি বাস সার্ভিস আছে। রয়েছে লঞ্চ ব্যবসাও। একই সঙ্গে মন্ত্রী, শ্রমিক নেতা ও বাস মালিক হওয়ার সুবাদে পরিবহন সেক্টরের অন্যতম নিয়ন্ত্রকও তিনি। এছাড়া গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ, সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া প্রণয়নসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে তার সরাসরি সম্পৃক্ততাও রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শ্রমিক ফেডারেশনের একাধিক নেতা জানান, সংগঠনের সভাপতি ওয়াজিউদ্দিন খান দীর্ঘদিন ধরেই গুরুতর অসুস্থ। তিনি বেশির ভাগ সময় পাবনায় অবস্থান করেন। সংগঠনের কর্মকাণ্ডে তেমন সম্পৃক্ত নন তিনি। এছাড়া সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বেশ কিছুদিন আগে ব্রেন স্ট্রোক করেছেন। তিনিও গুরুতর অসুস্থ। এছাড়া গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি পদে রয়েছেন তিনি। এর আগে সাংগঠনিক সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদে ছিলেন তিনি। এসব কারণে সংগঠনে তার রয়েছে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। সঙ্গত কারণে মন্ত্রী শাজাহান খানের সম্মতি ছাড়া শ্রমিক সংগঠনগুলোর কোনো প্রকার কর্মসূচি দেয়ার সুযোগ নেই।

প্রসঙ্গত, ঢাকার সাভারে ট্রাকচাপা দিয়ে এক নারীকে হত্যার দায়ে সোমবার ঢাকার এক আদালতে একজন চালকের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়ার প্রতিবাদে সোমবার সারাদিন এবং মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত সারা দেশে গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখে পরিবহন শ্রমিকরা। এর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনায় বাসচালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেয়ার প্রতিবাদে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিলেন তারা। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়ে দেশবাসী।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/03/02/105332