২ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:১০

আইএমইডির প্রতিবেদন

কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই সমাপ্ত ১২৫ প্রকল্প

আইএমইডির প্রতিবেদন জনগণের করের অর্থ অপচয়। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব এবং অপরিকল্পিতভাবে প্রকল্প নেয়ার খেসারত। দায়ীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি -মন্তব্য অর্থনীতিবিদদের

কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে সরকারের ১২৫টি প্রকল্প। এতে সময় ও অর্থ ব্যয় হলেও এসব প্রকল্পের কাক্সিক্ষত উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। পাশাপাশি প্রকল্পগুলোর সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

গত বছরের জুন মাসে শেষ হওয়া ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে এমন চিত্র তুলে ধরেছে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করা হয়। এ ছাড়া প্রতিবেদনে প্রকল্প বাস্তবায়নের বেশ কিছু সমস্যাও তুলে ধরা হয়েছে। বিষয়টিকে আর্থিক শৃংখলার পরিপন্থী হিসেবে মনে করছেন পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ নানা অজুহাতে বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখার পরও শতভাগ বাস্তবায়ন হয় না। এমন সব প্রকল্প অনেক আগেই বন্ধ করে দেয়া উচিত। অন্যথায় আর্থিক অপচয় ঘটবেই। আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ, লজিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক না মানা, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) বা কারিগরি প্রকল্প প্রস্তাব (টিপিপি) বা ক্রয় পরিকল্পনা অনুসরণ না করা, পর্যাপ্ত মনিটরিংয়ের অভাব এবং প্রকল্প পরিচালকদের অজ্ঞতা বা অদক্ষতার কারণেই মূলত এসব প্রকল্পের কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, এটা অবশ্যই জনগণের কর দেয়া অর্থের অপচয়। এটি অপরিকল্পিতভাবে প্রকল্প গ্রহণ করার খেসারত। এমনকি দেখা যাবে, এসব প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যও ছিল না। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে লগ ফ্রেম (যুক্তি কাঠামো) অনুসরণ করাও হয়নি। শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, যে উদ্দেশ্যে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, তা পূরণ হয় না। এজন্য এখন থেকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রার ভিত্তিতে ‘কস্ট বেনিফিট’ অর্থাৎ ব্যয়-আয় এবং এর প্রভাবসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয় হিসাব করেই প্রকল্প হাতে নিতে হবে।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট প্রকল্প সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৫৫৭টি। এর মধ্যে ২৮১টি প্রকল্প (মোট প্রকল্পের ১৮ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ) ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার কথা। কিন্তু তা হয়নি। সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে ২০৩টি প্রকল্প। বাকি ৭৮টি প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা না করে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া লক্ষ্যমাত্রার বাইরে ৫৫টি প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ওই অর্থবছরে সমাপ্ত ঘোষণা করা হয় ২৫৮টি প্রকল্প। কিন্তু এসব প্রকল্পের মধ্যে শতভাগ কাজ শেষ হয়েছে এমন প্রকল্পের সংখ্যা ১৩৩টি। বাকি ১২৫টির বেশ কিছু কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমপ্রেহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম (দ্বিতীয় ফেজ) শীর্ষক প্রকল্পটি শুরু হয় ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে। মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫৮৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা আর বৈদেশিক ঋণ সহায়তা ছিল ৫৮১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। প্রকল্প গ্রহণের সাড়ে ছয় বছরে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৪৮১ কোটি ৯৭ লাখ ২৩ হাজার টাকা। প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৮১ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৮২ শতাংশ। তারপরও প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া একই অবস্থা কনস্ট্রাকশন অব শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতু (তৃতীয় ব্রিজ), তিস্তা অ্যান্ড সেকেন্ড শীতলক্ষ্যা ব্রিজ উইথ দ্য এসিসট্যান্স অব কুয়েত ফান্ড শীর্ষক প্রকল্পে। ২০০৩ সালে এ প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। কিন্তু নানা কারণে বাস্তবায়নে কাক্সিক্ষত গতি না আসায় অবশেষে গত বছরের জুন মাসে সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩১২ কোটি ৫১ লাখ টাকা। কিন্তু ব্যয় হয়েছে ১৮ কোটি ৭ লাখ টাকা। বাস্তব ও আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, শতভাগ কাজ না করে প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করা আর্থিক খাতে বড় ধরনের বিশৃংখলা। এ ধরনের প্রকল্পে শতভাগ সুফল পাওয়া যায় না। আর অর্ধেকের কম কাজ হয়েছে এমন প্রকল্পে ব্যয় হওয়া অর্থ অপচয় ছাড়া কিছুই নয়। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরনের প্রকল্প প্রণয়নকারী মন্ত্রণালয় ও বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহিতা ও শাস্তির আওতায় আনা হলে বিশৃংখলার অবসান হবে বলেও মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি আরও বলেন, সরকারের স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতি নিশ্চিত করে লাভ-লোকসানের হিসাব কষেই প্রকল্প প্রণয়নের নিয়ম রয়েছে। প্রকৃত প্রয়োজন বিবেচনা করে প্রকল্প নেয়া হলে তা কখনই বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকার কথা নয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে নজরদারি বাড়ানোর সুপারিশ করেন তিনি।

কাজ অসমাপ্ত রেখেই সমাপ্ত ঘোষণা করা প্রকল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, কনস্ট্রাকশন অব সায়েদাবাদ-এনায়েতপুর বাইলেন সড়ক প্রকল্প, ইন্টিগ্রেটেড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট অব পোল্ডার ৩৪/২ অব বাগেরহাট ডিস্ট্রিক্ট, ডেভেলপমেন্ট অব সাউথ দাস রোড ইনক্লুডিং রামশিল বাজার লিংক, কনস্ট্রাকশন অব ফোর ব্রিজ অ্যাট বকশীগঞ্জ-বালুগঞ্জ-দেওয়ানগঞ্জ রোড, ডেভেলপমেন্ট অব কোটালীপাড়া-রাজৈর রোড, বাংলাদেশ সেন্ট্রাল জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন প্রজেক্ট, কনস্ট্রাকশন অব সুইচিং স্টেশন ফর রুরাল ইলেক্ট্রিফিকেশন প্রোগ্রাম, রুরাল ইলেক্ট্রিফিকেশন এক্সটেনশন বরিশাল ডিভিশনাল প্রোগ্রাম-১ এবং রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড অগমেন্টেশন অব ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক অব ডিপিডিসি প্রজেক্ট।