২৯ ডিসেম্বর ২০১৬, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৬

‘এ আবার কিসের ভোট’

জাতীয় সংসদে এমপিদের ভোটে রাষ্ট্রপতি ও স্পিকার এবং উপজেলার জনপ্রতিনিধিদের ভোটে সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে নির্বাচন দেখার অভিজ্ঞতা থাকলেও এবারই প্রথম সারা দেশে পরোক্ষ ভোটে জেলা পরিষদ নির্বাচন দেখল বাংলাদেশের মানুষ। গতকাল ঢাকার একটি কেন্দ্রে সেই ভোট দেখার অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নির্বাচন কমিশন প্রতিবেদক মঈনুল হক চৌধুরী।
কুয়াশার মধ্যে সকাল পৌনে ৮টায় যখন আগারগাঁও তালতলা সরকারি কলোনি উচ্চবিদ্যালয় ও মহিলা কলেজ কেন্দ্রে পৌঁছালাম, প্রিজাইডিং কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তার ঘণ্টাখানেক আগেই কেন্দ্রে পৌঁছে ভোটের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছেন।
এমনিতে বাংলাদেশে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সব নির্বাচন হয় সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। জেলা ভোটে ভোটার কেবল ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। তাই সময়ও কম, ৯টা থেকে ২টা।
ইসির তালিকা বলছে, সব মিলিয়ে ৬১ জেলায় ভোটার আছেন ৬৩ হাজার ১৪৩ জন। আর ঢাকার এই কেন্দ্রে ভোট দেবেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৩২ জন জনপ্রতিনিধি।
নির্বাচনী কর্মকর্তারা ২৪ জন পুরুষ ও আটজন নারী ভোটারের জন্য আলাদা দু’টি ভোটকক্ষ গুছিয়ে ফেললেন সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে। কেন্দ্রের ভেতরে নির্বাচনী কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দেখা গেল। সদস্য পদের কয়েকজন প্রার্থী ও তাদের সমর্থককে দেখা গেল কেন্দ্রের বাইরে।
ভোটার স্লিপ দেয়ার জন্য কেন্দ্রের বাইরে ক্যাম্প করেছেন প্রার্থীদের কয়েকজন। সেখানে বসে আছেন জনাপাঁচেক কর্মী। প্রার্থীদের ছবিসংবলিত কার্ড গলায় ঝুলিয়ে আরো ২০-২৫ জনকে জটলা করতে দেখা গেল কেন্দ্রের ফটকে।
প্রার্থী আর সমর্থকদের চোখে-মুখে আগ্রহ দেখা গেলেও স্কুলের বাইরে অনেকেই ভোটের বিষয়টি জানেন না বোঝা গেল। ক্যাম্পের উল্টো দিকে কেন্দ্রের বাইরে টঙ খুলে বসা এক চা দোকানি জানতে চাইলেন স্কুল কমিটির ভোট হচ্ছে কি না।
তালতলা কলোনি স্কুলের পথে প্রধান সড়ক ধরে কেন্দ্র পর্যন্ত ১০০ গজের মতো রাস্তায় প্রার্থীদের সাদা-কালো পোস্টার ঝুলতে দেখা গেলেও এ নির্বাচন নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের তেমন কোনো ধারণা নেই বলে মনে হলো।
পৌনে ৯টায় সড়কের পাশে কথা হলো স্থানীয় দোকানি আবুল হোসেনের সাথে। তিনি বললেন, ‘আপনারা ভোটে আইছেন? এইটা আবার কিসের ভোট! কলোনির ভোট নাকি?’
নির্বাচন নিয়ে জিজ্ঞেস করায় স্থানীয় এক যুবক প্রথমে তাকালেন মাথার ওপর পোস্টারের দিকে। তার পর বললেন, ‘এটা তো দেখি মেম্বার পদের ভোট। কোনো খবর নাই, তাই জানিও না।’
ঘড়িতে ৯টা বাজল। কিন্তু ভোট শুরু হলো কি না বোঝার উপায় নেই। ভোটারই তো নেই!
প্রিজাইডিং কর্মকর্তা মো: মঈনুল হোসেনকে জিজ্ঞেস করায় বললেন, ‘আমরা প্রস্তুত, তবে ভোটাররা কেউ আসেননি। প্রার্থীদের এজেন্টরা আছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রয়েছে; কোনো ঝামেলা নেই।’
ঝামেলার তেমন সুযোগও অবশ্য দেখা গেল না। ৩২ জন ভোটারের এ কেন্দ্রে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ, আনসার, ভিডিপি মিলিয়ে আইনের লোক ৫০ জনের কম নয়।
নিষেধ করার পরও প্রার্থীদের অনেকে মোবাইল ফোন সাথে নিয়ে কেন্দ্রে এসেছিলেন। কিন্তু ঢোকার সময় পুলিশ সবাইকে নিষেধাজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিলে ফোন কর্মীদের হাতে দিয়েই ভেতরে ঢোকেন তারা।
সকাল ৯টার পরপরই কেন্দ্রে এলেন নির্বাহী হাকিম তোফাজ্জেল হোসেন। ‘অননুমোদিত’ যারা জটলা করেছিলেন, তাদের বের করে দেয়া হলো।
সোয়া ৯টার পর কথা হলো সদস্য পদের প্রার্থী এস এম হানিফের সাথে। রসিকতার সুরে বললেন, ‘ভোটারের অপেক্ষায় রয়েছি। কাউন্সিলররা তো এত সকালে ঘুম থেকে ওঠেন না। তারা তো ভিআইপি; বেলা ১১টা-১২টার আগে আসবে বলে মনে হয় না।’
অবশ্য স্থানীয় কাউন্সিলর ফোরকান হোসেনকে এর পরপরই কেন্দ্রে দেখা গেল। উৎসুক প্রার্থীরা ছুটে গেলেন তার কাছে। ৯টা ২০ মিনিটে কেন্দ্রের ভেতরে গিয়ে প্রিজাইডিং অফিসার, নির্বাহী হাকিম ও পুলিশ সদস্যদের সাথে আলাপ করে এলেন, কিন্তু নিজের ভোট দিলেন না।
প্রথম ভোটার হিসেবে এসেও ভোট দিলেন না কেন জানতে চাইলে ফোরকান বললেন, ‘আমার এলাকার কেন্দ্র, তাই খোঁজ নিলাম। এখন তো ভোট দেবো না; শলাপরামর্শ এখনো করিনি। অন্যদের জন্য অপেক্ষা করব। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেবো, কাকে ভোট দেয়া যায়।’
প্রার্থী এস এম হানিফ তার মার্কাওয়ালা কার্ড পরিয়ে দিতে চাইলেন সিটি করপোরেশনের এই কাউন্সিলরকে। কিন্তু ফোরকান রাজি হলেন না। একজনের কার্ড গলায় পরলে অন্য প্রার্থীরা ‘মন খারাপ’ করবেন যে!
সকাল ১০টার পর আরেকজন কাউন্সিলর এসে কেন্দ্র দেখলেন; তার পর দুই ভোটার ভোট না দিয়েই কেন্দ্র ছাড়লেন।
ব্যস্ততা নেই; কেন্দ্রের মাঠে দেখা গেল গল্পে মেতেছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাত্যকি কবিরাজ ঝুলন, নির্বাহী হাকিম তোফাজ্জল হোসেন ও প্রিজাইডিং কর্মকর্তা মঈনুল হোসেন।
তাদের দিকে এগিয়ে যেতেই প্রিজাইডিং কর্মকর্তা বললেন, ‘আমরা ভোটারের অপেক্ষায় আছি’।
অন্য ভোটের সাথে এ নির্বাচনের পার্থক্যের বিষয়টি তুললেন নির্বাহী হাকিম তোফাজ্জল হোসেন। বললেন, ‘ভোটারের চেয়ে নিরাপত্তা সদস্যই এখানে বেশি। শীতের সকাল বলে ভোটারও কম। বেলা ১টার পর হয়তো সবাই আসবেন।’
সোয়া ১০টার দিকে হঠাৎ কেন্দ্র সরগরম। কী ঘটেছে? তিনজন নারী কাউন্সিলর এসেছেন ভোট দিতে।
প্রথম ভোটটি দিলেন সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আমিনা খাতুন। বললেন নতুন অভিজ্ঞতা হওয়ার কথা।
‘এত দিন ভোট নিছি, ভোট দিছিও। এত দিন নিজের জন্য করতাম। এবার কাউন্সিলর হয়ে অন্যরে দিলাম; ভালোই লাগল।’
প্রার্থীরা ভোটের জন্য চাপ দিচ্ছেন, এমপিরা প্রভাব খাটাচ্ছেন, ভোটের মাঠে টাকা উড়ছেÑ এ রকম অনেক অভিযোগ নির্বাচনের আগেই ইসির হাতে পৌঁছেছিল। তবে আমিনা খাতুন বললেন, এ রকম কোনো অভিজ্ঞতা তার হয়নি।
‘আমাকে কেউ কিছু বলেনি, কাকে দিতে হবে। আমি আমার সুবিধামতো দিলাম। পরিস্থিতি তো ভালো!’
আমিনার পর ভোট দিলেন সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর মেহেরুন্নেছা হক আর রাশিদা খানম ঝর্ণা। পাশেই পুরুষদের ভোট কক্ষ। সেখানে ভোট দিলেন ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবুল হোসেন।
কেন্দ্রের সামনে সদস্য পদের প্রার্থী নাসিমা আক্তার লাবুর ক্যাম্পে কথা হলো তার হয়ে ভোটের কাজে থাকা রুবেল নামের এক তরুণের সাথে। তিনি জানালেন, ভোট হচ্ছে শুনে এলাকার কয়েকজন এসেছিলেন জানতেÑ তারা ভোট দিতে পারবেন কি না।
‘পরিচিত কাউন্সিলর ভাইয়েরা আসলে আমরা এগিয়ে গিয়ে স্লিপ দিচ্ছি। কেউ নিচ্ছে, কেউ নিচ্ছে না। অন্য কেউ তো আর ভোট দিতে পারবে না।’
দুপুর ১২টার দিকে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা জানালেন, এ কেন্দ্রের আটজন নারী ভোটারের মধ্যে পাঁচজন এবং ২৪ জন পুরুষ ভোটারের মধ্যে ১৭ জন ভোট দিয়ে ফেলেছেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকীবউদ্দিন আহমদ ভোট দেখতে এলেন ১২টার পর। তিনি কেন্দ্রে ঢুকে নির্বাচন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বললেন, জানতে চাইলেন সব ঠিকঠাক চলছে কি না। তবে উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে কথা বললেন না।
সাংবাদিকদের আগ্রহ মেটানোর চেষ্টা করলেন নির্বাহী হাকিম তোফাজ্জাল হোসেন। বললেন, ‘সিইসি মহোদয় সুন্দর ভোট দেখে গেলেন। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।’
ভোটাররা একে একে এসে ভোট দিয়ে যেতে থাকলেন। ভোটের সময় শেষ হয়ে এলো দেখতে দেখতে।
বেলা ২টায় ভোট শেষে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা মঈনুল হোসেন জানালেন, ৩২ জন ভোটারের মধ্যে শেষ পর্যন্ত ২৮ জনের ভোট বাক্সে পড়েছে। অর্থাৎ এ কেন্দ্রে ভোটের হার ৮৭ শতাং
http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/182688