২ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৭:৩৮

আর কত চাপ সইবে মানুষ?

বহুলশ্রুত একটি বাক্য ‘মানুষ সৃষ্টির সেরা’। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, সৃষ্টির সেরা মানুষের এই পৃথিবীটা এখন কেমন? মানুষের জীবনযাপন, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র পরিচালনা এবং মানুষে মানুষে সম্পর্ক, রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক কতটা সঙ্গত ও মানবিক? মানুষ কি এখন নিজেকে এবং নিজের সভ্যতাকে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচনা করতে পারে? আমরা জানি, মানবিক ও উন্নত জীবনযাপনের জন্য মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছে, বৃহত্তর প্রয়োজনে গঠন করেছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র তো একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকে সরকার। সরকার রাষ্ট্রের সব নাগরিকদের প্রতি সমআচরণ করবে, ন্যায় ও সুশাসনের মাধ্যমে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে- এটাই তো স্বাভাবিক এবং সঙ্গত। কিন্তু বর্তমান সভ্যতায় এমন সঙ্গত আচরণ কতটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে? সরকার গঠনের আগে তো রাজনৈতিক দলের নেতারা বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পরে? নির্বাচিত হওয়ার পরে মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রেসিডেন্ট সমগ্র দেশের তথ্য সমগ্র দেশের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। কিন্তু সংবিধানসম্মত এমন প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব ও নৈতিকতা বর্তমান বিশ্বে কতটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে? অনেক ক্ষেত্রে তো দলীয় নেতাদের চাইতেও উগ্র ভাষায় কথা বলে ফেলেন দেশের মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীরা। অনেক সময় ভিন্ন দলের নেতা-নেত্রীদের তারা দেশবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করতেও কুণ্ঠিত হন না। ফলে উপলব্ধি করা যায়, বর্তমান বিশ্বের রাজনীতি এবং রাজনীতিকরা ‘শ্রেষ্ঠ’ অভিধায় অভিহিত হতে পারছেন না।

নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ভারতের সরকার যেভাবে সবাইকে ‘দেশবিরোধী’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে তাতে বোঝা যায় তারা কতটা উদ্ধত। জনগণের কথা শোনা গণতন্ত্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সরকার তা শুনছে না। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি নিজের বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এনডি টিভির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন অমর্ত্য সেন। সাক্ষাৎকারে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটা সাম্প্রতিক সহিংসতার নিন্দা জানান অমর্ত্য সেন। তিনি ক্ষমতাসীন বিজেপির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, দেশবিরোধী শব্দটি অদ্ভুত। একটি সংখ্যালঘু সরকার এটি ব্যবহার করছে। ৩১ শতাংশ ভোট পাওয়ার মানে এই নয় যে আপনি বাকি ৫৯ শতাংশকে দেশবিরোধী বলতে পারবেন। উল্লেখ্য যে, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিজেপি ৩১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।

বর্তমান সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানরা যে ভাষায় কথা বলেন তা বেশ শ্রুতিকটূ মনে হয়। তদের দায়িত্ব ও পদমর্যাদার সাথে বক্তব্যগুলো খাপ খায় না। সহনশীলতা, উদারতা, নৈতিকতা ও সৌন্দর্যবোধ কি দেশের ও বিশ্বের রাজনীতি থেকে উধাও হয়ে গেছে? তাইতো রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের মনে অনীহার মাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। চাইলেও তারা রাজনীতিবিদদের যেন আর শ্রদ্ধা করতে পারছেন না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাজনীতিতো মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজনীতি থেকে বিযুক্ত হলে আমাদের সমাজ-সংসার এবং রাষ্ট্র সঠিক পথে চলবে কেমন করে? তাই বিষয়টি নিয়ে সব দেশের সব সমাজের প্রাগ্রসর নাগরিকসহ সাধারণ জনগণকেও ভাবতে হবে। দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প তো এখন ভয়ংকর আচরণ করছেন। ভিন্ন মতের লোকদের তিনি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছেন। খ্যাতিমান সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমকে তিনি ‘অসৎ’ ও ‘গণশত্রু’ বলে আখ্যায়িত করছেন।

ট্রাম্প প্রশাসনের লোকজন হোয়াইট হাউসের প্রেস ব্রিফিং-এ সাংবাদিকদের ঢুকতে বাধা দিচ্ছেন। নজিরবিহীন এমন আচরণে যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক সমাজ আহত হয়েছেন ও জনগণ হয়েছেন বিস্মিত। কিন্তু তাতে কি, ট্রাম্পের মধ্যে সমঝোতার উপলব্ধি নেই, উদ্ধত আচরণেই যেন তিনি আনন্দ পান। তাইতো তিনি জানিয়ে দিলেন, হোয়াইট হাউসের খবর পরিবেশনকারী সাংবাদিকদের সংগঠন হোয়াইট হাউস করেসপনডেন্টস এসোসিয়েশনের (ডব্লিউএইচসিএ) এ বছরের নৈশভোজে তিনি যোগ দেবেন না। কোনো দেশের প্রেসিডেন্টের এমন মনোভাব দুঃখজনক। কিন্তু কোনো সচেতন সমাজ তো দুঃখবোধে ভারাক্রান্ত হয়ে স্থবির হয়ে থাকতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিকরা যেমন তাদের স্বাভাবিক কর্মপ্রবাহে যুক্ত থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন, তেমনি রাজনীতিবিদরাও নিজেদের সংগঠিত করে যার যার অবস্থান থেকে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আসলে পৃথিবীর যে কোনো দেশে, যে কোনো সমাজে স্বাভাবিক ও ন্যায়সঙ্গত কর্মকাণ্ডই তো মানুষের কাম্য। কারণ স্বাভাবিক ও ন্যায়সঙ্গত কর্মকাণ্ডই শান্তি ও প্রগতির নিয়ামক। এর বিপরীত হলে সমাজ মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। তখন চারদিকে লক্ষ্য করা যায় অশান্তি ও অস্থিরতার অশনিসংকেত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এ কথা সমান সত্যি।

সামাজিক অস্থিরতা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকান্তরে। ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয় : মাত্র পৌনে এক ভরি স্বর্ণের জন্য হত্যা করা হলো ৫ ও ৬ বছর বয়সী দু’টি শিশুকে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই নরসিংদীতে ৬, ৮ ও ১০ বছর বয়সী ৩ ভাইবোনকে হত্যা করলো আপন ভাই। অশান্তির জ্বালা মেটাতে অবুঝ শিশুকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিচ্ছেন মা। একের পর এক নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটেই চলেছে সমাজে। তাই প্রশ্ন জাগে, এ জন্যই কি সমাজবদ্ধ হয়েছিল মানুষ? অথচ ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা। মানুষ তো উন্নত ও মানবিক জীবনযাপনের জন্য সমাজবদ্ধ হয়েছিল। তাহলে সমাজ এই পর্যায়ে এসে পৌঁছলো কীভাবে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমরা প্রতিনিয়ত যেসব পৈশাচিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছি তা আসলে সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। অনেক ক্ষেত্রেই নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ও অসাম্য বিস্তার লাভ করেছে ভয়াবহ আকারে। দীর্ঘকাল ধরে আমাদের চেষ্টা-প্রচেষ্টা ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির মধ্যেই নিবদ্ধ রয়েছে। বস্তুগত উন্নতির দিকে দ্রুত ধাবমান একটি শ্রেণী। গণমাধ্যমের বদৌলতে সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে তীব্র ভোগাকাক্সক্ষা। বাড়ছে বৈষম্য। নীতি-নৈতিকতা পদদলিত হচ্ছে পদে পদে। এর শিকার হচ্ছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, প্রচ- চাপের মধ্যে আছে সমাজের মানুষ। জীবন সংগ্রামের এই চাপ থেকে মুক্তির জন্য মানুষ অনেক সময় ভয়াবহ পথ বেছে নিচ্ছে।

সমাজে যখন ন্যায় থাকে না, ভারসাম্য থাকে না, সুশাসন থাকে না; তখন সমাজে শান্তিও থাকে না। এমন অবস্থায় সমাজে অস্থিরতার মাত্রা বাড়তে থাকে। অস্থির সমাজে জীবনযাপন করতে গিয়ে মানুষের শরীর ও মন সুষম থাকে না। বরং নানা চাপে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফলে ঘটে যায় নানা অঘটন। এমন অবস্থায় সমাজ ও রাষ্ট্রের করণীয় থাকে। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার দায় বেড়েই চলেছে। তাই ত্রুটিপূর্ণ রাজনীতি ও নৈতিক অবক্ষয়ের ধারা বন্ধে নেতা-নেত্রী, সমাজপতি ও সরকারের বিশেষ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। তারা কতটা এগিয়ে আসেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।

http://www.dailysangram.com/post/273983