১ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১:৩৩

সিভিল এভিয়েশনের কোনো তদন্ত কমিটি হয়নি

পাখির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ঢাকা থেকে সিলেটগামী হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার ঘটনায় সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করেনি। হেলিকপ্টারটি মেঘনা গ্রুপের মেঘনা এভিয়েশনের একটি কপ্টার। তবে মেঘনা গ্রুপ তদন্ত কমিটি করেছে বলে জানা গেছে। এ নিয়ে মেঘনা গ্রুপের হেলিকপ্টার তৃতীয়বারের মতো দুর্ঘটনার মুখে পড়ল। তবে পাখির আঘাতে এই প্রথমবারের মতো কোনো হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে দেশে। এর আগে গত বছর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে বহনকারী একটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়। তার আগেও একই গ্রুপের একটি হেলিকপ্টার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে দুর্ঘটনার মুখে পড়লে তাতে বেশ কয়েকজন যাত্রী আহত হন। সোমবার সিলেট যাওয়ার পথে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে এ হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা ঘটে। বাধ্য হয়ে পাইলট হেলিকপ্টারটি জরুরি অবতরণ করান। প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, প্রচণ্ড আওয়াজে সুতাকাটা ঢাউস ঘুড়ির মতো হেলে-দুলে হেলিকপ্টারটি দক্ষিণ দিক থেকে গাছগাছালির ওপর দিয়ে উত্তরে যাচ্ছিল। একটু পর এটি সামনে গিয়ে আবার ঘুরে দক্ষিণে এসে সরিষা ক্ষেতে অবতরণ করে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, এ অবস্থা দেখে তারা বুঝতে পারেন নিশ্চয়ই কোনো বিপদ হয়েছে। দৌড়ে কাছে গেলে প্রথমেই বাঙালি পাইলট নেমে এসে বলেন, আমাদের বাঁচান, আমরা বিপদে পড়েছি, লোকজন সামলান। তারপর একে একে পাঁচ বিদেশী নাগরিকসহ আরও এক বাঙালি নেমে আসেন। বিদেশী নাগরিকদের একজনের গালে কাটা জখমসহ প্রায় সবার পরনের পোশাকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রক্তের দাগ দেখা যায়।

জানা গেছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপের ওই হেলিকপ্টারটি ঢাকা থেকে ডেনমার্কের দুজন, কোরিয়ার দুজন ও ইতালির একজন নাগরিকসহ সাতজনকে নিয়ে সিলেটে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রওনা হয়। পথিমধ্যে একটি বড় পাখির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে হেলিকপ্টারের সামনের গ্লাস ভেঙে আরোহীরা আহত হন। বাজিতপুর উপজেলার পিরিজপুর ইউনিয়নের গয়েশপুর গ্রামে এ দুর্ঘটনা ঘটে। গ্রামের প্রবীণ রবিউল আউয়াল বলেন, বেলা তখন সাড়ে ১১টা হবে। হঠাৎ প্রচণ্ড আওয়াজ ও বাতাস অনুভব করে ঘর থেকে বের হয়ে দেখি দক্ষিণ দিক থেকে কপ্টারটি গাছগাছালির সামান্য ওপর দিয়ে এদিক-ওদিক কাত হয়ে উত্তর দিকে যাচ্ছে। এ সময় গ্রামের কৌতূহলী শিশু-কিশোরসহ বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষও ঘর থেকে বের হয়ে আসে। কপ্টারটি কিছুদূর গিয়ে আবার ঘুরে খুব নিচ দিয়ে দক্ষিণে কয়েক শ’ গজ এসে সদ্য তোলা সরিষা ক্ষেতে অবতরণ করে।

বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ঢাকা থেকে আরও দুটি হেলিকপ্টার এসে দুর্ঘটনাকবলিত হেলিকপ্টার নিতে সহযোগিতা করে।

মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এ ঘটনায় সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করেনি। তবে হেলিকপ্টারটির মালিকানা প্রতিষ্ঠান মেঘনার নিজস্ব উদ্যোগে তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছে সিভিল এভিয়েশন সূত্র।

প্রশ্ন উঠেছে বারবার কেন মেঘনা গ্রুপের হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। সিভিল এভিয়েশন বলছে, এটি কাকতালীয়ও হতে পারে। আইকাও (ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন) রুলস অনুযায়ী বার্ড হিটকে এনভায়রনমেন্টাল ফ্যাক্টর হিসেবে গণ্য করা হয়। এখানে পাইলটদের তেমন কোনো কিছু করার থাকে না।

তবে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, পাখির সঙ্গে ধাক্কা লেগে বা আঘাত খেয়ে হেলিকপ্টারের দুর্ঘটনায় পড়ার বিষয়টি সাধারণত পাইলটের দক্ষতা-অদক্ষতার ওপরই নির্ভর করে। উড়োজাহাজে সাধারণত পাখির সঙ্গে আঘাত লেগে দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক এবং এটা বিশ্বব্যাপী হয়ে থাকে। এতে পাইলটদের তেমন কিছু করার থাকে না। কিন্তু হেলিকপ্টারের বিষয়টি ভিন্ন। এখানে পাখির সঙ্গে ধাক্কা খাওয়া না খাওয়া নির্ভর করে পাইলটের দক্ষতার ওপর।

তাছাড়া হেলিকপ্টারটি সত্যিকারভাবে পাখির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল কিনা, সেটাও তদন্ত করে দেখা দরকার। কারণ একটি বাজপাখির আঘাতে হেলিকপ্টারের সামনের কাচ ভেঙে যাওয়া রহস্যজনক। এতে হেলিকপ্টারের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।

এ সম্পর্কে সিভিল এভিয়েশনের সাবেক ইন্সট্রাক্টর ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ স্কোয়ার্ডন লিডার আখতার হোসেন বলেন, সচরাচর পাখির সঙ্গে ধাক্কা লেগে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে না। বাজিতপুরে যেটা ঘটেছে সেটার তদন্ত হওয়া উচিত। তার আগে কিছুই সুনির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও প্রাথমিকভাবে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে এটাকে এনভায়রনমেন্টাল ফ্যাক্টর বলে দায় এড়ানোর সুযোগ খুব কম। বাজিতপুরের ঘটনাস্থলের আবহাওয়া ছিল বেশ পরিষ্কার ও শান্ত। সেখানে পাাখির আঘাতে হেলিকপ্টারটির সামনের উইন্ড শিল্ড ভেঙে যাওয়ার পর পাইলটের জরুরি অবতরণ রহস্যজনক। তার ধারণা হেলিকপ্টারটি নিচ নিয়ে উড়ছিল। এতে কোনো গাছের ঢালের সঙ্গেও ধাক্কা খেয়ে উইন্ড শিল্ড ভেঙে যেতে পারে।

তিনি বলেন, বার্ড হিটজনিত কারণ হলে এ ধরনের পরিস্থিতিতে দুর্ঘটনা এড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। তার মতে, আকাশ হল পাখির বিচরণ ক্ষেত্র। সেখানে পাখির অবাধ বিচরণ থাকাটাই স্বাভাবিক। পাইলটকে সেটা মাথায় রেখেই হেলিকপ্টার ফ্লাই করতে হয়। হেলিকপ্টারের গতি ও উচ্চতা তেমন বেশি না হলে দেখেশুনে চালালে পাখি সামনে পড়ে গেলেও এটা এভয়েড করা যায়। এটা নির্ভর করে পাইলটের দক্ষতা ও অদক্ষতার ওপর।

এদিকে সিভিল এভিয়েশনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, বারবার মেঘনা কোম্পানির হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার শিকার হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এর রক্ষণাবেক্ষণ ও অপারেশন যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বেসরকারি হেলিকপ্টার সংস্থাগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা ও নিয়মকানুন মেনে চলছে কিনা তা দেখভালের দায়িত্ব সিভিল এভিয়েশনের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সিভিল এভিয়েশন সঠিকভাবে তদারকির দায়িত্ব পালন করছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ এর আগে সিভিল এভিয়েশন মেঘনা গ্রুপেরই দুটি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেনি।

পাখির ধাক্কায় জমিতে হেলিকপ্টার